সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৮)

মজুর মার্ক্স ও মে দিবস 

সরকার পক্ষের আইনজীবী গ্রিনেল ভিক্টর উগ‍্যোর সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি কি বলেছিলেন, সেটা আমার তরফে আর পুনরুক্তি করার কোনো প্রয়োজন আমি দেখছি না। কিন্তু আমাদের এক জার্মান দার্শনিকের কথা ধার করে আমি গ্রিনেল সাহেবের কথার উত্তর দিতে চাই।

দার্শনিক বলছেন, আপনারা শুনুন, তিনি বলছেন, আমাদের বুর্জোয়ারা ধ্রুপদী সাহিত‍্যের স্মৃতির  প্রতি সম্মানে স্মারকস্তম্ভ খাড়া করে তোলেন, কিন্তু যদি তাঁরা ওই সাহিত‍্যগুলি পাঠ করতেন, তাহলে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওগুলি পোড়ানোর হুকুম দিতেন!  এই যে এই আদালতেই সরকার পক্ষ আরবেইটার জাইটুং সংবাদপত্রের একটা আর্টিকেল থেকে উদ্ধৃত করে জুরিদের কাছে আমাদের মতো অভিযুক্ত নৈরাজ‍্যবাদীদেরকে বিপজ্জনক ও সাংঘাতিক লোক হিসেবে চেনাতে চেয়ে যা বললেন, ওটা আসলে জার্মান মহাকবি গ‍্যেটের ফাউস্ট থেকে তুলে আনা। আইন শৃঙ্খলা আর শ্রেণিগত বিশেষ সুবিধা যেন বংশগত রোগের মতো করে চলতে থাকে। প্রসিকিউশন আইনজীবী জর্জ ইঙ্গহ‍্যাম খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী জুরিদের কাছে পারীর কমিউনিস্টদের, আমরা তাঁদের সহযোদ্ধা কমরেড হিসেবে সম্মান করি, তাঁদের বিরুদ্ধে বলছিলেন, ১৮৭১ এ পারীর কমিউনিস্টরা না কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে তাঁর মহাসিংহাসন থেকে অপসারিত করে তাঁর পূত পবিত্র আসনে একটা নোংরা বেশ‍্যা মাগীকে বসিয়ে দিয়েছিল। মাননীয় প্রসিকিউশন আইনজীবী জর্জ ইঙ্গহ‍্যামের ওই ধরনের বাক‍্যবিন‍্যাসের চমৎকার ফল ফলেছিল। খ্রিস্টান ধর্মভীরু জুরিগণ কমিউনিস্টদের প্রতি তিতিবিরক্ত হয়েছিলেন।

হে ধর্মাবতার, আমি আশা করছি যে আপনি অনুগ্রহপূর্বক ওই সুশিক্ষিত ভদ্রলোক জর্জ ইঙ্গহ‍্যামকে জানিয়ে দেবেন যে উনি যে ঘটনাটার কথা বলতে চাইছিলেন, সেটা ফ্রান্সের পারীতেই ঘটেছে, তবে তা ঘটেছে এক শতাব্দী আগে, আর ওই ধর্মদ্রোহীগণ ছিলেন আমাদের এই রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠাতাগণের সমসাময়িক। ওই ব‍্যক্তিদের একজন ছিলেন টমাস পেইন (১৭৩৭ – ১৮০৯)। আর ওই যে নারীটিকে বারবনিতা বলে চেনানো হচ্ছে, তিনি কিন্তু আদপেই তা নন, তিনি পারীর একজন সম্মানিতা নাগরিক। ভদ্রমহিলা সেই সময় যুক্তিবাদের প্রতিভূ দেবী হিসেবে সকলকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

দু বছর আগে সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন হকিং ভ‍্যালির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমি লক্ষ্য করেছি কী করুণভাবে ওখানকার শত শত বাসিন্দা ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে জেনে রাখা দরকার ওখানে কিন্তু ডিনামাইট ছিল না, আর গরিব মানুষগুলিকে যারা ওইভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছিল, তাদেরকে কেউ নৈরাজ‍্যবাদী বলেননি। ওঁরা সব সমাজের সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত শ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ, ওঁরা যে একচেটিয়া পুঁজিমালিক। একচেটিয়া পুঁজিপতি বলেই ধরে নিতে হবে ওঁরা সব আইন মেনে চলা নাগরিক। এইসব খুনে মানুষগুলোর উপর কেউ কোনোদিন অভিযোগের আঙুল তোলে না। খবরের কাগজ‌ওয়ালাদের‌ও এদের বিরুদ্ধে লিখতে কলম সরে না। আর ওহায়ো প্রদেশের সরকার‌ও এদের পাশেই থাকেন। কিন্তু এই জঘন্য হত‍্যালীলার শিকার যে মানুষগুলি, তারা যদি ফুঁসে উঠত, ক্ষেপে উঠত, তারা যদি ডিনামাইট হাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে গলা কাটা শোষক শয়তানদের কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিত, তাহলে সবাই বলতেন সন্ত্রাস চলছে, বলতেন সভ‍্যতা বিপন্ন হয়েছে।

মিস্টার মোস্ট এর লেখা চিঠি, যে চিঠিটি এখানে পড়ে শোনানো হয়েছে, সেই চিঠির প্রসঙ্গ টেনে মিস্টার ইঙ্গহ‍্যাম বলেছেন, “ওরা”, এখানে ওরা মানে মিস্টার মোস্ট আর আমি, ” ওরা ওই ডিনামাইট দিয়ে হকিং ভ‍্যালির হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলতে পারত। সাক্ষী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওই চিঠি সম্পর্কে যা যেটুকু আমি জানি, তা সব‌ই বলেছি। কিন্তু ওই সঙ্গে আজ আজ আমি আরো দুটো কথা যোগ করতে চাই। দু বছর আগে সাংবাদিক হিসেবে আমি যখন হকিং ভ‍্যালির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আমি লক্ষ্য করেছি কী করুণভাবে ওখানকার শত শত বাসিন্দা ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে জেনে রাখা দরকার ওখানে কিন্তু ডিনামাইট ছিল না, আর গরিব মানুষগুলিকে যারা ওইভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছিল, তাদেরকে কেউ নৈরাজ‍্যবাদী বলেননি। ওঁরা সব সমাজের সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত শ্রদ্ধেয় মহাপুরুষ, ওঁরা যে একচেটিয়া পুঁজি মালিক। একচেটিয়া পুঁজিপতি বলেই ধরে নিতে হবে ওঁরা সব আইন মেনে চলা নাগরিক। এইসব খুনে মানুষগুলোর উপর কেউ কোনোদিন অভিযোগের আঙুল তোলে না। খবরের কাগজ‌ওয়ালাদের‌ও এদের বিরুদ্ধে লিখতে কলম সরে না। আর ওহায়ো প্রদেশের সরকার‌ও এদের পাশেই থাকেন। কিন্তু এই জঘন্য হত‍্যালীলার শিকার যে মানুষগুলি, তারা যদি ফুঁসে উঠত, ক্ষেপে উঠত, তারা যদি ডিনামাইট হাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে গলা কাটা শোষক শয়তানদের কুচিকুচি করে উড়িয়ে দিত, তাহলে সবাই বলতেন সন্ত্রাস চলছে, বলতেন সভ‍্যতা বিপন্ন হয়েছে।

যখন ইস্ট সেন্ট লুইস এ জয় গৌল্ডের ভাড়াটে গুণ্ডারা, থুড়ি, তাজা ছেলেরা, ঠাণ্ডা মাথায় ছয়জন নিরীহ শ্রমিক নরনারীকে গুলি করে মেরে দিল, তখন কিন্তু এত শোর মচানো হয় নি। গ্র‍্যাণ্ড  জুরিগণ তখন ভদ্রলোকেদের বিরুদ্ধে আইনি  ব‍্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইলেন না। বিচার বিভাগের তরফে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি চিকাগোয়, মিলাওয়াকিতে, আরো কত কত জায়গায়। চিকাগোয়, এক আসবাবপত্র তৈরির কারখানা মালিক এই তো গত বসন্তকালে দু দুটো ধর্মঘটী শ্রমিককে গুলি করে গুরুতর জখম করে দিল। সেই মালিককে গ্র‍্যাণ্ড জুরিদের কাছে পেশ করা হলে জুরিগণ মালিকটির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে চাইলেন না। কিন্তু আরেক ক্ষেত্রে যখন পুলিশের তরফে মারদাঙ্গা আক্রমণের সামনে কেউ একটা বোমা ছুঁড়ল, আর শাসক শ্রেণির লোকের রক্তপাত হল, তখন সে কি শোর মচানো হল! চতুর্দিক থেকে রব উঠল, ষড়যন্ত্রীদের হাতে দেশ বিপন্ন! ক্ষতিপূরণ আদায় করতে আট ব‍্যাটাকে কোতল করার জন্য টেনে আনা হল। তখন জনগণের আবেগ নিয়ে কত বাগবিস্তার, সরকারের তরফে বলা হল এইবার জনতা জনার্দন খেপেছে। কিন্তু ঘটনা হল এই যে, সকলকে এতটা সন্ত্রস্ত করে রাখা হল যে, সরকারের শিখিয়ে দেওয়া গতে বাঁধা বুলির বাইরে ব‍্যক্তি নাগরিকের পক্ষে কথা বলার, গলা তোলার সাহসটুকু হল না।

ব‍্যক্তি নাগরিক গলা তুলতে সাহস করল না, কেননা তারা জানত, সরকারের বেঁধে দেওয়া গতের বুলির বাইরে বেসুরো গাইলে তাকে গারদে পোরা হবে, এমনকি ফাঁসিতে ঝোলানোর বন্দোবস্তও হয়ে যেতে পারে। আর এই যেমন আজ এই মহামান্য ধর্মাধিকরণের নির্দেশে আমাদের ফাঁসিতে ঝোলানোর আয়োজন হয়ে গিয়েছে। গ্রিনেল আমাদের দেখিয়ে বার বার বলেছিলেন, এই লোকগুলোর কোনোরকম ন‍্যায়নীতির শিক্ষা নেই, এরা সব পাতি খুনে গুণ্ডা, এরা সব ডাকাত। এইসব বলে গ্রিনেল গায়ের জ্বালা মিটাতে চেয়েছিলেন‌। আজ আমি স্বীকার করছি, আমাদের লক্ষ্য আর স্বপ্ন গুণ্ডা মস্তানদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু, তাদের যদি আমাদের লক্ষ্য ও কর্মকাণ্ড বোঝার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সে দোষ তো আমাদের নয়। আমার যদি বুঝতে ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে বলব, বিপক্ষ ধরেই নিয়েছেন আমরা সম্পত্তি ধ্বংস করতে চেয়েছি। যাচাই না করেই, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমাদের সম্বন্ধে ওঁরা কটূক্তি করে চলেছেন‌। আর এইটি করতে গিয়ে তারা তথ‍্যবিকৃতিও করছেন।  এই ধরনের তথ‍্যবিকৃতিটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হচ্ছে কি না, সেটা আমি বলতে পারছি না। আমার সেটা জানা নেই। কিন্তু আমাদের যে তত্ত্ব, আমাদের যে বিচারধারা, তার নিরিখে আমি বলতে চাই, আমাদের বিরুদ্ধে ওই ধ্বংসপন্থী আখ‍্যা দিয়ে অভিযোগ তোলাটা জঘন্য ধরনের মিথ্যাচার।

ধর্মাবতার, এখানে আপনার কোর্টে আরবেইটার জাইটুং আর অ্যালার্ম কাগজ থেকে বাছাই করা লেখা পড়ে শোনানো হয়েছে এবং দেখাতে চাওয়া হয়েছে যে এই মামলার আসামীরা, আমরা কতদূর বিপজ্জনক চরিত্রের মানুষ। বেশ কয়েকটি বছরের পুরোনো ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে ঠিক যেগুলিতে ধর্মঘটী শ্রমিকদের উপর কর্তৃপক্ষের অত‍্যাচারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা হয়েছে, সেইগুলিই খুঁজে পেতে এনে আদালতে পড়ে শোনানো হয়েছে। কিন্তু ওইগুলি ছাড়া কাগজদুটিতে আর কি কি ধরনের আর্টিকেল বেরিয়েছে, তা আদালতের কাছে পড়ে শোনানোর কোনো প্রাসঙ্গিকতা সরকার পক্ষ অনুভব করেন নি। কেন‌ই বা শোনাবেন, অন‍্য আর্টিকেলগুলিতে তো তাঁদের উদ্দেশ্যসাধন হবে না! সরকার পক্ষের অ্যাটর্নি, ( তিনি নিজে খুব ভাল করেই জানেন যে তিনি যখন বলেন, তিনি মিথ‍্যাই বলেন), জোর দিয়ে বললেন, আমাদের মধ‍্যে নাকি নীতিবোধ মূল‍্যবোধের কোনো বালাই নেই।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।