• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৪)

আমার কথা

১৩
আমাদের ছোটবেলায় দুর্গা পুজো এলে শাদা কাগজের উপর লাল কালিতে পূর্ববর্তী বৎসরের হিসেব নিকেশ ছাপিয়ে বাড়ি বয়ে দিয়ে যেত। তখনো মানুষের মনে একটা হিসাব দেবার দায়বদ্ধতা থাকত। পাবলিক মানি নিয়ে নয়ছয় করাটাকে লোকে খারাপ চোখে দেখত। সরস্বতী পূজা হত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও গানের স্কুলে, আঁকার স্কুলে। আস্তে আস্তে রাজনীতি করিয়ে-রা বুঝতে পারলেন জনগণের মধ্যে এই যে সংগঠনী ব্যাপারটা আছে, একে মুঠোয় পোরা চাই। যেখানে যত ক্লাব সংগঠন সব জায়গায় “আমাদের লোক” বসানো হতে থাকল। শিক্ষক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন, সকলের নিজের নিজের ভাষা গেল হারিয়ে। এক অতিলৌকিক নেতৃত্ব সব কিছুকে পকেটে পুরে নিল। এই সব চলতে চলতে একদিন সিনিয়র পুলিশ অফিসার বিনোদ মেহতা খুন হয়ে গেলেন। বিনোদের খুনটি নিশ্চিত ভাবেই রাজনৈতিক খুন ছিল।
১৪
আমাদের স্কুলের প্রতিটি জাঁদরেল শিক্ষকের প্রাইভেট টিউশনি ব্যবসা ছিল। বঙ্গে স্কুল শিক্ষকের পক্ষে প্রাইভেট টিউশনি এক মজার কল। সরকারি হাসপাতালের কোনো কোনো ডাক্তার যেমন পেশেন্ট পার্টিকে ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন, তেমনি স্কুল শিক্ষকেরাও ছাত্রের আর অভিভাবকের হৃৎকম্প জাগিয়ে নিজেদের খোঁয়াড়ে ভর্তি করতেন। সকালে দু ক্ষেপ আর সন্ধ্যায় দু তিন ক্ষেপ মেরে ওঁরা এমনিই ক্লান্ত থাকতেন যে ক্লাশে পাঠদানে উৎসাহ পেতেন না। যারা কোচিং এ পড়ত, তারা সেখানে বুঝে নেবে বলে ক্লাসে মন দিত না। মাস্টার ক্লান্ত থাকতেন। আমরা যারা কোনো কোচিং এর ধারপাশ মাড়াতাম না, অথচ গবেট প্রতিম, তারা পড়তাম বেকায়দায়। আমরা কোচিং এ ঢুকি নি বলে অনেক মাস্টারের বিরাগভাজন ছিলাম।
১৫
বাবার বক্তব্য ছিল যে স্কুলে দেওয়া হয়েছে পড়ার জন্য। সেখানেই পড়া বোঝার কথা। ছেলেকে সেখানেই বুঝে নিতে হবে। আবার কোচিং কেন?
আর মাস্টাররা ক্লাসে একটা কৃত্রিম অভাব তৈরী করে কোচিং ক্লাসের চাহিদা তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে আমার মতো নিরেট গোছের ছাত্রদের কিছু অসুবিধা হত। স্কুলে যাওয়া আসা হত, কিন্তু শেখা কিছু হত না। আমরা পড়া না পারলে শিক্ষক ঘরের বাইরে নিল ডাউন করিয়ে রাখতে লজ্জা পেতেন না। ছাত্র শিখতে না পারলে না বোঝাতে পারার দায় টা যে শিক্ষকের উপর বর্তায় এই বোধটা ওঁদের ছিল না। ইচ্ছামত প্রহার, বাক্যবাণ এবং নিলডাউন ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে একটা শাসক ও শাসিতের ভেদ এনে দিত। রামকৃষ্ণ মিশনে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের চিন্তাপদ্ধতি ছিল ব্রাত্য।
১৬
আমার যে লেখাপড়া বিশেষ হবে না, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এ নিয়ে সকলের খুব মাথাব্যথা ছিল। অনেক সহপাঠীর মা তো আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকতেন। মা খুব উৎকণ্ঠাগ্রস্ত না হলেও তারা নানা ভাবে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিতেন। আমি ছিলাম নির্বিকার। বাবাও কিছু ভাবতেন না। মা পড়লেন উভয় সংকটে। কেননা তিনি আর্থিক প্রশ্নে বাবার উপর পুরো মাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন। অনেক যুদ্ধ করে বাবার থেকে আর্থিক অনুদান আদায় করে তিনি যে কোচিং এ গেলেন, সেখানকার শিক্ষক আমার নাম শুনেই বেঁকে বসলেন। এমনই ছিল বাজারে আমার সুনাম। মায়ের চোখের জলের কাছে তিনি দ্রবীভূত হন ও আমাকে মানুষ করার দায় গ্রহণ করেন। সেটা দশম শ্রেণীর মাঝামাঝি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *