সীতা হনু সংবাদ
সীতাদেবী ফিরিয়া আসিয়াছেন। রাম ও লক্ষ্মণের তাঁবুর পাশেই তাঁর জন্য একটি সুদৃশ্য তাঁবুর ব্যবস্থা হইয়াছে। তাঁবুর আব্রু রক্ষায় বানরীদের একটি কম্যান্ডো বাহিনী নিযুক্ত আছে। সুগ্রীব মহিষী রুমা স্বয়ং তাহার দেখভাল করিতেছেন। বাহিরে একটি সুশিক্ষিত বানরসেনা দল গণ্ডি করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। প্রহরে প্রহরে তাহার বদল হইতেছে। অঙ্গদ স্বয়ং ইহার দায়িত্ব লইয়াছেন। জাম্ববান জনান্তিকে বলিতেছেন এত বিপুল সুরক্ষার দরকার ছিল না। রাক্ষসকুলের যতগুলি হিংস্র ধাঁচের সদস্য ছিল, সকলেই মরিয়াছে। নারী শিশু আর বৃদ্ধ অথর্ব ব্যতীত আর কেহ লঙ্কায় নাই। মহাকপিগণ রাগিয়া বলিতেছেন সীতাদেবী যে অক্ষত শরীরে শত্রুপুরী হইতে ফিরিয়া আসিতে পারিয়াছেন ইহাই মহা সমাদরে সেলিব্রেট করিবার বিষয়। কম্যান্ডো বাহিনী ও স্পেশাল প্রোটেকশন গ্ৰুপ নিয়োগ তাহারই অঙ্গ। হনুমান হাই তুলিতেছিলেন। লক্ষ্মণ বলিলেন, কি রে ব্যাটা, ঘুম পেয়ে গেল না কি? রাতে কি ফল চুরি করতে বেরিয়েছিলি?
হনুমান মনে মনে হাসিল। রাবণের আম্রকাননে সে যে পরিমাণ ফল উদরসাৎ করিয়াছিল, তাহাতে অন্য কেহ হইলে অবশ্যই উদরাময় রোগে ভুগিত। কেবল অমন স্বর্গীয় আমে কোনো প্রকার কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় না বলিয়া কোনো দোষ বর্তায় নাই। আমকে যে কেন রসাল বলে সেইদিন হনুমান বুঝিয়াছিল। তবে এখন তো সে বাগান আর নাই। তাই কাহাকেও সে হেন বাগানের বৃত্তান্ত বলা বৃথা।
এমন সময় মদিরাক্ষী একজন রাক্ষসী আসিয়া কহিল যে সীতা হনুমানকে নিজের তাঁবুতে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। রাক্ষসী যে এরূপ মারকাটারি সুন্দরী হইতে পারে কাহারও জানা ছিল না। যাঁহার চাকরানি এহেন সুন্দরী, তিনি স্বয়ং না জানি কি অসামান্য সুন্দরী। কিন্তু সীতাকেও হনুমান ভিন্ন কেহ দেখে নাই। লক্ষ্মণ সর্বদা ওঁর পায়ের দিকে তাকাইয়া দিন কাটাইতেন। যুদ্ধের দিনগুলির আগেই তা জানা গিয়েছিল। সীতাদেবীর গহনাগুলির মধ্যে লক্ষ্মণ কেবল মাত্র পায়ের গহনাগুলিই চাক্ষুষ করিয়াছিলেন শুনিয়া সুগ্রীব মহাশয় একটু লজ্জিত হইলেন। নিজের দাদা বালীর স্ত্রী তারাকে তিনি দাদার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই স্ত্রী রূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন। সুতরাং অধোবদন হইয়া বসিয়া থাকা ভিন্ন অন্য বুদ্ধি খাটিল না।
হনুমান সদর্পে সীতা দেবীর তাঁবুর সন্নিধানে চলিল। নল কহিলেন, ওরে, গায়ে একটু আতর টাতর ছিটিয়ে নিলে হত না? হনুমান মিচকে ফিচেল হাসি হাসিয়া এক চোখ মটকাইয়া আগাইয়া গেল। অন্য বানর ও ঋক্ষগণ মনে মনে ঈর্ষাকাতর হইয়া পড়িল। ঋক্ষ কুলতিলক জাম্ববান কহিলেন, বাঁদরটার কাণ্ড দেখ, ডাক পাওয়া মাত্র লেজ তুলে দৌড়াল। অন্যতম মহাকপি নল বলিলেন, দেখ, জাত তুলে গালি দেওয়া ভাল নয়।
সীতাদেবীর তাঁবুতে ঢুকিতে যাইতেই হনুমানকে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্ৰুপ আটকাইল। তাহাদের সর্বাধ্যক্ষ অঙ্গদ আসিয়া হনুমানকে বলিল, ভিতরে যাইবার পাশ দেখাও। রাক্ষসী তাড়াতাড়ি আসিয়া অঙ্গদের প্রতি এমন একটি মধুর দৃষ্টিবাণ হানিলেন, যে অঙ্গদ ফিদা হইয়া গেলেন। হনুমান হাসিয়া রাক্ষসীর পশ্চাতে চলিল।
সীতাদেবী একটি পালঙ্কে বসিয়া আছেন। পায়ের কাছে কতকগুলি সুন্দরী রাক্ষসী। হনুমান অবাক হইয়া সীতাদেবীর দিকে তাকাইল। এ কেমন সীতা? অশোক বনে যাঁহাকে দেখিয়াছিল, তিনি দেবকন্যার মত শুচিস্মিতা। ইনি রাজেন্দ্রাণী সাজিয়াছেন।
রাক্ষসীদের একজন কহিল, কি, রাণী মায়ের সামনে দণ্ডবৎ হও।
হনুমান বলিল মায়ের কাছে বেটার অত ফর্মালিটি কিসের? মা, তুমি ওদের যেতে বলো।
সীতা রাক্ষসীদের তফাতে যাইতে নির্দেশ দিলেন। হনুমানকে কাছে বসাইয়া একজন দাসীকে নানাবিধ সুপক্ক ফল আনিবার আদেশ দিলেন।
মর্তমান কলার খোসা ছাড়াইতে ছাড়াইতে হনু কহিল মা, কেমন লাগিতেছে?
সীতা বলিলেন ভাল লাগিতেছে না বাপু। লঙ্কাতেই যেন ভাল ছিলাম।
হনুমান অবাক হইয়া কহিল, বল কি মা, লঙ্কাতেই ভাল ছিলে? প্রভু শুনিলে বড় দুঃখ পাইবেন।
সীতা বলিলেন, দোষ বাপু তোমারই। তুমি কেন অশোক বনে গিয়েছিলে? দু দশটি আম খাইয়া সরিয়া পড়িতে পারিতে। গাছগুলি ভাঙিলে কোন আক্কেলে? গাছ পরিবেশের বিস্তর উপকার করে ইহা কি তোমাদের পাঠশালায় পড়ানো হয় না?
হনুমান মিন মিন করিয়া বলিল, মা গাছ ভাঙিবার জন্য তো ভাঙি নাই। আমি লঙ্কাবাসীর কাছে নিজের ক্ষমতার পরিচয় দিতে চাহিয়াছিলাম।
সীতাদেবী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, হ্যাঁ নিজের মুখটুকু পোড়াইলে। ইহার পর হইতে তোমাকে যে সকলে আড়ালে মুখপোড়া বাঁদর কহে তাহার খবর কি রাখ?
ঘটনা সত্য। যদিও মুখের উপর এখনো কেউই মুখপোড়া বলিয়া গাল দেয় নাই, তথাপি জনান্তিকে যে তাহাকে লইয়া ঠাট্টা ইয়ার্কি হইয়া থাকে, এবং তাহাতে কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের তাবড় তাবড় বানরের দল অংশগ্রহণ করেন, তাহা হনু বিলক্ষণ অবগত।
কিন্তু সত্যবাক্য শুনিলে অনেকে চটিয়া যায়। হনুও চটিয়া কহিল, যাহা করিয়াছি, প্রভুর সম্মান রক্ষার্থে করিয়াছি।
সীতাদেবী হনুমানকে আরো চটাইবেন বলিয়া বলিলেন, হুম, তোমার প্রভুর ভারি সম্মান তো তুমি রাখিলে!
হনু চটিয়া কহিল, কেন মা, আমি তো উঁহার জয় নিশ্চিত করিতে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে খোদ রাবণের মহিষী মন্দোদরীর নিকট হইতে রাবণের মৃত্যুবাণ চাহিয়া আনিয়া ছিলাম।
সীতা দুষ্টুমি করিয়া কহিলেন, তাহা হইলে তুমি স্বীকার করিলে তোমার বুদ্ধি কৌশলে রাবণ মরিয়াছে?
হনুমান সগর্বে বুক ফুলাইয়া কহিল হ্যাঁ।
সীতা আবার বলিলেন, তুমি ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে রাবণ জায়ার কাছ হতে বাণ আনিয়াছিলে?
হনুমান বুকে কয়েকটা চাপড় মারিয়া বলিলেন, বটেই তো।
সীতা সেই মোক্ষম সময়ে বলিলেন, তবে শোনো, রাবণ জায়া বুঝতে পারেন নি যে একটি মর্কট তাঁর কাছে বাণ চাইছে। তিনি তোমাকে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ভেবেছিলেন। রাবণও উচ্চস্তরের ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ কখনো ব্রাহ্মণের প্রাণহন্তারক হতে পারে না। এই জ্ঞানে পরম বিশ্বাসে রানী মন্দোদরী তোমার হাতে স্বামীর মৃত্যুবাণ তুলে দিয়েছিলেন। শুধু এই বিশ্বাসে যে একজন সদ ব্রাহ্মণ সেই বাণ নিরাপদে রাখবে।
হনুমান গোঁ ধরিয়া কহিল, কিন্তু ওই বাণের জন্যই তো রাবণ কুপোকাত হল।
সীতা বললেন, মৃত্যুবাণ চুরি করে এনে তো যে কেউ রাবণকে খুন করতে পারত। তার জন্যে মহাবীর হতে তো হয় না। মৃত্যুবাণ চুরি না করিয়ে যদি নিজের বাহুবল দেখিয়ে রামচন্দ্র রাবণ নিকেশ করতে পারতেন, তো বুঝতাম বীর বটে।
হনুমান বলিল, মা, এই সব কটু কথা বলিবে বলিয়াই কি আমায় ডাকাইয়া আনিয়াছ?
সীতা বলিলেন, না না, তা কেন? কটু কথা তোমায় কোথায় বলিলাম? আচ্ছা, তোমার জানা আছে, সৈনিক দল যাহা করে, তাহার দোষগুণ সকলি সেনানায়কের উপর বর্তায়?
কথাটা কোন দিকে মোড় নেবে হনুমান ভেবে উঠতে পারে না। আমতা আমতা করে বলে, তা সেনানায়কই তো সেনাদের পরিচালনা করে। কন্ট্রোল করে।
সীতা ব্যঙ্গ করে বললেন, গুণ্ডা কন্ট্রোল করে বলো?
হনুমান অবাক হয়ে তাকায়। গুণ্ডা কন্ট্রোল? সে আবার কি কথা? গুণ্ডা কন্ট্রোলের কথা আসছে কেন?
সীতা বলেন, সকল যুদ্ধের একটা নিয়ম থাকে। যার অস্ত্র নেই, যে মরণাপন্ন, তার উপর কোনো আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন সৈনিক আঘাত হানে না। মেয়েদের গায়ে হাত দেয় না। ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি করে না।
হনুমান চুপ করিয়া শোনে।
সীতা বলেন, তোমার যুদ্ধ যদি ধর্মযুদ্ধ হয়, তা হলে এমন কতকগুলি নিয়ম তোমাকে মানতে হয়।
হনুমান আঁচ করিতে পারে না সীতা অতঃপর কি বলিবেন।
সীতা বলেন সেদিন মণিপুরে মনোরমা থাংজাম কে সেনারা উগ্রপন্থী সন্দেহে গুলি করিয়া মারিয়াছে।
হনু কহিল, উগ্রপন্থী হইলে তো তাকে ঠেকাইতেই হইবে।
সীতা তাহাকে ভ্যাঙাইয়া কহিলেন, হ্যাঁ, একটা মেয়েকে ঠেকাইতে গিয়া তোমার মিলিটারির দল সব কয়টা গুলি তাক করিয়া মনোরমার যৌনাঙ্গে পুরিয়াছে। যেন যৌনাঙ্গ ছাড়া একটি মেয়ের শরীরে অন্য কোনো জায়গা তারা চেনে না।
হনুমান মাথা নিচু করে। মণিপুরের ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষিত সম্মানিত মায়েরা কাংলা দুর্গের সামনে নগ্ন প্রতিবাদ করেছিলেন, সেটা দুনিয়া দেখিয়াছিল। তাহাতে ভারতের মুখ উজ্জ্বল হয় নাই।
হনুমান কহিল যারা কাজ করে, তাহাদের দু একটা ভুল হয়। উহাকে বড়ো করিয়া দেখিও না।
সীতা কহিলেন, হ্যাঁ কাশ্মীরে নিরপরাধ যুবককে গাড়িতে বাঁধিয়া ঘোরাইয়া গুণ্ডা কন্ট্রোলের বহর দেখাইয়াছ। দেশে বিদেশে রামবাহিনীর সদস্যদের সম্মান বাড়িয়া চলিয়াছে।
হনুমান বলিল, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহার উপর দখলদারি ছাড়িব না।
সীতা বলিলেন, হ্যাঁ, দখল। ওই একটি মন্ত্রে তোমরা সব অন্যায় কাজকে দেশপ্রেমের তকমা পরাও। তোমাদের দেশপ্রেম দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে।
হনুমান খেপিয়া উঠিয়া বলিল আমার দেশপ্রেম নিয়ে ঠাট্টা কোরো না বলছি।
সীতা কহিলেন, হনুমান, তুমি কি জান, রাবণ তোমার ছল করে চেয়ে আনা বাণের চোটে নিহত হবার পরে, তোমাদের বানরসেনা রাণী মন্দোদরীকে সর্বসমক্ষে বিবস্ত্র করে লাঞ্ছনা করেছে। এই কুৎসিত কাজ হয়েছে জানার পর আমি যে আর স্থির থাকতে পারছি না। বিপক্ষের লোক হলেই তাকে তোমরা এভাবে অপমান করতে পার না। এতে তোমার মালিকের লজ্জায় মাথা কাটা যাবার কথা। কিন্তু দেখ এমন কুৎসিত কাণ্ড ঘটিয়ে তাঁর কোনো লজ্জাবোধ নেই। সংবিধানের পাতায় ঘটা করে লিখেছিলেন নারীর সম্মান সুরক্ষিত করা নাগরিকের পুণ্য দায়িত্ব। অথচ দেশে একটা দিন যায় না যেদিন কোনো মেয়ে ধর্ষিতা লাঞ্ছিতা হয় না। নির্ভয়া দামিনীর কান্নায় দেশের বাতাস ভারি হয়ে এল।