|| কোয়ান্টা থেকে কনডেনসেট: একটি অসাধারণ যাত্রায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

কোয়ান্টা থেকে কনডেনসেট: একটি অসাধারণ যাত্রায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান
তারিখটা ছিল জুনের চার। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার, একজন ত্রিশ বছর বয়সী যুবক বিশ্ববিখ্যাত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের উদ্দেশে চিঠি লিখলেন। একেবারেই একটা আবদার জানিয়ে লিখলেন, আমি “ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ল’ আর আলোর কোয়ান্টা বিষয়ক হাইপথিসিস” নামে একটা গবেষণা পত্র লিখে ফেলেছি। আমি বিকিরণ বা রেডিয়েশন এবং আলট্রা ভায়োলেট ক্যাটাসট্রফি নিয়ে পড়াচ্ছিলাম। আমি ছাত্রদের বলছিলাম, এই সময়ে এ ব্যাপারে যে তত্ত্ব প্রচলিত আছে, তা যথেষ্ট সম্পূর্ণ নয়, কেননা, অঙ্ক কষে যে ফল পাওয়া যায় পরীক্ষা লব্ধ ফলাফলের সঙ্গে তা ঠিক মতো মেলে না। এই না মেলার ব্যাপারটা ছাত্রদের কাছে বিশদে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি ভাবলাম, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে ম্যাক্সওয়েল বোলটজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন ঠিক খাটবে না।
এই প্রবন্ধটি যাতে আইনস্টাইন স্বহস্তে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জেইটশ্রিফট ফর ফিজিক বা জার্নাল ফর ফিজিক্স নামে জার্মান পত্রিকায় প্রকাশিত হবার বন্দোবস্ত করে দেন, যুবকটি তেমন আবদার করলেন। জেইটশ্রিফট ফর ফিজিক ১৯২০ থেকে বেরোতো। স্প্রিঙ্গার বার্লিন হাইডেলবার্গ এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
যুবকটি আরো লিখলেন আমি জার্মান ভাষা পড়তে ও লিখতে দুইই পারি, কিন্তু একটা বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লোককে পড়তে আকৃষ্ট করার মতো যথেষ্ট জার্মান আমার জানা নেই। আপনি যদি মনে করেন, আমার লেখাটা প্রকাশিত হবার দরকার রয়েছে, তাহলে অনুগ্রহ করে ওটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে জেইটশ্রিফট ফর ফিজিকে ছাপানোর বন্দোবস্ত করবেন।
আরো লিখলেন, আপনি আমাকে না চিনলেও আপনার কাছে এই অনুরোধ করতে আমার বিন্দুমাত্র লজ্জা সংকোচ আসছে না, কেননা, আমরা আপনার ছাত্র। সরাসরি ক্লাস যদিও করিনি, তবুও আপনার লেখা বই পড়তে পড়তে আমরা আপনার ছাত্র হিসেবেই নিজেকে মনে করি।
জানিনা, আপনার মনে আছে কি না, কলকাতা থেকে কে একটা ছেলে আপনার কাছে আপনার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করবে বলে অনুমতি চেয়েছিল। আপনি সেই ছেলেটিকে তেমন অনুবাদ করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। তারপর বইটি ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল। মহাশয়, এই অধমই সেই ব্যক্তি, যে আপনার গবেষণা সন্দর্ভ অনুবাদ করেছিল।
মহান বৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সৌজন্য প্রকাশ করে শুধু যুবকটির চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারই করলেন না, তাকে আশ্বাস দিলেন যে লেখাটির বিপুল বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য রয়েছে এবং তা তিনি প্রকাশ করাবেন।
আইনস্টাইন নিজের হাতে যুবকটির সন্দর্ভ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন। তা জেইটশ্রিফট ফর ফিজিক এর আগস্ট ১৯২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হল।
আজ থেকে একশত বছর আগে ঘটা এই ঘটনার সূত্রে অসাধারণ সব ঘটনা ঘটে গেল।
আমরা বিগত শতাব্দীর অন্যতম যুগান্তকারী পদার্থবিজ্ঞানসাধক আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪ – ১৯৭৪) র কথা বলছি। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (১৮৫৮ – ১৯৪৭) এর কোয়ান্টাম রেডিয়েশন ল’ নিয়ে চর্চা করতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের কোনো রকম ধ্রুপদী ধারণার উপর অবলম্বন না রেখে আচার্য বসু কোয়ান্টাম রাশিবিজ্ঞানের ভিত্তি প্রস্তুত করে দিলেন।
এখন আমরা মনে করি বিগ ব্যাং নামে মহা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে। বিগ ব্যাং ঘটার অতীব যৎসামান্য সময়, মনে করা যাক এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে, ধরা যাক, টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস ফরটি থ্রি সেকেন্ড, একে আমরা চিনব প্ল্যাঙ্ক যুগ বলে, এই সময়ের মধ্যে মহাবিশ্ব অঙ্কুরিত হল। তখন কতটুকুতার সীমা? না, ওয়ান পয়েন্ট সিক্স ইনটু টেন টু দি পাওয়ার মাইনাস থার্টিফাইভ
মিটার। এই যৎকিঞ্চিৎ দৈর্ঘ্যকে চেনানো হয় প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্য নামে। আর তাপমাত্রা ধরে নেওয়া হয় টেন টু দি পাওয়ার থার্টি টু সেলসিয়াস। অকল্পনীয় সব মাত্রা।
আমরা মনে করি, বিগ ব্যাং ঘটেছিল মোটামুটি ভাবে ১৩.৭৮৭ বিলিয়ন বৎসর আগে।
বিলিয়ন মানে বুঝতে হবে টেন টু দি পাওয়ার নাইন। একের পর নয়খানা শূন্য। বিগ ব্যাং ঘটার যৎসামান্য সময় পরে, এক সেকেন্ড সময়ের অতি সামান্য একটি ভগ্নাংশ সময় পরে, মহাবিশ্বে পদার্থের প্রাথমিক উপাদানগুলি উদ্ভূত হল এবং পরস্পরের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। এই যে একটা কণা আরেকটি কণার সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু করল, তারা সেটা করল অন্য ধরনের কণার মধ্য দিয়ে। এই ভিন্ন ধরনের কণাগুলি প্রকৃতির মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধরনের বলকে বহন করে। প্রকৃতির মধ্যে থাকা ভিন্ন ভিন্ন বলকে বহনকারী কণাদের চেনানো হয় বোসন নামে।
প্রকৃতিতে যে সমস্ত অতিপারমাণবিক কণা কোনো না কোনো ধরনের বল বহন করে, তারা সকলেই বোসন। কণাপদার্থবিদ্যার যে স্ট্যান্ডার্ড মডেলটা আমাদের হাতে রয়েছে, সেটা অতিপরমাণুলোককে জানা বোঝার জন্য বেশ মজবুত। এই স্ট্যান্ডার্ড মডেল বলছে সমস্ত রকম অতিপরমাণু মোটা দাগে মাত্রই দুই রকম, ফের্মিয়ন আর বোসন। ফের্মিয়নের উদাহরণ হল কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, নিউট্রিনো, প্রোটন আর নিউট্রনের মতো অতিপরমাণু, এদের নির্ভর করে পদার্থ জিনিসটার ভিত্তি তৈরি হয়। আর বোসনদের মধ্যে একদল আছেন গজ বোসন, যাঁরা কি না চারটি মৌলিক বলের মধ্যে অন্ততঃ তিনটি বলের পরিবহনের কাজ করেন। বল তিনটি হল, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা তড়িৎ চৌম্বক বল, স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স আর উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স। সোজাসাপ্টা কথায় এর মানে হল, ফের্মিয়ন কণারা গজ বোসন নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে নিজেদের মধ্যে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখায়। আর বোসনেরা সমগ্র মহাবিশ্বের অঙ্গনে শক্তি আর বল বহন করে চলেছে।
ফের্মিয়ন আর বোসনের মতো কণাগুলিকে বুঝতে হলে উলফগ্যাং আর্নস্ট পাউলি ( ২৫ এপ্রিল ১৯০০ – ১৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮) কে একটু জানতে হবে। বিশেষ করে পাউলি-র দেওয়া এক্সক্লুশন নীতিটি জানা বিশেষ দরকার। পাউলি বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড এবং ম্যাক্স বর্ন এর অধীনে ১৯২১ সালে তাঁর পিএইচডি থিসিস প্রস্তুত করেন। হাইড্রোজেন এর মলিকুলার আয়ন মডেলের ধারণা দিয়েছেন সেই থিসিসে। তারপর তিনি ইলেকট্রন নিয়ে চর্চা করতে করতে তাঁর বিখ্যাত এক্সক্লুশন নীতিটি দাঁড় করালেন। সময়টা ছিল ১৯২৫। পঁচিশ বছর বয়সী প্রতিভাবান অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী পাউলি প্রথমে এই নীতিটি ইলেকট্রনের জন্যই দাঁড় করিয়েছিলেন। পরে ১৯৪০ এর দিকে তিনি তাঁর স্পিন স্ট্যাটিসটিকস উপপাদ্যের মাধ্যমে এই এক্সক্লুশন নীতিকে আরো ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফের্মিয়নের জন্য বিকশিত করেন। এই এক্সক্লুশন নীতি এবং স্পিন থিওরি, এ দুটি পদার্থের গঠন নিয়ে আলোকপাত করে। এতে বলা হয়েছে যে, দুটি বা ততোধিক একই রকম কণা যাদের স্পিন পূর্ণসংখ্যার অর্ধেক মানের, তারা একটি কোয়ান্টাম ব্যবস্থার মধ্যে একই কোয়ান্টাম অবস্থায় একযোগে থাকতে পারে না।
যে সমস্ত অতিপারমাণবিক কণা এই পাউলির এক্সক্লুশন নীতিটি মান্য করে, তাদেরকে ফের্মিয়ন বলে। আর যারা এই নীতিটি মান্য করে না, সেই সব অতিপারমাণবিক কণার পরিচয় হল বোসন।
উলফগ্যাং পাউলি যখন তাঁর এক্সক্লুশন নীতিটি সদ্য সদ্য প্রকাশ করেছেন, তার পরেই তাঁর সেই নীতিটি অবলম্বন করে তাঁর সমবয়সী একজন ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি ( ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০১ – ২৮ নভেম্বর ১৯৫৪) একটি স্ট্যাটিসটিকাল ফরমুলেশন করে ফেললেন। পাউলির এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল যদি একটি আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে কী হবে, সেই নিয়ে ফের্মি একটা সন্দর্ভ দাঁড় করিয়ে ফেললেন। সময়টা ১৯২৬। ঠিক এই সময়েই তাঁদের আরেকজন সমবয়সী বরেণ্য পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক ( ৮ আগস্ট ১৯০২ – ২০ অক্টোবর ১৯৮৪) কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে নিজের ডক্টরাল থিসিস তৈরি করছিলেন। এনরিকো ফের্মি তাঁর সন্দর্ভ তৈরি করেছেন একটু আগে, পল ডিরাক একটু পরে। কিন্তু বছরটা একই, ১৯২৬। আর ওঁরা দুজনে নিজের নিজের মতো করে গবেষণা করছিলেন। কেউ কারো উপর নির্ভর করেন নি।
অতিপারমাণবিক জগৎটাকে বুঝতে পাউলি (জন্ম ১৯০০), ফের্মি ( জন্ম ১৯০১), এবং পল ডিরাক ( জন্ম ১৯০২) এর সঙ্গে তাঁদের সমবয়সী আরও একজন অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিককে জানা দরকার। তিনি ওয়ার্নার কার্ল হাইজেনবার্গ ( ৫ ডিসেম্বর ১৯০১ – ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬)।
১৯২৬ এ ফের্মি আর ডিরাক আলাদা আলাদা ভাবে নিজের নিজের সন্দর্ভ তৈরি করে ফেলার পরে জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ ১৯২৭ এর মার্চ মাসে “অন দি পারসেপচুয়াল কনটেন্ট অফ কোয়ান্টাম থিওরিটিক্যাল কাইনেম্যাটিকস অ্যান্ড মেকানিক্স” নামে এক যুগান্তকারী সন্দর্ভ প্রকাশ করেন। প্রকাশিত হবার কয়েকটি দিন আগে, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭ তারিখে হাইজেনবার্গ একটি পত্রে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলিকে নতুন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করেন। এই সন্দর্ভে হাইজেনবার্গ তাঁর অনিশ্চয়তা সূত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন, একটি পার্টিকল এর অবস্থান (বা পজিশন) এবং ভরবেগ ( বা মোমেন্টাম), এ দুটি একই সঙ্গে একই সময়ে নিখুঁত করে পরিমাপ করা যায় না। বরং এই গোছের চলরাশি (বা ভেরিয়েবল) গুলির পরিমাপের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাগুলির মধ্যে একটি সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। হাইজেনবার্গ আরো বললেন, যেহেতু, এইসব চলরাশির অনিশ্চয়তাগুলির ন্যূনতম একটি মাত্রা বর্তমান, তাই একটির অনিশ্চয়তা শূন্যের দিকে যেতে চাইলে অন্যটির সেই অনুপাতে বৃদ্ধি ঘটবে।
এইসব যুগ্ম চলরাশি, যেমন শক্তি ও সময়, এদের মধ্যে একটা সাদৃশ্যমূলক সম্পর্ক রয়েছে।
অতিপারমাণবিক জগৎটার দিক উঁকিঝুঁকি দেওয়া শুরু হয়েছিল ইলেকট্রন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। জেমস জোসেফ টমসন ১৮৯৭ তে ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছেন। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯১৭ – ১৯২০ তে প্রোটন আবিষ্কার করেছেন। ১৯২৬ এ ফোটনের কথা বলেছেন জি এন লুইস, আর তাকে আরো ভালো ভাবে চিনিয়েছেন আর্থার কম্পটন। সেটা ১৯২৮।
তত্ত্বগতভাবে পজিট্রনের কথা বলেছেন পল ডিরাক। সেটা ১৯২৮। আর ওই ১৯২৮ এই ফোটনের কথা বললেন আর্থার কম্পটন। নিউট্রন আবিষ্কার করেছেন জেমস শ্যাডউইক, ১৯৩২ এ।
এই সময়রেখাটা বিবেচনায় রাখলে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর আবিষ্কারটির গুরুত্ব যে অপরিসীম তা উপলব্ধি করা যায়। তাঁর সন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছে ১৯২৪ এর আগস্টে।
কোয়ান্টাম কথাটা আইনস্টাইন বুঝিয়েছিলেন।বসু আইনস্টাইনের অনুরাগী ছিলেন। জার্মান ভাষা শিক্ষা করে তিনি সতীর্থ মেঘনাদ সাহার সঙ্গে আইনস্টাইনের গবেষণাপত্র ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কোয়ান্টাম শব্দটির একটি আক্ষরিক অর্থ আছে। সেটি হল, ‘কতটা?’ ১৯০১ সালে বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক , ম্যাক্স কার্ল আর্নস্ট লুডউইগ প্ল্যাঙ্ক (২৩ এপ্রিল ১৮৫৮ – ৪ অক্টোবর ১৯৪৭) কোয়ান্টা শব্দ প্রয়োগে পদার্থ, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং তাপের কোয়ান্টা বুঝিয়েছেন। ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক উত্তপ্ত বস্তু থেকে কিভাবে বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে সেই নিয়ে গবেষণাকরছিলেন। তিনি আন্দাজ করেছিলেন, তাপ যখন শোষিত হয়, অথবা বিকীর্ণ হয়, তখন তা ছোট ছোট আলাদা আলাদা প্যাকেট হিসেবে চলে। এই ছোট ছোট প্যাকেটকে প্ল্যাঙ্ক বলেছিলেন এনার্জি এলিমেন্ট বা বাণ্ডিল। প্ল্যাঙ্ক আরো লক্ষ্য করেছিলেন কোনো কোনো বস্তুকে উত্তপ্ত করলে তার রঙের পরিবর্তন হয়। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটিতে পেশ করলেন। ওখানে তিনি কোয়ান্টা সম্পর্কে তাঁর ধারণাও পেশ করলেন। গবেষণার সূত্রে তিনি প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক এর মান নির্ধারণ করেছিলেন। প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক হল ফোটনের শক্তি এবং তার ফ্রিকোয়েন্সির সম্পর্কের মান। ফোটনের ফ্রিকোয়েন্সিকে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক দিয়ে গুণন করলে ফোটনের শক্তির মান পাওয়া যায়।
বিদ্যুৎ কণিকা বোঝাতে চেয়ে কোয়ান্টা কথাটা কাজে লাগিয়ে ছিলেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড ( ৭ জুন ১৮৬২ – ২০ মে ১৯৪৭)। সেটা ১৯০২। ১৯০৫ এ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের গবেষণালব্ধ তথ্য ও লেনার্ড ফিলিপ কৃত পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলি তলিয়ে দেখতে গিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বললেন, বিকিরণ বা রেডিয়েশন এক একটা ছোট ছোট প্যাকেটের মতো করে হয়। একেই তিনি বললেন আলোর কোয়ান্টা। জার্মান ভাষায় বৈজ্ঞানিক সন্দর্ভ লিখতেন আইনস্টাইন। আলোর কোয়ান্টা-কে তিনি বললেন লিখটকোয়ান্টা।
অ্যানালেন ডার ফিজিক এ ১৯০৫ তে পাঠানো অসাধারণ চার চারটি সন্দর্ভের প্রথমটিতে আইনস্টাইন এই আলোর কোয়ান্টা নিয়ে লিখলেন। যে নামটা দিলেন সেটা সরল বাংলা ভাষায় যেন আলোর উৎপত্তি ও পরিবর্তনের সূত্রে কিছু কথা। ইংরেজিতে “অন এ হিউরিস্টিক ভিউপয়েন্ট কনসার্নিং দি প্রোডাকশন অ্যাণ্ড ট্রান্সফরমেশন অফ লাইট”। সন্দর্ভটি তিনি পাঠিয়েছিলেন ১৯০৫ এর মার্চ মাসের আঠারো তারিখে আর তা বের হয়েছিল জুন মাসের নয় তারিখে।
১৯০৫ এ, যখন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্ল্যাঙ্কের শক্তি কোয়ান্টার ধারণার প্রেক্ষিতে বোলটজম্যান এর দেখানো স্ট্যাটিসটিকস বা সংখ্যায়ন প্রয়োগ করতে গেলেন, তখনই তাঁর মনে আলোককণা নিয়ে ধারণার উদ্ভব হয়। অনেক পরে ১৯২৬ নাগাদ একেই ফোটন বলা হল। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী লুডউইগ বোলটজম্যান ( ২০ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৪ – ৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৬) রাশিবিজ্ঞানভিত্তিক বলবিদ্যা গড়ে তুলে পরমাণুর নানাবিধ ধর্ম লক্ষ্য করা, বিশ্লেষণ করা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আর কী কী হতে পারে, সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দেবার পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন। এটা দেখাতে গিয়ে তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন যে পদার্থবিজ্ঞানে তাপগতিবিদ্যার সেকেন্ড ল মূলতঃ একটি রাশিবৈজ্ঞানিক বিষয়। আদর্শ গ্যাসের মধ্যে থাকা অণুগুলির মধ্যে শক্তি কিভাবে থাকবে তার রাশিবৈজ্ঞানিক বিবরণকেই ম্যাক্সওয়েল- বোলটজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন বলে। আদর্শ গ্যাসের মধ্যে অণুগুলি কেমন গতিবেগে ছুটবে, সে ব্যাপারে অনুমান আর সম্ভাবনাতাত্ত্বিক যুক্তিবিন্যাস করে একটি ভিত্তি খাড়া করেছিলেন স্কটিশ গণিত পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। সেটা ১৮৫৯। তাঁর তৈরি ধারণাকেই বহুবিধ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে সুবিন্যস্ত ও সুগ্রথিত করে তুলেছিলেন লুডউইগ বোলটজম্যান। দুই বরেণ্য বিজ্ঞানীর নাম মিলিয়ে আজ এটি ম্যাক্সওয়েল- বোলটজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন নামে সুপরিচিত।
কোয়ান্টা নিয়ে আইনস্টাইনের ধারণা প্রথমে বিজ্ঞানীসমাজের অনেকেই মেনে নেন নি। তখনকার ধারণা ছিল আলো তরঙ্গের আকারে চলে। অবশ্য ১৮৮৭ তেই মাইকেলসন-মর্লির পরীক্ষার মাধ্যমে ইথারের অস্তিত্ব নাকচ হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক ১৯২২ এ আমেরিকান বিজ্ঞানী আর্থার হলি কম্পটন (১০ সেপ্টেম্বর ১৮৯২ – ১৫ মার্চ ১৯৬২) মিসৌরি প্রদেশের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যাঙ্ক ধ্রুবক এবং এক্স রশ্মির কোয়ান্টা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ১৯২৩ এ আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির পত্রিকা ফিজিক্যাল রিভিউয়ে আর্থার কম্পটনের গবেষণা সন্দর্ভটি প্রকাশিত হয়।
সেখানে তিনি তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণের কণাধর্মিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। মনে রাখতে হবে তখনো কিন্তু ফোটন শব্দটি পরিচিত হয় নি।
কোয়ান্টা নিয়ে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের ধারণা প্রথম গড়ে উঠেছিল ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে আর তা গবেষণাপত্র আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০১ এ।
তার আড়াই দশক পরে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের কাছে প্ল্যাঙ্কের রেডিয়েশন বিষয়ক সূত্র পড়াতে গিয়ে একটু খটকা বোধ করলেন। প্ল্যাঙ্কের তত্ত্বের কিছু কিছু জায়গা তাঁর যুক্তিসংগত বলে মনে হল না। লুডউইগ বোলটজম্যানের দেওয়া ধ্রুপদী রাশিবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলেছিল প্রতিটি কণা একটি আরেকটির থেকে আলাদা করে চিনে নেওয়া সম্ভব। এটাতেও বসুর খটকা লেগেছিল। তিনি বোলটজম্যানের রাশিবৈজ্ঞানিক ধারণাকে একপাশে সরিয়ে রেখে একেবারেই নিজস্ব একটা রাশিবৈজ্ঞানিক ধারণা দিয়ে ব্যাপারটি সমাধান করলেন। বসু তাঁর নিজস্ব রাশিবৈজ্ঞানিক ধারণায় বললেন, কণাগুলি একটির থেকে আরেকটিকে আলাদা আলাদা করে চেনানো সম্ভব নয়। তিনি ছাত্রদের বিকিরণের তত্ত্ব ও আলট্রা ভায়োলেট ক্যাটাসট্রফি পড়াতে গিয়ে দেখালেন, সে সময়ে বৈজ্ঞানিক মহলে যে তত্ত্ব স্বীকৃত ও মান্যতাপ্রাপ্ত রয়েছে, তা বাস্তব ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। কেননা, এই তত্ত্বে যে ফলাফল আসবে বলা হয়, পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল তার থেকে ভিন্ন হয়।
এই যে ভিন্নতর ফলাফল, তার কারণ দর্শাতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের কাছে জানালেন, অতীব ক্ষুদ্র কণার ক্ষেত্রে ম্যাক্সওয়েল – বোলটজম্যান ডিস্ট্রিবিউশন খাটবে না। বসু আরো বললেন, অতি ক্ষুদ্র কণাগুলিকে সুনির্দিষ্ট অবস্থানে চেনানো সম্ভব নয়। তাদের ভরবেগ নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। অতি ক্ষুদ্র কণাগুলির সুনির্দিষ্ট অবস্থান এবং ভরবেগের প্রশ্নকে সরিয়ে রেখে বসু নিজের প্রয়োজনের উপযোগী করে একটি স্ট্যাটিসটিকস বা সংখ্যায়ন তৈরি করলেন, যেখানে তিনি দেখালেন কণাগুলিকে একটির থেকে অন্যটিকে পৃথক করে চেনানো যায় না।
বসু তাঁর এই নতুন উপলব্ধিটি সন্দর্ভ আকারে লিখে ফেললেন এবং সেটির নাম দিলেন প্ল্যাঙ্কের ল এবং আলোক কোয়ান্টা হাইপথিসিস। এরপর তিনি ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিন নামে একটি ব্রিটিশ বিজ্ঞান পত্রিকায় সন্দর্ভটি প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশ হয়ে থাকলেও পত্রিকার বিশেষজ্ঞরা তরুণ গবেষকের এই আশ্চর্য তত্ত্বের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝতে পারলেন না। ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে তাঁর সন্দর্ভটি প্রকাশ না হতে বসু উৎসাহ না হারিয়ে ১৯২৪ এর চার জুন তারিখে আইনস্টাইনের কাছে সেটি পাঠিয়ে দিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করলেন যাতে সেটি জেইটশ্রিফট ফর ফিজিক এ প্রকাশিত হয়। সন্দর্ভটি আইনস্টাইনের চেষ্টায় ওই পত্রিকায় ১৯২৪ এর আগস্টে প্রকাশিত হয়।
বসুর এই গবেষণাটিকে আইনস্টাইন অত্যন্ত যত্নসহকারে পাঠ করে এর অন্তর্বস্তুতে এক অসাধারণ ও গভীরতর সত্যের সন্ধান পেলেন। তিনি বসুর সন্দর্ভটি নিজের হাতে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেছেন এবং তত্ত্বটিকে বিকশিত করলেন।
আইনস্টাইন বসুর ধ্যান ধারণা আদর্শ কোয়ান্টাম গ্যাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেন। দেখা গেল, পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া বিহীন, পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে চেনানো যায় না এমন একদল অতিপারমাণবিক কণা রয়েছে যারা বসুর সংখ্যায়নকে মেনে চলে। এদের স্পিন হল ০, ১, ২ ইত্যাদি পূর্ণসংখ্যা। এই হল বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন গড়ে ওঠার ইতিহাস।
এছাড়াও বসুর গড়ে তোলা ধারণাকে অবলম্বন করে তিনি ও আইনস্টাইন পদার্থের নতুন একটি অবস্থার কথা ভাবলেন। সেই হল বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট এর ধারণা। সুপার কণ্ডাকটরের গড়ে ওঠার সূত্রে এই নতুন ধরনের কনডেনসেট এর বিপুল ভূমিকা রয়েছে। যেসব অতিপারমাণবিক কণা বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন মেনে চলে পল ডিরাক (১৯৯২ – ১৯৮৪) তাদেরকে বোসন নামে চেনালেন। সেটা ১৯৪৬ এর ডিসেম্বরে। ওই একই সময়ে তিনি ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলা কণাগুলিকে ফের্মিয়ন বলে চিনিয়েছিলেন।
বোসনেরা পাউলি এক্সক্লুশন নীতি অনুসরণ করে না, আর ফের্মিয়নগুলি ঠিক সেটাই করে। জগতের প্রতিটি অতিপারমাণবিক কণা হয় বোসন, নয় ফের্মিয়ন।
কণাপদার্থবিদ্যার জগতে যেসব কণাগুলি লেপটন বা কোয়ার্কের মতো জিনিস তৈরি করে, তাদেরকে ফের্মিয়ন বলে।
যে সমস্ত কণা ফের্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে, এবং তার সঙ্গে পাউলি এক্সক্লুশন প্রিন্সিপল মেনে চলে, তাদেরকে ফের্মিয়ন বলে। এই নামটিও ডিরাকের দেওয়া। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি, যিনি ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, এবং নিউক্লিয়ার যুগের স্থপতি হিসাবে পরিচিত, তাঁর স্মরণে প্রোটন নিউট্রন ইত্যাদি কম্পোজিট কণা, এবং ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো ইত্যাদি প্রাথমিক কণাকে ফের্মিয়ন বলা হয়।
লেপটন ছয় রকমের। ইলেকট্রন, ইলেকট্রো নিউট্রিনো, মিউঅন, মিউঅন নিউট্রিনো, তাউ, তাউ নিউট্রিনো। কোয়ার্ক হল এক ধরনের প্রাথমিক কণা, যা একসাথে জুড়ে হ্যাড্রন তৈরি করে। আর সেই হ্যাড্রন দিয়েই প্রোটন আর নিউট্রন তৈরি হয়।
কোয়ার্ক ছয় রকমের। আপ, ডাউন, স্ট্রেঞ্জ, চার্ম, বটম আর টপ। আর বোসন প্রধানতঃ পাঁচ রকম। তার দুটি গোষ্ঠী আছে, স্কেলার বোসন ও ভেক্টর বোসন।শূন্য স্পিন যুক্ত হিগস বোসন হল একটি স্কেলার বোসন। ভেক্টর বোসনেরা চারটি। এই চারটি বোসন ফোর্স বহন করে। অন্যবিধ কণায় এই ভেক্টর বোসনেরা ফোর্স তৈরি করে। এদেরকে গজ বোসনও বলা হয়। এরা হল ফোটন, গ্লুঅন, এবং ডব্লিউ ও জেড কণা। এর মধ্যে ফোটন তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের ফোর্স বহন করে। গ্লুঅন স্ট্রং ফোর্স বহন করে। জেড কণা এবং ডব্লিউ কণা দুটোই উইক ফোর্স বহন করে। তবে, জেড কণা হল তড়িৎ নিরপেক্ষ। ডব্লিউ কণাদের ম্যাগনেটিক মোমেন্ট আছে এবং তড়িৎ ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক দু ধরনের চার্জ আছে।
বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসি নামে পদার্থের যে অবস্থার কথাটা বলা হল, তার প্রায় সত্তর বছর পরে তাকে হাতে কলমে তৈরির পরিস্থিতি হল। বিইসি-তে প্রতিটি কণাই বহুসংখ্যক এক অভিন্ন কোয়ান্টাম অবস্থার কণার একটি সমাহার, একটি একীকৃত অস্তিত্ব। এর কণাগুলিকে একটির থেকে আরেকটিকে আলাদা করে দেখানো যায় না। ১৯৯৫ এর জুন মাসের পাঁচ তারিখে রুবিডিয়াম পরমাণুর গ্যাসকে পরম শূন্য তাপমাত্রা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় নিয়ে গিয়ে বিইসি তৈরি করা গেল। অত্যন্ত কম ঘনত্বে, পার্থিব বায়ুমণ্ডলের সাধারণ চাপের লক্ষভাগের একভাগ চাপে, পরম শূন্য তাপমাত্রা ছু়ঁই ছুঁই অবস্থায় প্রায় দুহাজার রুবিডিয়াম পরমাণু জোট বেঁধে একীভূত হয়ে একটি সুপার পরমাণুর চেহারা নিল। ওইভাবে তা রইল প্রায় কুড়ি সেকেন্ড সময়কাল।
রুবিডিয়াম গ্যাসের পরমাণুগুলিকে ১৭০ ন্যানো কেলভিন তাপমাত্রায় নিয়ে গিয়ে এই কাণ্ডটি যাঁরা ঘটালেন তাঁদের মধ্যে এরিক আলিন কর্নেল ( ১৯৬১ -) এবং কার্ল এডুইন উইয়েমান (১৯৫১ -) এর নাম করতে হয়। এর পরে পরেই উলফগ্যাং কেটারলে (১৯৫৭ -) সোডিয়ামের পরমাণুর উপর ওই কাণ্ড করলেন। তারপর থেকে আরো নানাভাবে বিইসি তৈরির সাধনায় ব্রতী রয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী সমাজ। লেসার রশ্মি দিয়ে পরমাণুকে শীতল করা, এবং তার বিকিরণের চাপে পরমাণুর গতিবেগ স্তিমিত করার কৌশল আবিষ্কার করেন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী ক্লদ কোহেন তাননৌদজি এবং আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী স্টিভেন চু ও উইলিয়াম ডি ফিলিপস ১৯৯৭ তে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কর্নেল, উইয়েমান এবং কেটারলে বিইসি তৈরির সাধনার স্বীকৃতিতে ২০০১ এ পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
বলা দরকার, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সন্দর্ভ ১৯২৪ এর আগস্টে প্রকাশের পর ১৯২৫ এ উলফগ্যাং পাউলির এক্সক্লুশন নীতি প্রকাশ হয়। আর ইতালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মি ( ২৯ সেপ্টেম্বর ১৯০১ – ২৮ নভেম্বর ১৯৫৪) পাউলি-র নীতির ভিত্তিতে আদর্শ গ্যাসের অতিপারমাণবিক কণার জন্য ভিন্নতর একটি সংখ্যায়ন প্রকাশ করেন। সেটা ১৯২৬। এই একই সময়ে পল ডিরাক এই একই বিষয় নিয়ে র্যালফ ফাউলারের অধীনে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করে থিসিস তৈরি করেছেন। ফের্মি এবং ডিরাক নিজের নিজের মতো করে কাজ করলেও তাঁদের সাধনাকে ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন বা এফ ডি স্ট্যাটিসটিকস বলা হয়। যে সমস্ত অতিপারমাণবিক কণার স্পিন পূর্ণ সংখ্যা নয়, সেগুলি এই সংখ্যায়ন মেনে চলে। বিশেষ করে ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন সাধারণভাবে প্রযুক্ত হয়।
এরিক কর্নেল, কার্ল উইয়েমান ও উলফগ্যাং কেটারলে বোসন কণা থেকে বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করা নিয়ে গবেষণায় সাফল্যলাভ করে ২০০১ এ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল সম্মান পেলে তা ডেবোরা জিন, রুডলফ গ্রিম প্রমুখকে ফের্মিয়ন কণা নিয়েও কোনো ধরনের কনডেনসেট বানানো যায় কিনা, সেই সাধনায় ব্রতী হতে অনুপ্রাণিত করল।
কিন্তু ফের্মিয়ন কণাগুলি বোসনকণার থেকে একেবারেই ভিন্নধর্মী। ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন মেনে চলা অতিপারমাণবিক কণাগুলির বৈশিষ্ট্য হল যে দুটো আলাদা কণা কিছুতেই একসাথে চলতে চায় না। ডেবোরা শিউ-লান জিন (১৯৬৮ – ২০১৬) এর নেতৃত্বে ২০০৩ এর ডিসেম্বরে ফের্মিয়ন কণাকে বোসনের চরিত্র দিয়ে কনডেনসেট তৈরির চেষ্টা হল। পটাশিয়াম ৪০ এর পরমাণু ব্যবহার করে সেই কাজ হল।
এত কিছুর পিছনে রইল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অসাধারণ চিন্তা।