সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২২)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

অতীতের মহান ও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলি পুঁজিবাদী শোষণেরর কারণে সর্বমানবের, সামগ্রিক মানবসমাজের পক্ষে কল‍্যাণকর না হয়ে অভিশাপ হয়ে উঠেছে। সমাজতান্ত্রিক পরিবেশে গ্রীক কবি দার্শনিক অ্যান্টিপোরাসের ভবিষ্যৎবাণী সার্থক হয়ে উঠবে। প্রথম যখন জলচক্র তৈরি হল, জলের স্রোতের ঠেলায় চাকা ঘুরে শক্তির যোগান দিল, তাই দেখে কবি অ্যান্টিপোরাস বলেছিলেন এই জলচক্রের ভিতর আমি নারী ও পুরুষ ক্রীতদাসদের মুক্তিপথের দিশা দেখতে পাচ্ছি।
 গ্রীক দার্শনিক আরিস্ততল তাঁর অসামান্য দূরদর্শিতায় বলেছিলেন, ভবিষ‍্যতে আসবে সেই যুগ, যখন মুখে আদেশ দিলেই যন্ত্রপাতি কাজ করতে থাকবে, অথবা এমনভাবেই তাদের কলকব্জা তৈরি হবে, যাতে করে আগে থেকেই বেঁধে দেওয়া নিয়ম কৌশলে তারা কাজ করে চলবে। দাদ‍্যালুসের শিল্পবস্তুগুলি যেমনটি করে নিজেদের মতো করে কাজ করে চলত, অথবা হেফায়েসতাসের তিনটি পা যেমন করে ভিতরকার নির্দেশে তাদের কর্তব‍্য কর্ম পালনে চলে গিয়েছিল, সেভাবেই তাঁতযন্ত্রের মাকু স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করবে, সেদিন আর মানবসমাজে প্রভু ভৃত‍্যের সম্পর্কের দরকার হবে না। ক্রীতদাসদের রেহাই দিয়ে শ্রমসাধ্য কাজ নিজের কাঁধে তুলে নেবে যন্ত্র।
সমাজতন্ত্র বলছে যে, আরিস্ততল ও অ্যান্টিপোরাস যে সময়ের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, মালিকী শোষণ ও মজুরিদাসত্বের যে অবসানের ইঙ্গিত করেছিলেন, সেই সময়টা এসে গিয়েছে। আপনারা কি এই সত‍্যটা অস্বীকার করতে পারেন?
আপনারা হয়তো বলবেন, ‘আরে, অতীতের এই পাষণ্ড বর্বর মহামূর্খগুলো কীই বা জানত? কতটুকুই বা জানত যে এসব বলে গেছে!’ সত‍্যিই তো! আরিস্ততল ও অ্যান্টিপোরাসের মতো মনীষীরা তো পলিটিক্যাল ইকনমির কিছুই জানতেন না : তাঁরা খ্রিস্টরাজ‍্যের‌ও কিছুই জানতেন না। তাঁরা ধারণাতেই আনতে পারেন নি যে যেসব মেশিনের তরফে মানুষকে কাজের বোঝা থেকে মুক্তি দেবার কথা ছিল, সেগুলো খাটিয়েই যে শ্রমিককে আরো অনেক বেশি সময় ধরে খাটানো যাবে, মজুরের উপরে লাগামকে আরো কঠোর আরো ঘনবদ্ধ করে দেবে। অ্যান্টিপোরাস, বা আরিস্ততলের মতো অখ্রিস্টীয় পাষণ্ডরা ভেবেছিলেন ক্রীতদাসত্বের‌ও বুঝি কোনো সদর্থক দিক আছে, ভেবেছিলেন যে একজনকে ক্রীতদাসের জীবনে রেখে আরেকজন হয়ত মানবিক উন্নয়নের সুযোগ পাবে। কিন্তু  লক্ষ হাজার সাধারণ মানুষকে দাসশ্রমিক বানিয়ে হাতে গোণা কয়েকটা গুণ্ডা মস্তান “বিশিষ্ট শিল্পপতি”, “বিশিষ্ট ব‍্যবসায়ী”, “বিশিষ্ট গুদাম মালিক”, “প্রভাবশালী জুতোর কালি নির্মাতা” বনবেন, আর খ্রিস্টীয় সাংগঠনিক যন্ত্রের তরফে তাঁদের মহান বলে পরিচিত করা হবে, তাঁদের সাবাসি দেওয়া হবে; এ জিনিস অ্যান্টিপোরাস, বা আরিস্ততলের মতো অখ্রিস্টীয় চিন্তানায়কেরা ভেবে উঠতেই পারেন নি।
 সমাজতন্ত্র আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, মেশিন, মাল ও যাত্রী পরিবহনের গাড়ি, যোগাযোগ ব‍্যবস্থার যন্ত্রাদি, এ সক‌ল‌ই সমাজের সামগ্রিক প্রচেষ্টার ফসল। এ শুধুমাত্র আজকের সমাজের‌ই নয়, এর মধ‍্যে অতীতের সামাজিক প্রচেষ্টাও মিশে রয়েছে। তাই, মেশিন, পরিবহনের সরঞ্জাম, যোগাযোগের আয়োজন, সকল‌ই ন‍্যায়তঃ সমাজের সকলের যৌথ সম্পত্তি। কাউকে এইসবের সুফল থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। মৃত্তিকা, এবং আলো বাতাস, জলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ পদার্থ এবং অন‍্যান‍্য সকল প্রাকৃতিক সম্পদ আসলে প্রকৃতির দেওয়া উপহার, আর সমাজতন্ত্র এই শিক্ষা দেয় যে, যারা মালিক সেজে, পুঁজিপতি সেজে এই সামাজিক প্রাকৃতিক সম্পদকে কুক্ষিগত করেছে, তা অন‍্যায়, যত‌ই আইনের যুক্তি তুলে ওদের কাজকে আইনসংগত বলা হোক না কেন, তা ন‍্যায়সংগত নয়। সমাজ পুঁজিমালিকদের কুক্ষিগত হয়ে পড়া এই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার পুনরুদ্ধার করবে।
একচেটিয়া পুঁজিমালিকরা জনসাধারণকে সাংঘাতিক ভাবে শোষণ করছে, আর এই শোষণটা এমনি লাগামছাড়া পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে, এখন পুঁজি মালিকদের হাত থেকে দেশ ও দশের বাঁচার স্বার্থে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা জরুরি। ন‌ইলে সমাজের স্থিতি বিপন্ন হচ্ছে। আর আপনারা এও শুনে রাখুন, সমাজ নিজেই এই কাজটা করে নেবে। যত‌ই নিপীড়ন আসুক না কেন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে যত‌ই আপনারা ফাঁসির মঞ্চ খাড়া করে দিন না কেন, সমাজ তার হিসেব পাক্কা বুঝে নেবে। আর নৈরাজ‍্যবাদ, এই সাংঘাতিক একটা “বাদ” বলে যে, সমাজে যখন কোঅপারেটিভ অর্থাৎ সহযোগিতামূলক ও সহভাগিতামূলক সংগঠন গড়ে উঠবে, যখন অর্থনৈতিক প্রশ্নে সাম‍্য প্রতিষ্ঠিত হবে, ব‍্যক্তিমানুষের যথার্থ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তখন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্র আদিম অতীত কালের বিষয় হয়ে যাবে। তখন সকলেই স্বাধীন হবেন, তখন প্রভু বলে আর কেউ থাকবে না, কাউকে দাস হতেও হবে না। তখন আর বুদ্ধিমান মাথাগুলোকে দিয়ে শোষণ শাসনের রাষ্ট্রযন্ত্রটা আর চালাতে হবে না। তখন আর লাঠি গুলি বন্দুক বাগিয়ে পুলিশ আর মিলিটারি লেলিয়ে দিয়ে তথাকথিত “শান্তি শৃঙ্খলা” রক্ষা করতে হবে না। রাশিয়ার মিলিটারি জেনারেল পোল‍্যাণ্ডের বনেদী ওয়ারশ শহরের অর্ধেকটাকে গুঁড়িয়ে, থেঁতলে, পিণ্ডি পাকিয়ে, জারকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছিলেন, ওয়ারশতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
নৈরাজ‍্যবাদ মানে মানুষের রক্ত ঝরানো নয়। নৈরাজ‍্যবাদ মানে লুঠপাট, রাহাজানি, ডাকাতি নয়। সত‍্যি বলতে কি এইসব দানবিক আচরণগুলি আসলে একেবারেই পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য।
 নৈরাজ‍্যবাদ মানে সকলের জন্য শান্তি ও স্বস্তি। নৈরাজ‍্যবাদ বা সমাজতন্ত্র মানে বৈজ্ঞানিক নীতি ও মূল‍্যবোধের আধারে সমাজব‍্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, আর যে সমস্ত কারণে সমাজে অন‍্যায় ও অপরাধ সংগঠিত হয়, সেই কারণগুলির মূলোচ্ছেদ।
 পুঁজিবাদী শাসনে যেটা হয়, তা হল, প্রথমে এইসব সামাজিক ব‍্যাধি তৈরি হবার পরিবেশ গড়ে তোলা হয়, তারপর রোগের প্রকোপ ঘটলে শাস্তি দেবার পথে তার নিষ্পত্তি হয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।