আমাদের শৈশবে জোরে জোরে কবিতা পড়ার চল ছিল। পাঠ্য ভাষাসাহিত্যের পুরো বইটি নতুন ক্লাসে উঠে হাতে পাওয়া মাত্র পড়ে ফেলতাম। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘দেখব এবার জগৎটাকে’। পুরো কবিতাটা কণ্ঠস্থ ছিল। বেশ মনে পড়ছে, ‘তুহিন মেরু পার হয়ে যায় সন্ধানীরা কিসের আশায়?/ হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে/ শুনব আমি ইঙ্গিত কোন্ মঙ্গল হতে আসছে উড়ে..
আমার চোখের সামনে কত বড় বড় বীর… সবচেয়ে বড় নেতাজি সুভাষ, সাবমেরিন নিয়ে টর্পেডোসঙ্কুল সমুদ্রের তলা দিয়ে জাপানে গেলেন। আর আমুন্ডসেন, কাপ্তেন স্কট, ডেভিড লিভিংস্টোন। ক্যাপটেন নিমো সমুদ্রের তলা দিয়ে নটিলাস চালাতেন। পড়তাম অ্যারাউণ্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ। আর ফ্রম দ্য আর্থ টু দি মুন। জুলে ভার্ন এর বিখ্যাত দুটি বই। এ বই দুটি আমাদের জন্মের একশো বছর আগে বেরিয়েছে। আমরা বাংলা অনুবাদে সে বই হাতে নিয়েছি। এইসব অসাধারণ বীরদের একজন ছিলেন ইউরি আলেক্সেয়েভিচ গ্যাগারিন। আমার জন্মের বছর ছয়েক আগে, ১৯৬১ সালে আজকের দিনে এই রকম বারো এপ্রিল তারিখে তিনি শূন্যমহলে পাক খেয়েছিলেন।
১৯৩৪ সালে, মার্চ মাসের নয় তারিখে জন্ম তাঁর। বাবার থেকে মোটে বছর পাঁচেকের বড়। আর সতেরোই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮তে বিমান দুর্ঘটনায় পড়লেন। কয়েক সপ্তাহ পরে সাতাশ মার্চ চিরযাত্রা। মাত্র চৌত্রিশটি বছরের জীবন। তবু যেন চিরযৌবনের প্রতীক। আমাদের নেতাজি বা স্বামীজির মতোই।
এপ্রিল মাস এলে রাশিয়ার মানুষ গ্যাগারিনকে মনে করে। মানুষ মনে রেখেছে দেখে প্রশাসন গ্যাগারিনের অকস্মাৎ মৃত্যু নিয়ে তদন্ত কমিশন গড়ে। গোপনীয়তা ঢাকা মৃত্যু বীরের।
সুকুমার ছেলেটির কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুপে বালিকার সহপাঠী খেলার সাথি সুকুমারের কথা বলছি। সে প্লেন চালাতে গিয়ে সত্যলোকে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটা দাদামশায় পুপের কাছে কিভাবে পৌঁছান বুক ধুকপুকিয়ে দেখি।
মহাশূন্য যে মাটি থেকে খুব বেশি উঁচুতে, তা কিন্তু নয়। মাটি থেকে একশো কিলোমিটার উঁচুতে কারমান লাইন। সেটা পেরোলে মহাশূন্যের শুরু। পৃথিবী তার চারপাশের সবকিছুকে প্রবল আকর্ষণে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানছে। সেই টান ছাড়িয়ে তবে যেতে হয় মহাশূন্যে। জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই। ওই ছাড়িয়ে যেতে গেলে যে বেগটা লাগে, ওকে বলে এসকেপ ভেলোসিটি। ঘণ্টাপিছু চল্লিশ হাজার দুশো সত্তর কিলোমিটার এর বেশি বেগে দৌড়তে পারলে তবে সে পৃথিবীর টান ছাড়িয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দিতে পারবে। সেকেন্ডে হিসাব দাঁড়াবে ১১.২ কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই।
কিন্তু ওই সাংঘাতিক বেগ সহ্য করা কঠিন। আর পৃথিবীর জীবের পক্ষে অভিকর্ষহীনতাও এক দুরূহ অভিজ্ঞতা বৈকি! মহাশূন্যে বাতাসের অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীতে আমরা বাতাসের চাদর জড়িয়ে আছি বলে বিপজ্জনক মহাজাগতিক রশ্মি ও বিকিরণ আমাদের বেশি কাবু করতে পারে না। মহাশূন্যে সেই রক্ষাকবচ নেই। তাই মহাশূন্যে পাড়ি সবসময়ই এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার।
প্রথমে গিয়েছিল লাইকা। রাস্তার একটা মেয়ে কুকুর। তারপর দুটো বানর। তারপর মানুষ কে পাঠিয়ে আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা। তবে তলে তলে এ সবই যুদ্ধ শিল্পের কারবার। গ্যাগারিন ও সেনাবাহিনীর কর্মী ছিলেন।
গরিব বাড়ির ছেলে, লোহা মিস্তিরি ছিলেন, বনে গেলেন কসমোনট বা নভশ্চর। পিছনে হিসেবীরা অঙ্ক কষে মহাকাশ কতদূর দখল করলাম। কবি হা হুতাশ করেন, আকাশ আছিল বাকি। মহাকাশে সেনাবাহিনীর দখলদারির প্ল্যান প্রোগ্রাম রবীন্দ্রনাথ কত আগেই টের পেয়েছিলেন!