সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩০)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

আমরা যদি বাস্তব সংখ্যাটা হাতে পেতাম তাহলে আমি বিশ্বাস করি হাজার হাজার চ্যাটেল দাসশ্রমিক মালিকের কাছে তাদের বন্দীদশা ছিন্ন করে পালিয়েছে, মালিকেরা ডালকুত্তা নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করছে। কানাডার তুষার ছড়ানো পাথরের উপর দিয়ে, কখনো আঙুর ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে লুকিয়ে, কত ভাবেই না চ্যাটেল শ্রমিকরা পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আর আজও পু়ঁজিবাদের তথাকথিত স্বাধীনতার সুখ থেকে মজুর শ্রমিক পালিয়ে ব়াঁচতে চাইছে। আমি একজন সমাজতন্ত্রী। আমিও তাদেরই একজন। আমি নিজেও একজন মজু্র শ্রমিক এবং আমার প্রতিবেশীরা বলেন –  আমি কেন মজুর শ্রমিকের জীবন বেছে নিলাম? ইচ্ছে করলেই নাকি আমি মজুরি দাসত্ব ছেড়ে মালিকশ্রেণীর একজন হয়ে যেতে পারি। আর মালিক হয়ে যাবার পর আমার অধীনে একদল দাস থাকবে। কিন্তু আমি মালিকের জীবন চাই নি। আবার আমি দাস হতেও চাই নি। আমি অন্য কোনো পথ বেছে নিলে আমি চিকাগোর সেরা রাস্তায় চমৎকার একটা বাড়িতে থাকতে পারতাম। সেই বাড়িতে আমার চারপাশে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ ছড়ানো থাকত। আমার তর্জনী সংকেতে চাকর বাকরেরা ছুটে আসত। কিন্তু আমি অন্য রাস্তা জীবনের চলার পথ হিসাবে বেছে নিতে চেয়েছি। আর সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার পরিবর্তে আপনাদের এখানে ফাঁসিতে ঝোলবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই ভিন্ন পথে চলতে যাওয়াই আমার অপরাধ। আপনাকে আমি বিনীতভাবে জানাচ্ছি শ্রমিকের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছি, এই আমার একমাত্র অপরাধ। বড়লোক সমাজের কাছে আমি একজন মিথ্যাবাদী। তাদের চোখে আমার না কি সত্যের ধারপাশ মাড়ানোর অভ্যাস নেই। তাদের চোখে আমি একজন বিশ্বাসঘাতক নোংরা লোক। আপনার মতে শ্রমিকমুক্তির চেষ্টা করা যদি অপরাধ হয়, তবে আমি নতমস্তকে সেই অপরাধ স্বীকার করছি। এবার আমার একটা কথা ধৈর্য ধরে শুনুন, আমি আপনার এই বিচার দিনের পর দিন বহু ধৈর্য ধরে শুনেছি। আমার সাথে চলুন, দেখবেন, কলে কারখানায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কী অসহনীয় অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে মজুরকে রোজ রোজ ঠেলে দিচ্ছে। আমার সাথী আমার সহযোদ্ধা স্যামুয়েল ফিলডেন আজ সকালেই বলেছেন – যখনই একটা নতুন মেশিন কারখানায় আনানো হয় তখনই যেন মজুর শ্রমিকের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী এসে উপস্থিত হয়। পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিটি মেশিন কলে কারখানায় মজুর শ্রমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে হাজির হয়। আর যারা রুটি রুজির দায়ে কারখানায় কাজ করে, তাদের জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে দেয় । মানুষগুলো মেশিন আসার ফলে কাজ হারাতে থাকে। কাজের পরিবেশটা আমূল বদলে যায়। মজুর শ্রমিক তার কাজ হারায়। যে কাজটা শ্রমিকের করতে একটা গোটা দিন লাগত, মেশিন সেই কাজটা এক ঘণ্টায় উৎরে দেয়। এই জিনিসটা কতটা সত্য তা আমি নিজের জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। যদিও আমার বয়স এখনো বেশি হয়নি তবু আমি বুঝতে পারছি মেশিনের আবিষ্কারের ফলে মানুষের পেশাগুলো হারিয়ে যাবে। মেশিন সব কাজ মজুরের হাত থেকে কেড়ে নেবে । তাহলে এই লোকগুলোর কী হবে? মজুরেরা দাঁড়াবে কোথায়? তখন তারা একজন মজুর অন্য মজুরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে পড়ে ক্রমেই নিজেদের মজুরি কমাবে আর তার সঙ্গে কাজের ঘণ্টা বাড়িয়ে ফেলবে। তাদের অনেককেই অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে আপনার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেবেন। নয়তো জেলখানায় তাদের জন্য আপনাদের আরো জেলখানা বানাতে হবে। আরো আরো ফাঁসিকাঠ খাড়া করতে হবে। কেননা হাতে কাজ না পাওয়া, কাজ করেও ন্যায্য মজুরি না পেয়ে আনন্দহীন দৈন্যদশার মধ্যে থাকতে থাকতে তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। আর এইভাবে দৈন্যদশা ও মৃত্যুর মিছিলে সামিল হবে। ইওর অনার, কারণ ছাড়া কার্য হয় না। আর গাছ তোমার কিসে পরিচয়? না , ফলে। ফলেন পরিচীয়তে।  সমাজতন্ত্রীরা এমন জাতের মানুষ নয় যারা ইচ্ছে করে নিজেদের চোখে ঠুলি পরে আছে। দেখতে চায় না, কানে কিছু শুনতেও চায় না। বরং নিজেদের চক্ষু কর্ণ ইত্যাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোকে তারা পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগাতে চায় । একবার এই পু়জিবাদী ব্যবস্থার দিকে তাকান। পু়ঁজিবাদী ব্যবস্থা ছোট ছোট ব্যবসাদার,  ছোট ছোট কারবারি আর মধ্যবিত্তকেও ছাড় দিচ্ছে না। তাদেরকেও শুষে নিচ্ছে। ব্র্যাড স্ট্রিটের গত বছরের রিপোর্ট দেখুন। গত বারো মাসে এগারো হাজার ছোট ছোট ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে । এদের কী হবে? এই যে যারা মুছে যাচ্ছে, তারা কোথায় গেল ? তাদের সম্পত্তিগুলো কী উবে গেল? তা তো নয়। সেগুলো চলে গেল কাদের ঘরে ? না, সম্পত্তিগুলো তারা দখল করল, যাদের আরো বেশি বেশি পুঁজিবাদী সুবিধা রয়েছে। এরাই হল একচেটিয়া পুঁজিপতি। এরাই সবাইকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ফাঁদে ফেলছে ফাঁস পরাচ্ছে। তারপর গলা টিপে নিংড়ে নিচ্ছে। আর এইভাবে ঝরা পাতা যেমন ঝাঁট দিয়ে ঝুড়িতে ভরে, তেমনি ভাবে একচেটিয়া পুঁজি সমাজের নীচের তলার লোকগুলোকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। মধ্যবিত্তরা নিঃস্ব হয়ে সর্বহারার স্তরে নেমে যাচ্ছে । এই মধ্যবিত্তরা কী করছে ? না, তারা কারখানার ফটকে গিয়ে কাজ ভিক্ষা করছে। নয়ত দিন যাপনের জন্য অন্য কোনো রকম মজুর শ্রমিকের পেশা বেছে নিচ্ছে। তাহলে ফল কী দাঁড়ালো? কর্মপ্রার্থী লোকের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে গেল। তারপর কী হল? মজুরির জগতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র ও তীক্ষ্ম হয়ে উঠল। আর এটাই একচেটিয়া পুঁজিকে দিন দিন আরো ফাঁপিয়ে তুলছে। এর ফলে মজুরির হার তলানিতে ঠেকেছে। যখন আর মজুরির টাকায় দু মুঠো পেটে দেবার সংস্থান হচ্ছে না। তারপর কী হচ্ছে? এই সময় সমাজতন্ত্র মানুষের চিন্তা ভাবনার দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে আর বলছে সমাজটার কেন এ দশা হল তার কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করো। আরো খোঁজো, আরো দেখো। যাচাই করো। আর এই সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মধ্য দিয়ে সমাজের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হিংসা এড়ানো সম্ভব হবে। আমার বন্ধু স্যামুয়েল ফিলডন আপনার এই আদালতে বলেছেন – অজ্ঞ, অশিক্ষিত জনগণ জানে না কে তার দৈন্যদশার জন্য দায়ী, কে তার অন্ন প্রতিদিন কেড়ে নিয়ে তাকে ভিখারী বানাচ্ছে। আর সেই অজ্ঞতা থেকে অন্ধ রাগে তারা কোনো কিছু না ভাবনা চিন্তা করেই দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধিয়ে বসবে। যে মেশিন শ্রমিকের কাজ কেড়ে নেয়, ম্যাক্সওয়েলের কারখানার ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে তারা মেশিন ভাঙতে উদ্যত হবে। আপনারা ভেবে দেখুন পুঁজিপতিরা তাদের কাগজকে দিয়ে রোজ রোজ লেখাচ্ছে যে আমরা সমাজতন্ত্রীরা নাকি দাঙ্গা হাঙ্গামা পাকাচ্ছি। তারা বলছে আমরা সমাজতন্ত্রীরা প্রযুক্তি ব্যবহারের ও যন্ত্রের সাহায্যে উৎপাদনের নাকি বিরোধী। তারা আরো রটাচ্ছে যে আমরা নাকি সম্পত্তির অধিকারের বিরোধী । তাদের এই কথাগুলো একেবারেই অবান্তর, মনগড়া আর হাস্যকর। কোনো সমাজতন্ত্রী ব্যক্তিত্ব এমন উদ্ভট কথা উচ্চারণ করতেই পারে না । আসলে সমাজতন্ত্রীদের ভাবনাটা যা রটানো হয় ঠিক তার বিপরীত। আমরা যন্ত্র ভাঙার উসকানি তো দিইই না, আমরা কলে কারখানায় উৎপাদনের উন্নতি করতে যন্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধেও নই । তাহলে আমাদের আপত্তিটা কোন্ খানে ? না, আমরা চাইছি যে ভঙ্গিতে ও যে পদ্ধতিতে কলে কারখানায় যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে, আমরা সেই রীতি পদ্ধতির বিরুদ্ধে। আমরা চাইছি প্রকৃতির সমস্ত শক্তি, সামাজিক, সমস্ত শক্তি এবং সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত মানুষী শ্রম ও মানব মনীষার প্রযত্নে যে বিপুল শক্তি ও সামর্থ্য তৈরী হয়েছে তা সর্বমানবের কল্যাণসাধনে উৎসর্গীকৃত হোক। যন্ত্র থাকুক, কিন্তু সে থাকুক মানুষের আজ্ঞাবহ হয়ে। যন্ত্র যেন মানুষের স্বার্থে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীনে থেকে কাজ করে চলে। এই হল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য । সমাজতন্ত্র কাউকে কিছু পরিত্যাগ করতে বলে না, কাউকে কোনোভাবে বঞ্চিত করে না। কারো থেকে কোনো কিছু কেড়ে নেয় না। কিন্তু যখন আমরা দেখি মানুষ বড় কাঁদছে, যখন আমরা দেখি কচি কচি দুধের শিশু কারখানার ফটকে ভিক্ষা করছে, যখন আমরা দেখি ধনী ঘরের মূল‍্যবান আসবাবপত্র তৈরির জন্য কলে কারখানায় শিশুকে খাটানো হচ্ছে, যে শিশুর মা বাবার কোলে আদরে ভালোবাসায় নিরাপদে থাকার কথা, সেই শৈশব কারখানার পরিবেশে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হচ্ছে, তখন আমরা আর শান্ত ভালো মানুষটি হয়ে হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে পারি না। আমরা প্রতিবাদে মুখর হই। আমরা শিশুদের সুরক্ষার দাবিতে কথা বলি। আমরা অসহায় শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে কথা বলি। আমরা নিপীড়িত অত্যাচারিতদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করি। আমরা অজ্ঞ মানুষের জন্য জ্ঞান এবং বুদ্ধিদীপ্তি দাবি করি। আমরা দাস শ্রমিকের মুক্তি দাবি করি। সমাজতন্ত্র সর্বমানবের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে সক্রিয় থাকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।