সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৮)

আমার কথা

১০৯

খুব সম্প্রতি নতুন করে উগ্র হিন্দুয়ানি আমার দেশে মাথা চাড়া দিল । এমন নয় যে আগে কখনো “হিন্দু জাগো” ধ্বনি ওঠে নি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে মারাত্মক গাফিলতি ছিল । দেশ জিনিসটা কি – সেটা বুঝতেই আমাদের যথেষ্ট সময় লেগেছে । তাই দেশের মুক্তি “সাধারণের মুক্তি” হয়ে সেভাবে দেখা দেয় নি। গান্ধীজী চেয়েছিলেন আচারে ব্যবহারে সাধারণ মানুষের মতো করে থাকতে। তিনি যে পোশাকে যেভাবে থাকতেন, তা তাঁর মতো ব্যারিস্টারের পক্ষে অসম্ভবের কোঠায় পড়ে। তবু তিনি তা করেছেন, আর সেই ইমেজেই সাধারণের কাছে ধরাছোঁয়ার মধ্যে এসেছেন । সুভাষচন্দ্র এমনি এমনি গান্ধীর নামে ব্রিগেড করেন নি। স্বাধীনতার ধারণাকে আমজনতার কাছে নিয়ে যেতে পারার ক্রেডিটটা গান্ধীর । কোনোভাবে এটা অস্বীকার করা যায় না। সেই বাপুজীকে প্রাণ দিতে হল আততায়ীর হাতে। সেই আততায়ী উগ্র হিন্দুয়ানির সন্তান। উগ্রতা পালটা উগ্রতার জন্ম দেয় । দুইয়ের ভেতর কাজ করে মৌলবাদ । দুই পশ্চাদপদ রক্ষণশীল, নারীবিরোধী, প্রগতিবিমুখ ধর্মীয় উগ্রবাদ আমাদের দেশের মজুরের কৃষকের মাথা তোলার লড়াইটাকে পিছিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদ নিয়ে দেশ গড়ার বদলে; মন্দির মসজিদ নিয়ে দাউ দাউ দাঙ্গা বাধলে কার লাভ – আমরা বুঝতে চাই নি। চাষি জোলা দিনের পর দিন কোণ ঠাসা হয়ে গিয়েছে। চাষি বউ ধাবার আড়ালে ট্রাক ড্রাইভারের কাছে শরীর বেচছে – আর নারকেল ফাটিয়ে রকেট উঠেছে । এর নাম উন্নতি? দেশের আসল মানুষ ওই চাষি জোলা মজুর। ওরা বিষ তেল খেয়ে মরতে বাধ্য হলে – তেমন উন্নতিকে দেশের উন্নতি বলে না। রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখের পরিবারের সমৃদ্ধি না এলে – তেমন উন্নয়নকে আমি পাত্তা দিই না। দেশের উন্নতি মানে আমি বিশ্বাস করি রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখের উন্নতি । বঙ্কিমচন্দ্র এটাই ধরাতে চেয়েছিলেন। দেশ বলতে ওই রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখের স্বার্থ রক্ষার কথা বলেছেন। এক নিঃশ্বাসে গরিব হিন্দু আর গরিব মুসলমানকে চিনিয়েছেন। আমরা বুঝতে চাইনি । আমরা স্বাধীনতা অর্জনের পরে পরেই ভ্রাতৃ ঘাতী দাঙ্গায় মেতেছি । এখন আবার উগ্র হিন্দুয়ানি মাথা তুলে দাঙ্গা বাধাতে চাইছে। আমরা কি মাথা নুইয়ে মেনে নেব? ,

১১০

হিটলার, এই নামটা বললেই কেমন গা শিউরে ওঠে
কিভাবে একজন সামান্য সৈনিক দেশের সকলের মাথা গুলিয়ে হিটলারি কায়েম করে
কিভাবে আর্য অনার্য তত্ত্ব খাড়া করে বিস্তর মানুষের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেয়
এক চূড়ান্ত অমানুষিক ব্যবস্থা কায়েম করে
হিটলার সেই সাংঘাতিক অমানবিকতার প্রতীক
জার্মানিতে হিটলার কেমন করে অমন দানবিক চেহারা নিতে পেরেছিলেন সেটা ভেবে দেখা দরকার। জার্মান জাতটাতো ছোটো নয়। তার কত কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক দার্শনিক – সে কথা তো ভুলতে পারবো না। ভালো মনের বেশ কিছু লোককে দেশ থেকে তাড়িয়ে আর বিস্তর লোকের মাথা গুলিয়ে দিয়ে তিনি ফুয়েরার হয়ে উঠলেন। কিন্তু একটা গোটা দেশের চিন্তা ভাবনা একটা লোকের কথায় যে পালটে গেল তার বাস্তব ভিত্তিটার দিকে তাকাবো না? হিটলারের উত্থানের দিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে তাকালে টের পাই কি করে হিটলার হয়ে ওঠে …

১১১

স্বাধীনতার পরে আমাদের দেশের কিছুমাত্র উন্নতি হয় নি তা তো নয় । আমরা রকেট তুলেছি । উপগ্রহ আকাশে তুলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ভোট হচ্ছে ই ভি এম যন্ত্রে । কিন্তু সেই সাথে এক নিঃশ্বাসে বলতে হবে – এখনো মায়েদের প্রসবের জন্যে হাসপাতালে টেনে আনতে বিস্তর মগজ খাটাতে হয়। বাল্য বিবাহ রুখতে বাড়ি গিয়ে মেয়ের গোঁ ধরা বাপ কাকা চাচা নানাকে বোঝাতে হয়। ডাইনী হত্যা হচ্ছে। আর খাবারে ভেজাল , দুধ পেতে অক্সিটোসিন হরমোনের কুৎসিত প্রয়োগ , সবজিতে রঙ , এমন কি সরকারি উদ্যোগে বিদেশ থেকে বর্জ্য কিনে আনা !
বলতে হবে গরুর মাংস খাওয়া যাবে কি না সে নিয়ে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটছে । অর্থনীতির বিন্দু বিসর্গ না বিচার করে বিপজ্জনক সংস্থায় টাকা জমাচ্ছেন অনেকে । আমাদের কিছু উন্নতি হয় নি, এটা বলা যেমন ঠিক নয়, তেমনি দেশের আসল কাজ গুলি বকেয়া থেকে গিয়েছে – এটাও ঠিক । বহু সিঁড়ি ভাঙা বাকি ।

১১২

দেশ জিনিসটা ভারি সোজা কোনো কিছু নয়। একটা ক্রিকেট দল কিছু রান পেলো বা উইকেট নিতে পারলো, আর অমনি হইহই করে দেশপ্রেমিক বানিয়ে দিলাম দলটার কয়েকজন খেলুড়ে কে, এমন ব্যাপার আদৌ নয়। খেলার কথা যদি বলি, তাহলে ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠবো , আর কবাডি খেলার ব্যাপারে ট্যাঁ ফো করতে পারি না – এটা ভালো নয়। ক্রিকেটে বিশ্ব জয় করি, কিন্তু ফুটবলে কেউ পোঁছে না, ব্যাপারটাও ঠিক সুবিধের নয়। ক্রিকেটের সাফল্যের সাথে দেশের গৌরব জড়াতে গেলে, ফুটবলকেও হিসেবে নিতে হবে আর কবাডিকেও ব্রাত্য করে রাখা চলবে না। সাঁতার বা জিমন্যাসটিক কেও গুরুত্ব দিতে হবে । দেশ বললে মহারাষ্ট্র অন্ধ্র পঞ্জাব হরিয়ানা যেমন গুরুত্ব পাবে, নাগাল্যাণ্ড মিজোরাম অরুণাচল যদি সিকির সিকি গুরুত্ব না পায়, তাহলে দেশপ্রেম জিনিসটা একটা ছ্যাবলামি হয়ে দাঁড়ায়। দেশ মানে দেশের সবাই মিলে একটা ব্যাপার। তুমি আমি রামা শ্যামা মিলে দেশ হয়ে যায় না। সবাইকে নিয়ে ব্যাপারটা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।