|| জন্মদিন উপলক্ষে বুদ্ধ ও মার্ক্স স্মরণ || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্মদিন উপলক্ষে বুদ্ধ ও মার্ক্স স্মরণ

বুদ্ধ ভগবান আজ এসেছেন পুরমাঝ, তাঁর পায়ে দিব উপহার। পদ্মফুলের মালিকানার জন‍্য বড়লোকেদের প্রতিযোগিতা দেখে গরিব সুদাস মালির যা মনে হয়েছিল। লোকে ভাবে, গরিব মানুষের পক্ষে পয়সার লোভ ছাড়া শক্ত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধি অন‍্যরকম। এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরিভূরি, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
আমরা লক্ষ্য করি বুদ্ধের জীবৎকালে বহু রাজা, ধনিক, শ্রেষ্ঠী, তাঁর শরণ নিয়েছেন। আচ্ছা, কী রকম লোক ছিলেন সেই সব রাজা বা শ্রেষ্ঠী বা বড়লোকেরা। সুপ্রিয়া টের পেয়েছিলেন। সেই শ্রাবস্তীপুরে যখন দুর্ভিক্ষ জেঁকে বসেছে, তখন বুদ্ধ নিজের ভক্তদের ডেকে বললেন, ক্ষুধিতেরে অন্নদান সেবা, তোমরা ল‌ইবে বলো কেবা। তখন একে একে শ্রেষ্ঠী রত্নাকর, সামন্ত জয়সেন, বড় কৃষিপতি ধর্মপাল, নিজের নিজের সমস্যার কথা তুলে ধরতে থাকল। নগরলক্ষ্মী কবিতাটা পড়ে নিতে হবে। সুপ্রিয়া গরিবের মেয়ে। শুধুমাত্র গরিবই নয়, তার উপর অন্ত‍্যজ পরিবারের মেয়ে। বুদ্ধের আশ্রয় পাবার পরেও জনসমক্ষে তার স্ট‍্যাটাস বদলায় নি। গরিব মানুষকেই নিজেদের সংঘশক্তি দিয়ে দুর্ভিক্ষের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছেন আরেকটি গরিব মানুষ, সুপ্রিয়া। কোনো দৈবশক্তির আশ্রয় নেবার কথা ওঠেনি বুদ্ধের তরফে। মানুষী পরাক্রমে মানুষের বোধযোগ‍্য পথে দুর্ভিক্ষকে সামলানো হয়েছে।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে যাঁরা অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা করেছেন, তাঁরা জানের বাকস্বাধীনতার অভাবের সঙ্গে দুর্ভিক্ষ জড়িত। সমানুপাতিক ধাঁচের সম্পর্কে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ বাকস্বাধীনতার অভাব যত প্রকট, দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা তত বেশি।
আধুনিক যুগে রাষ্ট্র মানেই শ্রেণিরাষ্ট্র। হয় সে পুঁজিপতির শ্রেণিরাষ্ট্র, ন‍ইলে শ্রমিকদের শ্রেণিরাষ্ট্র। মাঝামাঝি বলে কিছু হয় না। নানাবিধ নামে ডোল দেওয়া হতে পারে, কিন্তু গরিব মানুষের হাতে রাষ্ট্র চালানোর চাবিকাঠিটি তুলে দেওয়া হয় না।
গরিবের সঙ্গে বড়লোকের আসমান জমিন ফারাকটা যিশু চমৎকার করে বুঝেছিলেন। রহস্যময় ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় বলেছিলেন, সূঁচের ছিদ্রের ভিতর দিয়ে উট গলে যেতে পারে, কিন্তু ধনীরা স্বর্গরাজ্যে যেতে পাবে না। সাধে যিশুকে চোরের ঠ‍্যাঙান ঠ‍্যাঙানো হয়েছিল! চাবুক মারতে মারতে ক্রুশে তোলা হল। না, পুত্রকে বাঁচাতে ঈশ্বর নেমে আসেননি। ঈশ্বর কখনো আসেন না। নাই বলেই আসেন না।
সন্ন‍্যাসী উপগুপ্তকে দেখি, আর আশ্চর্য হয়ে যাই। যে মেয়ে নিজের শরীরের কারণে বড়লোকের কোলে উঠতে পারে, সেও রুগ্ন হয়ে পড়লে তার ঠাঁই হয় ফুটপাতে। মাংসময় সম্পর্কটা চিরে চিরে দেখান রবীন্দ্রনাথ। আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা। বলবেন উপগুপ্ত। এক আশ্চর্য সুন্দর মানুষের আসল বৈশিষ্ট্য তাঁর গুণ, রূপ নয়, গুণ। আর মানুষের প্রতি তাঁর অপরিমেয় ভালবাসা। বসন্ত রোগীকেও ত্রাণ দিতে তার ভয় হয় না। মৃত‍্যুভয় থেকে মুক্তি পাওয়া মানুষকেই খাঁটি মানুষ বলে।
রাজনীতিটুকু না বুঝতে শিখলে বুদ্ধকে বোঝা যায় না। তিনি তন্ত্র মন্ত্রে নেই, রহস্যময় ক্রিয়াকলাপ পূজা অর্চনায় নেই। তিনি আছের বুদ্ধির মুক্তিতে। জড়তা থেকে মুক্তি, ক্লীবতা থেকে উত্তরণ। শেষজীবনে বুদ্ধ নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন সকলের থেকে। কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। তবুও কেউ এসে উপদেশ চায়। বড়লোকের হয়ে তদ্বির করার লোক জোটে। বড় মাপের শিষ‍্য একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির হয়ে বুদ্ধকে অনুরোধ করেন, একটু উপদেশ দিন। বুদ্ধকে কথা বলতেই হল। কিন্তু অশীতিপর ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরেও রাজনীতির বোধ বুদ্ধের মধ‍্যে স্পষ্ট। তিনি বললেন, আত্মদীপ ভব, আত্মশরণো ভব, অনন‍্যোশরণো ভব। ওই চিরকালের মানুষের উত্তরণের পথ। নিজেকেই নিজে পথ দেখাতে হবে। অন্ধকার পথে নিজেই নিজের প্রদীপ হয়ে উঠতে হবে। রবীন্দ্রনাথ গান বাঁধবেন, যদি আলো না ধরে, আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা চলো রে। নিজেই নিজের সহায়তা করো। কারো কাছে সহায়তা চেয়ো না। সুপ্রিম কোর্টের কাছেও না। সুপ্রিম কোর্ট তোমার লড়াইটা লড়ে দেবেন না। ও তোমাকে কাঁটা ছড়ানো পথে রক্তমাখা চরণতলে আপনি লড়তে হবে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বুদ্ধের ইমেজকেও গ্রাস করে নিয়েছে। জাপানি সমরবাদী শক্তি বুদ্ধের উপাসনা করছে, যাতে চীনকে শেষ করতে পারে। কোনো অহিংস রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ নিজের পরমাণু বোমায় নখের আঁচড়ে লিখে রাখে বুদ্ধ লাফিং। বুদ্ধ হাসছেন। এত বড় ব‍্যঙ্গের জবাবে বুদ্ধ কোথাও থেকে নেমে আসেন না। ওই অহিংসার মুখোশ উন্মোচন করতে হয় সাধারণ মানুষকেই।
আজ বুদ্ধজয়ন্তী। আজ কার্ল মার্ক্সের জন্মদিন। আজ মানুষকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করেই নিজের লড়াই লড়তে হবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।