• Uncategorized
  • 0

রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

রেলগাড়ির রবীন্দ্রনাথ

রেলগাড়ির কথা উঠলে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে হয়। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হিমালয় ভ্রমণে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। বয়স তখনো আট পেরোয় নি। অদ্ভুত কল্পনার সাগরে মিশে আছে বালকের মন। মাকে বাড়িতে ছেড়ে, গম্ভীর ভারিক্কি অথচ স্নেহময় পিতার সঙ্গে রবির প্রথম দূরে যাওয়া। সেই সময় রেলগাড়িতে যাওয়া সম্পর্কে খেলার সাথিদের কাছে একটা ধারণা পেয়েছিলেন বালক রবি। চলন্ত রেলগাড়িতে নাকি বসার সিটটি খুব ভালো করে চেপে ধরে রাখতে হয়। ন‌ইলে নাকি ছিটকে পড়ার ভয় থাকে। ট্রেনে উঠে চলা শুরু হলে বোঝা গেল, খবরটা আদৌ সত‍্য নয়। চলন্ত ট্রেনে সঙ্গে থাকা সমস্ত কিছু এক‌ইভাবে ছুটতে থাকে, এই বিষয়টার আভাস তখনই পেয়ে গিয়েছিলেন। রেলযাত্রায় টিকিট চেকার সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই বালক বয়সেই। সাত আট বছরের রবির চেহারাটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট ছিল। মাথাতেও একটু লম্বা। দেখলে মনে হত দশ পেরিয়ে গিয়েছে। বাড়ির তরফে রবির জন‍্য বয়স অনুযায়ী হাফ টিকিট করা হয়েছিল। চলন্ত ট্রেনে টিকিট চেকার এসে রবির জন‍্য ফুল টিকিট দাবি করলেন। রবি যাচ্ছিল বাবার সঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ বিশিষ্ট জমিদার, ব্রাহ্ম সমাজের কর্ণধার, এবং গোটা পূর্ব ভারতের। নবজাগরণের পুরোধা ব‍্যক্তিত্ব। তিনি টিকিট চেকারের এই সন্দেহ প্রকাশে ভীষণ বিরক্ত হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির আদবকায়দা, রুচি সংস্কৃতির ব‍্যাপারে কিছুমাত্র ধ‍্যানধারণা থাকলেও টিকিট চেকার বুঝতে পারতেন, সামান্য কয়েকটি টাকার জন‍্য সে বাড়ির কর্তা মহাশয় ছেলের বয়স লুকোবেন, এটা হতেই পারত না। ইংরেজ টিকিট চেকারের মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত দেবেন্দ্রনাথ কয়েকটা মুদ্রা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
তারপর সারাজীবন ধরে রেলগাড়িকে নানা মাত্রায় ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ।
আজকের পৃথিবীতে রেলপথের দৈর্ঘ্যের বিচারে ভারতীয় রেলওয়ে চতুর্থ বৃহত্তম। গত ৩১ মার্চ, ২০২০-র হিসাবে ভারতীয় রেলপথের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৬৭৯৫৬ কিলোমিটার। ভারতে যে ব্রডগেজ রেলপথ রয়েছে, যার দুটি সমান্তরাল লাইনের মধ্যে দূরত্ব সাড়ে পাঁচ ফুট, তা এই ২০২০ তে ভারতীয় রেলপথের মোট দৈর্ঘ্যের ৯৪ শতাংশের বেশি। আর এই সময়ে এই ব্রডগেজ রেল লাইনের ৭১ শতাংশের বেশি বিদ‍্যুতায়িত। ভারতীয় রেলে বিদ‍্যুতায়নের ইতিহাস শতবর্ষ ছু়ঁতে চলল। ১৯২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস থেকে কুরলা অবধি পথটি প্রথম বিদ‍্যুতায়িত হয়। রেলস্টেশনে বৈদ্যুতিক বাতি সাধারণ মানুষের জীবনে কি প্রভাব ফেলে তাও আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় দেখতে পাব। বর্তমানে ভারতীয় রেল ১৮টি জোনে বিন‍্যস্ত। আর তাতে সাড়ে বারো লক্ষের বেশি লোক কাজ করেন। লোক নিয়োগের প্রশ্নে ভারতীয় রেল‌ওয়ে সারা বিশ্বে একটা উল্লেখযোগ্য সংস্থা। রেলওয়ের খুব নিচুতলার কর্মী নিয়েও রবিঠাকুরের একটা কবিতায় কিছু প্রসঙ্গ এসেছে। ভারতে প্রথম প‍্যাসেঞ্জার ট্রেন চলা শুরুর তারিখটি হল, ১৬ এপ্রিল, ১৮৫৩।
মুম্বাইয়ের বোরি বন্দর থেকে থানে অবধি চৌত্রিশ কিলোমিটার রাস্তায় প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চলেছিল। অবশ‍্য পণ‍্য পরিবহনের জন্য প্রথম গুডস ট্রেন চলেছিল মাদ্রাজে। সেটা ১৮৩৭ সাল। পূর্ব ভারতে প্রথম প‍্যাসেঞ্জার ট্রেন চলেছিল ১৮৫৪ সালের ১৫ আগস্ট, হাওড়া থেকে হুগলি স্টেশনের মধ‍্যে। সেই রেলপথের দূরত্ব ছিল ৩৯ কিলোমিটার। হঠাৎ-দেখা কবিতায় রেলের কামরাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় আশ্চর্য ভূমিকা পালন করেছে।
রেলপথ ও রেলযাত্রা ভারতে শুরু হ‌ওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছেন। আর রবীন্দ্রনাথের সাথেই একটু করে বেড়ে উঠেছে ভারতের রেলপথ। এবং তা অবশ্যই ব্রিটিশ পরিচালনায়। জীবনের শেষ প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ একজন বিশ্ববন্দিত মানুষ। চিরকালের জন‍্য সাধনভূমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে যখন চলে আসছেন, তখন তিনি এসেছিলেন একটি সেলুন কার-এ। প্রবীণ কবি যখন পারস‍্যে বেড়াতে যাবেন, তখন বিমান যাত্রার প্রথম যুগ। বিমান যাত্রার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তচাপ ও অন‍্যান‍্য শারীরিক পরিস্থিতি বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করা হয়েছিল। কেননা, ওঁর মাপের একজন বিশ্ব নাগরিকের স্বাস্থ্যের ব‍্যাপারে বিমান কর্তৃপক্ষ কোনো রকম ঝুঁকি নিতে চান নি। অথচ ওই বিমান যাত্রাটি আদৌ পছন্দ হয়নি কবির। খুব দ্রুত গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেয় বিমান। এই তাড়াহুড়োটাই ভাল লাগেনি রবীন্দ্রনাথের। রেলযাত্রায় তিনি পেয়েছেন অনেক কিছু। পেয়েছেন  দেখতে দেখতে চলার সুখ।
আজকের মত সেকালেও অভিজাত ও ধনী যাত্রীদের জন‍্য ফার্স্ট ক্লাসের ব‍্যবস্থা ছিল। সেকালে ধনী ব‍্যক্তিদের সঙ্গে যাত্রী হত তাঁর চাকর বাকরেরাও। এই ভৃত‍্যকুলের জন‍্য আলাদা কামরা থাকত। অজস্র লটবহর মালপত্র নিয়ে বাবুরা মাসখানেকের ছুটিতে যেতেন দার্জিলিংয়ে কিংবা পশ্চিমে। পশ্চিম মানে রাঁচি, গোমো, কোডারমা, দুমকা, দেওঘর, ঘাটশিলা, শিমুলতলা, কার্মাটাড়, এইসব। তখন নদীর স্বাস্থ্য আজকের মত বিপন্ন ছিল না। অনেক জায়গাতেই সেতু বা বাঁধের অস্তিত্ব ছিল না। স্বভাবতই উপর দিয়ে রেল লাইনের প্রশ্ন‌ই ওঠে না।
তখন অনেক জায়গাতে কোনো স্টেশনে একটি রুটের গাড়ি থেকে আরেক রুটে যেতে গাড়িবদল করতে হত। যাত্রীদের কয়েকটি ঘণ্টা অবস্থান করতে হত প্রতীক্ষালয়ে। সে বিষয়ের প্রসঙ্গ এসেছে রবীন্দ্র কবিতায়।
রেলপথের প্রযুক্তি ক্রমেই উন্নত হচ্ছিল। যাত্রীস্বাচ্ছন্দ‍্য নিশ্চিত করতে গাড়ির কামরার ক্ষেত্রেও উন্নতমানের প্রযুক্তির সন্ধান চলছিল। কিন্তু প্রথম দিকে প্রযুক্তি কুশলতার অভাবে রেলযাত্রা সর্বদা খুব আরামদায়ক ছিল না। চিঠিপত্র অষ্টাদশ খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ” সান্তাহার স্টেশনে আসাম মেলে চড়লুম, এমনি কসে ঝাঁকানি দিতে লাগল যে দেহের রস রক্ত যদি হত দ‌ই, তাহলে ঘণ্টাখানেকের মধ‍্যেই প্রাণটা তার থেকে মাখন হয়ে ছেড়ে বেরিয়ে আসত।” রেলগাড়িতে ওই যে বাবুর সঙ্গে চাকরের আলাদা কামরায় যাবার সুযোগ ছিল, তা নিশ্চয়ই “পুরাতন ভৃত‍্য” কবিতার কেষ্টার জানা ছিল। তার বাবু দালালগিরি করে কিছু টাকা ফোকটে রোজগার করে ফেললে পুণ‍্যার্থে বৃন্দাবন যেতে চেয়েছিলেন। বাবুর গৃহিণী আশঙ্কা করেছিলেন, দূর দেশে গিয়ে কেষ্টা বাবুকে অভ‍্যাসমত জ্বালাতন করে যাবে। সেজন্য কেষ্টার পরিবর্ত হিসাবে নিবারণের যাবার কথা হয়েছিল। কিন্তু বর্ধমানে গাড়ি থেকে নেমে বাবু দেখলেন, “কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত তামাক সাজিয়া আনে।” চিত্রা কাব‍্যগ্রন্থের এই কবিতা ১৩০১ বঙ্গাব্দের ৭ ফাল্গুন তারিখে লেখা।
“পলাতকা” কাব্যগ্রন্থের ‘ফাঁকি’ কবিতায় তেইশ বছর বয়সের রোগজর্জর বধূ বিনুর স্বামীর সঙ্গে জীবনের প্রথম ও চরম রেলযাত্রার কথা আছে। রুগ্ন বিনুর আরামের কিছুমাত্র উপায় খুঁজে না পেয়ে ডাক্তার বলেছিল হাওয়াবদলের কথা। সেই সূত্রে বিনুর প্রথম রেলের গাড়ি চাপা হল। বিলাসপুর স্টেশনে গাড়ি বদলের কথা। পরবর্তী গাড়ি আসবে ছয়ঘণ্টা পরে। এই সময়টা বিনুকে ওয়েটিং রুমে কাটাতে হয়েছিল। কবি লিখেছেন যাত্রীশালা। বিনুর স্বামী সময় কাটাবার জন‍্য একটা ইংরেজি নভেল কিনে এনে পড়ছিল। অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যায় বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে হুইলার এবং অন‍্যান‍্য ব‌ই স্টলের কথা। বিলাসপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমেই বিনুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল রুকমিণীর। তার স্বামী রেলের কুলি। আর রুকমিণী নিজে যাত্রীঘরের ধোয়া মোছা করে। আকালের দিনে জমিদারের অত‍্যাচারে সাত বিঘে জমি জমা ছেড়ে গাঁ ত‍্যাগ করে দম্পতি পালিয়ে এসে রেলের কুলিগিরির কাজ নিয়েছিল।
 রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলায় যখন বাবার সঙ্গে বেড়াতে গেছেন, বাবা তাঁকে একটা বাক্সে কিছু পয়সা দিয়ে গরিব মানুষকে দান ধ‍্যান করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। শিশুপুত্রের ওপরে দান করার সেই বাক্সের জমা খরচের হিসেব রাখার ভার ছিল। বাবা বলতেন, তোমার হাতে আমার পয়সা যায় বেড়ে।
 ফাঁকি কবিতায় বিনু তার ছোট হাতবাক্স থেকে কাঙালকে ভিক্ষা দেয়। চলন্ত গাড়ি থেকে পয়সা ভিক্ষা দিতে গেলে ছুঁড়ে দিতে হয়। সেটা অশ্রদ্ধার। বিনু যত্ন করে পয়সাটি কাগজে মুড়ে তবেই ছোঁড়ে। রবীন্দ্রনাথের কলমে এইখানে ভারি এক দরদী মেয়ের কথা ফুটে ওঠে।
‘পরিশেষ’ কাব‍্যগ্রন্থের “বাঁশি” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২৫ আষাঢ় তারিখে। এই কবিতায় রেলগাড়ি তার ‘ইস্টিশন’,  এঞ্জিনের ধস্ ধস্, বাঁশির আওয়াজ, যাত্রীর ব‍্যস্ততা, কুলি-হাঁকাহাঁকি, সব নিয়ে হাজির। তার সঙ্গেই লেখেন, “সাড়ে-দশ বেজে যায়,/ তারপরে ঘরে এসে নিরালা নিঃঝুম অন্ধকার।।” অদ্ভুত মন্ময়তায় ছদ্ম বেকারত্বের ছবি আঁকেন রবীন্দ্রনাথ।
ওইরকম আরেকটি আষাঢ় মাসের কবিতা “হঠাৎ-দেখা”। ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ১০ আষাঢ় তারিখে লেখা এই কবিতায় রেলগাড়িতে জীবনের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ছবি আঁকেন তিনি। মানুষের জীবনে মিলন বিচ্ছেদ একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মিলন বিচ্ছেদ গভীরভাবে আমাদের আলোড়িত করে। এই হঠাৎ দেখা কবিতাতেও তাই। এই কবিতায় রেলগাড়ির কামরা, তার  জানালা, জানালার বাইরে আকাশ, চলন্ত গাড়ির বেঞ্চ, গাড়ি চলার আওয়াজ, আর রেল স্টেশন বেশ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। এই কবিতাতেই বিখ্যাত সেই কথাটা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’
জীবনের শেষ প্রান্তে তাঁর “নবজাতক” কাব‍্যগ্রন্থ। ওই কাব‍্যগ্রন্থে ১৯৩৮ সালে ৭ জুলাই তারিখে শান্তিনিকেতনে বসে “ইসটেশন” নামে একটি কবিতা লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তাতে লেখেন, ‘কেউ বা গাড়ি ফেল করে তার শেষ মিনিটের দোষে।’ এই কথাটা যেন প্রবাদের মতো হয়ে গিয়েছে। ওই এক‌ই কাব‍্যগ্রন্থে ১৯৪০ সালের ২৮ মার্চ ‘রাতের গাড়ি’ নামে কবিতা লেখেন তিনি। সেখানে লিখেছেন, ‘এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি/ দিল পাড়ি –/ কামরায় গাড়ি-ভরা ঘুম,/ রজনী নিঝুম।’ আরো লেখেন, ‘ চালায় যে নাম নাহি কয়;/ কেউ বলে যন্ত্র সে, আর-কিছু নয়।/ মনোহীন বলে তারে, তবু অন্ধের হাতে / প্রাণমন সঁপি দিয়া বিছানা সে পাতে।’
এইভাবে রেলগাড়ির অনুষঙ্গে মানবজীবন নিয়ে নিজের দার্শনিক মনকে প্রকাশ করেছেন তিনি।
রেলগাড়িকে কার্যকরীভাবে গড়ে তুলেছিলেন ইংরেজ প্রযুক্তিবিদ জর্জ স্টিভেনসন। ১৭৮১ সালে ৯ জুন তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মদিন স্মরণে লেখাটি নিবেদন করলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *