সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৬)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস
কিন্তু সভ্যতা এমন একটা বিরাট মই যার প্রতিটি ধাপ অজস্র পরিবর্তনের স্মারক দিয়ে তৈরি। আর এর প্রত্যেকটি পরিবর্তন শাসক শ্রেণীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবেই গড়ে উঠেছে। যদি শাসকশ্রেণীর অঙ্গুলিহেলনেই মানুষ নির্বিবাদে চলত, তাহলে সভ্যতা নামে জিনিসটা গড়েই উঠত না। তাই আমাদের বিরুদ্ধে যে সমাজকে ভেঙে ফেলার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তা অনেকটা সেই ঈশপের গল্পের ধূর্ত শেয়ালটার মতোই শোনাচ্ছে না! আমরা যারা এই সমাজটাকে নরখাদক শোষকশ্রেণীর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় করেছি, তারা না কি সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক! আর শোষকশ্রেণী যে নরখাদকের মতো প্রতি মুহূর্তে সমাজের টুঁটি কামড়ে ধরে আছে, লকলকে জিভে শুষে নিচ্ছে তার রক্ত, তার শিশুদের জ্যান্ত কড়মড়িয়ে চিবোচ্ছে, তার বেলা? আমরা যারা সমাজটাকে ওই রক্ত শোষকদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপণ করেছি, তারা হলাম গণশত্রু, তাই না? শুনে রাখুন, আমরাই এই সমাজের রক্তমোক্ষণ বন্ধ করে তাকে সুস্থ করে তুলব, আমরা এই সমাজের শৃঙ্খলমোচন করব। আমরা যারা এই সমাজকে আপনাদের চাপিয়ে দেওয়া শোষণ নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাব, সেই আমাদের সমাজবিরোধী বলা যায়? মহামান্য বিচারক, আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগগুলি শুনে নরকের দৈত্যগুলোও হো হো করে হেসে উঠবে।
হ্যাঁ, আমরা ডিনামাইটের কথাটা তুলেছিলাম। আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বেশ বুঝতে পেরেছিলাম অতীতের স্বেচ্ছাচারী শাসকদের মতোই আজকের শাসকেরাও কোনো যুক্তির কথায় কান দেবে না। এমনকি তারা পাশবিক শক্তি দিয়েই সভ্যতার প্রগতির চাকাটাকে বাধা দিতে চাইবে। এটা কি কোনো মিথ্যা কথা, বানানো কথা ছিল? না কি, আমরাই উচিত কথা, সত্য কথাটা বলেছিলাম? তথাকথিত মুক্ত ও গণতান্ত্রিক আমেরিকায় আজ কারখানাগুলিতে পুলিশের টহলদারি চলে, গুপ্তচরেরা সব সময় ইতিউতি নজর করছে, কাছে পিঠেই রয়েছে মিলিটারি ক্যাম্প আর সবার মাথার উপর রয়েছেন একজন শেরিফ। কিন্তু এসব কেন? এদের পোষার একটাই কারণ, যাতে কোথাও টুঁ শব্দ না ওঠে। আজ আমেরিকার গণতন্ত্র আর মুক্তচিন্তা মিলিটারি বাহিনীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এমনটা যে হবে, এটা আমরা আগেই বলেছি। আরো বলছি, পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়ে এক সময় সহ্যসীমার অতীত হয়ে যাবে। তখন কী হবে? সামন্ত প্রভুদের সময় থেকে আমাদের পাওনা ছিল দাসত্বের গ্লানি, অনাহার আর করুণ মৃত্যু। এই ছিল বিধিলিপি। আমরাই শ্রমিককে শোনালাম বিজ্ঞান প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করেছে, জোভের মাথা থেকে মিনার্ভার প্রকাশের মতো ফণা মেলে ফোঁস করে উঠেছে ডিনামাইট। এই ঘোষণাটিকেই যদি খুনের সামিল করে দেখতে চান, তাহলে যাঁদের থেকে আমরা ডিনামাইট কথাটা শিখেছি, তাঁদের উপরেও দোষ চাপান। যদি এমন অভিযোগ তোলা হয় যে, আমরা বর্তমান ব্যবস্থাটাকে চৌঠা মে তারিখে বলপূর্বক উৎখাত করতে চেয়েছি, এবং তারপর নৈরাজ্যবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি, তাহলে সেটা একটা অত্যন্ত অবাস্তব বক্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রাজনৈতিক ক্ষমতার নিচের তলার লোকেদের পক্ষেও এটা খুব বোকা বোকা একটা বক্তব্য। যদি গ্রিনেল মনে করেন যে, আমরা সত্যি সত্যিই এরকম একটা কাজ করতে গিয়েছিলাম, তাহলে তাঁর উচিত ডাক্তার দেখিয়ে আমাদের মাথাগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা, পরীক্ষা করানো। একমাত্র পাগলের পক্ষেই ওভাবে ভাবা সম্ভব। আর পাগলের বিরুদ্ধে তো খুনের অভিযোগ আনাও যায় না, আর তাকে সেই অপরাধে দণ্ডও দেওয়া যায় না।
ইওর অনার, যদি আমাদের তরফ থেকে কোনো ষড়যন্ত্র, বা কোনো রকম পূর্ব পরিকল্পনা থাকত, তাহলে কি আপনি মনে করেন না, ঘটনাটা চৌঠা মে হে মার্কেটে না ঘটে অন্যভাবে ঘটত?
এই যে উদ্ভটভাবে “ষড়যন্ত্র” কথাটা তোলা হচ্ছে, অনুমান করছি এর পিছনে আমার একটা বক্তৃতার অবদান আছে। আজ থেকে প্রায় বছর দেড়েক আগে মিশিগান প্রদেশের গ্রাণ্ড র্যাপিডস এ জর্জ ওয়াশিংটনের স্মরণে তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা সমাবেশে আমি একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। নাইটস অফ লেবার নামে সংগঠন ওইদিন বক্তৃতা দেবার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই বক্তব্যে আমি আলোচনা করেছিলাম যে, বিগত শতাব্দীতে আমাদের মহান বিপ্লবীরা যেভাবে দেশকে গড়তে চেয়েছিলেন, তা কিন্তু একেবারেই বাস্তবায়িত হয়নি। আমি বলেছিলাম, ওই মনীষীরা যদি আজ জীবিত থাকতেন, তাহলে তাঁদের আজ ঝাঁটা আর কোদাল হাতে বিপুল আবর্জনা সাফাইয়ের কাজ করতে হত। আর তাঁদেরকেও অসভ্য বর্বর সমাজতন্ত্রী হিসেবে চেনানো চলত।
আলোচনা করতে হয়তো একবার আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল যে, বিপ্লব যদি ব্যর্থ হত, তাহলে হয়তো রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জর্জ ওয়াশিংটনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হত। জর্জ ওয়াশিংটন সম্বন্ধে আমার ওই আলটপকা ভাবে বলে ফেলা কথাটা পুঁজি করে নিয়েই গ্রিনেল আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণাল।
গ্রিনেল চেয়েছিল জনসমক্ষে আমাকে অবিবেচক ও নির্বোধ প্রতিপন্ন করতে। কিন্তু কেন? জর্জ ওয়াশিংটন জীবিত থাকলে আজ যে তাঁকে রাষ্ট্রশক্তি আদৌ পছন্দ করত না, আমার এই বক্তব্যের সত্যতা কে অস্বীকার করতে পারবেন? ওই যে বলা হচ্ছে আমি নাকি নিজেকে জর্জ ওয়াশিংটনের তুলনা করে দেখাচ্ছি, এ একেবারে ডাহা মিথ্যে কথা। কিন্তু যদি তর্কের খাতিরে মেনে নিই যে আমি তাই করেছি, তাহলে কি সেটা নরহত্যার মতো অপরাধ নাকি? এখানে এই কোর্টে একজন সাক্ষী হিসেবে হাজির হয়ে বলেছেন যে,আমি নাকি বলেছি, শ্রমিকদের অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে প্রস্তুত হতে হবে, কেননা, শেষ পর্যন্ত শক্তিই কথা বলে, এবং ইদানীং চিকাগোয় নাকি বহু লোকেই সশস্ত্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমি কখনোই একথা বলিনি যে আমরাই সামাজিক বিপ্লব উদ্বোধন ও সূচনা করব। এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে বলে রাখছি, ভূমিকম্প বা সাইক্লোন যেমন সাজিয়ে গুছিয়ে গড়ে তোলা যায় না, বিপ্লব জিনিসটাও তাই। কতকগুলি কারণ এবং কতকগুলি পরিস্থিতির চাপে বিপ্লব দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিগুলিই বিপ্লব ঘনিয়ে তোলে। আমি এক দশকেরও বেশি সময়কাল ধরে সামাজিক দর্শন নিয়ে তন্নিষ্ঠ গবেষণা করেছি, আর তার জোরেই আমি বলছি, আমরাই বিপ্লব ঘটাব, এমন উদ্ভট কথা আমি বলতেই পারি না। তবে, আমি বিশ্বাস করি, বিপ্লব আমাদের অতি সন্নিকটে। সত্যি বলতে কি, আমরা বিপ্লবের ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেই আছি। একজন ডাক্তার যদি বলেন, রোগীর অবস্থা ভাল নয়, তার জীবনের আর আশা নেই, আর এই কথাটি বলার কয়েকদিন পর রোগী যদি সত্যিই মারা যায়, তাহলে কি রোগীর মৃত্যুর ভবিষ্যৎ বাণী করার জন্য কি আপনারা ডাক্তারকে ধরে উত্তম মধ্যম দেন? দেন না, তাই তো? তেমনি, কেউ যদি বলে, শাসকশ্রেণীর সাংঘাতিক শোষণে নিপীড়নে বিপ্লব ঘনিয়ে উঠছে, তাহলে তাকে দোষ দেবেন কেন? শাসকশ্রেণী বুঝতে চাইছে না যে, নিদারুণ শোষণে সাধারণ মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কিছুটা সংস্কার জরুরি। তারা মনে করছে যে, তারা সমাজবিকাশের রথের চাকাটা থামিয়ে রাখতে পারেন। অথচ, এই সমাজবিকাশের বিষয়টা চিরন্তন প্রাকৃতিক শক্তির মতোই শাশ্বত। তাকে থামিয়ে রাখার উপায় নেই। ধনিকশ্রেণী এর মধ্যে একটা হঠাৎ করেই গড়ে ওঠা সৃষ্টিছাড়া জিনিস। এরা চিরকাল টিঁকবে না।
এই মামলায় সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যে, চৌঠা মে তারিখে হে মার্কেটে পুলিশ যে দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধিয়েছে, তার নৈতিক দায় আমাদের মতো সমাজতন্ত্রী শ্রমিকনেতাদের। বছর চার পাঁচ আগে ঠিক এই কোর্টরুমেই এখানেই একটা মামলায় আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির ছিলাম। শ্রমিকশ্রেণী, তারা আইনের বিধান মেনে শান্ত ভদ্রভাবে একটি বিষয়ের প্রতিবিধান চাইতে এসেছিল। চৌদ্দ নম্বর ওয়ার্ডে অল্ডারম্যান হিসাবে নির্বাচনে যাঁকে তাঁরা ভোট দিয়ে জিতিয়েছিল, মোটরগাড়ি কোম্পানি সেই জয়যুক্ত প্রার্থীকে পছন্দ করেন নি। নির্বাচনী মামলাটি যাঁরা পরিচালনা করছিলেন, সেই বিচারকরা ছিলেন তিনজন। তাঁদের মধ্যে দুজন বিচারক ইলেকশনের ফলাফলের ভুলত্রুটি সংশোধন করতে ব্যালট বাক্সটিকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে চলে গেলেন। আর তারপর সব ভুলচুক কেটে গেল। এইভাবে ধর্মাবতারেরা নির্বাচকমণ্ডলীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। এবং নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত হবার।অধিকার থেকে প্রতারণা করলেন এবং মোটরগাড়ি কোম্পানির একচেটিয়া পুঁজিপতিকে নির্বাচনের ফল তুলে দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করলেন। শ্রমিকেরা এই নির্বাচনী প্রতারণার মামলা লড়তে দেড় হাজার ডলার চাঁদা তুলে খরচা করেছিল। তাদের বিপরীত পক্ষ যারা নির্বাচনী প্রতারণাটি করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ এতদূর অকাট্য ছিল যে, তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে তারা মিথ্যা হিসাব দাখিল করেছে। আর অফিসিয়াল কাগজপত্র জাল করেছে। বিচারপতি গার্ডনার যিনি এই নির্দিষ্ট মামলায় প্রধান বিচারক ছিলেন, তিনি তাদের বেকসুর খালাস দিয়ে বললেন, তারা নাকি কোনো অপরাধমূলক মনোবৃত্তি নিয়ে এই জাল জোচ্চুরি করেন নি। আমার আর বলার কিছুই নেই। কিন্তু যখন আমরা নৈতিক দায় দায়িত্বের প্রসঙ্গ তুলি তখন আমাদের চিন্তা শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হয়ে ওঠে। আর বাস্তব অপরাধের বেলায় আমরা চোখে ঠুলি পরে থাকি। যারা সমাজটাকে সংস্কার করতে দেয় না, প্রগতির প্রতিটি পথকে রুদ্ধ করে রাখতে চেষ্টা করে, তাদের জন্যই আজ এই শহরে বিপ্লব ঘনিয়ে উঠছে। আর যারা শোষণ শাসনের মুখে খানিকটা লাগাম পরাতে চেয়েছি, যেমন আমরা, আমাদেরকে অশান্তি পাকানোর দায় থেকে রেহাই দিতে হবে।