তিনি নাকি ঈশ্বরপুত্র। দেখতে তাঁকে অসাধারণ। তিনি বললে প্রকৃতি তা নতমস্তকে শোনে। তিনি অযোনিসম্ভব। কুমারী মাতার সন্তান। সামান্য একটু রুটির টুকরো দিয়ে তিনি অগণিত ক্ষুধার্ত মানুষের তৃপ্তি ঘটানোয় সিদ্ধহস্ত।
এসব গল্পকথা, কল্পকথা। তিনি ছিলেন অতি সাধারণ মানুষ। দেখতেও খেটে খাওয়া মানুষের মতো। এই যে ছবিটি, নানা নথিপত্র বৈজ্ঞানিক ভাবে বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞেরা যিশুর এই ছবিটিই বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন।
তিনি শ্রমজীবী ঘরের সন্তান। অযোনিসম্ভব হবার প্রশ্নই ওঠে না। কোনো হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স ওভাবে ভূমিষ্ঠ হয় না, হতে পারে না। কুমারী মাতার সন্তান? প্রথাগতভাবে বিয়ের যে ধারাবাহিকতা, তা খুব পুরোনো নয়। দুটি অন্নসংস্থান আর মাথার উপর ছাউনি যোগাড় করতে গরিব মানুষকে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হত। বিয়ে, সানাই, বিয়ের আগে শুটিং, বিয়েতে ডিজাইনার ফোটোগ্রাফি, ফোটোসেশন, হনিমুন প্ল্যানিং, বিয়ের তিনমাসের মধ্যে মোহভঙ্গ, এসব কীর্তি করার ফুরসৎ জুটত না।
যিশুর অলৌকিক ক্ষমতা? তা হলে কাঁটার মুকুট পরানো গেল কেমন করে? দুটো সাজা পাওয়া চোরের সঙ্গে ক্রুশে ঝুলতে হল কেন?
ঈশ্বরের বরপুত্র?
এ আরও একটি গল্পকথা। ক্রুশে ঝুলতে ঝুলতে নবম প্রহরে তিনি বললেন, এলি এলি লামা সাবাখতানি। আরামাইক ভাষায় কথা বলতেন যিশু। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা এভাবে বাংলা ভাষায় লিখেছেন, হে ঈশ্বর, হে মানুষের ঈশ্বর, তুমি কেন আমায় পরিত্যাগ করলে!
যিশুর গল্প পুরোটাই এক সামাজিক যোদ্ধার উপর প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের অমানুষিক আক্রমণের খতিয়ান।
কেক খাবার সময়ে একটু ভাবুন, দেশে কৃষক শ্রমজীবী মানুষের উপর কী অকথ্য নির্যাতন চলছে। চাষ করছে কৃষক, মুনাফা করছে ফড়ে পাইকার মধ্যস্বত্ব। নীল সাদা কিষাণমণ্ডিগুলি কাঁদছে। অজস্র চাষি আত্মহত্যা করেছেন। যুবকদের হাতে কাজ নেই। তরুণীরা রুটি কিনতে চেয়ে দেহ বেচছে। সাধারণ মানুষ একটু ভদ্র ভাবে বাঁচতে চেয়ে নাজেহাল।
যিশুর বেলা ওইরকম হয়েছিল। যিশু বললেন, আমি ঈশ্বরের পুত্র। সব লোকেই ঈশ্বরের পুত্র। ক্ষমতাসীনরা ভাবল, বলে কি লোকটা! মজুরি খেটে খাওয়া সাদামাটা লোকটা নিজেকে কী ভাবছে? পুরোহিতরা যিশুর কথাবার্তায় সর্বনাশ দেখতে পেয়েছিল। লোকটা বলে কি? সে ঈশ্বরের পুত্র? আর সব লোকেই ঈশ্বরের সন্তান? তা হলে তো রাজা গজার সাথে হাজা মজাদের কোনো তফাৎ থাকবে না। না না, যিশু লোকটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার পক্ষে বিপজ্জনক। ওকে তো বাঁচতে দেওয়া চলে না। ব্যস, হয়ে গেল। যিশুর শাস্তি নির্ধারিত হয়ে গেল। ওদিকে শাসক পিলাতের বউ স্বপ্ন দেখেছে একটা ভালো লোককে মেরে ফেলা হচ্ছে। পিলাত ভাবলো অন্ততঃ নিজের শাসকীয় ক্ষমতাবলে যিশু লোকটাকে বাঁচিয়ে দেওয়া যাক। পুরোহিতরা তাতে চটে উঠছিল। পিলাতের আসন নড়বড় করে উঠতে পারত। জনতা জনার্দন যিশুকে পছন্দ করে নি। তারা বললো – না হয়, দস্যু বারাব্বাসকে মুক্তি দাও। কিন্তু যিশু কবভি নেহি। জনতা জনার্দন ক্ষেপলে তাকে সামলায় কার সাধ্যি! যিশুকে দু দুটো চোরের সাথে একসাথে ক্রুশে ঝুলতে হল। সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন যিশুর পক্ষে জোটে নি। জনতার উন্মাদনায় যিশুকে ক্রুশে ঝুলতে বাধ্য হতে হয়েছে।
কাউকে দেখে, কারো অনুপ্রেরণায় যে সক্রিয়তা, তার চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান নিজের বুদ্ধি বিবেকের শাসনে পরিচালিত হওয়া। জনতার তরফে অজ্ঞতা অসচেতনতা সক্রেটিসকে হেমলক পান করতে বাধ্য করে, জনতার হররায় দস্যু বারাব্বাস ছাড়া পেয়ে যায়, কিন্তু যিশু সাজা পায়, মার খায়, চোরের সামিল হয়ে। গ্যালিলিওর উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন স্মরণ করে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন টরিসেলি। এইসব স্মৃতি আরো প্রগাঢ় ভাবে সামাজিক বৈজ্ঞানিক সত্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের সংহত করুক।