• Uncategorized
  • 0

|| বোমার নাম হাইড্রোজেন || মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

বোমার নাম হাইড্রোজেন

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাচ্ছেন। অর্জুন বিরাট বীর। দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসাদে তাঁর জন্ম। কিন্তু মানুষ তো বটে। বিশ্বরূপ দেখে ভয়ে কৌন্তেয় তৃতীয় পাণ্ডব দিশাহারা। বলছেন, নভঃস্পৃশং দীপ্তমনেকবর্ণং ব‍্যাত্তাননং দীপ্তবিশালনেত্রম্।
দৃষ্ট্বা হি ত্বাং প্রব‍্যথিতান্তরাত্মা ধৃতিং ন বিন্দামি শমঞ্চ বিষ্ণো।।
আরো বলছেন, দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্ট্বৈব কালানলসন্নিভানি।
দিশো ন জানে ন লভে চ শর্ম প্রসীদ দেবেশ জগন্নিবাস।।
সেইসব মনে পড়ে গেল এক বিজ্ঞানীর। নিউ মেক্সিকোর সোকোরো থেকে ছাপ্পান্ন কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে জর্নাদা ডেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে। তারিখটা ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ সাল।
ভোর সাড়েপাঁচটা বাজতে এক মিনিট বাকি। বিস্ফোরিত হল ট্রিনিটি। আমেরিকার সর্বপ্রথম পরমাণু বোমাটি।
জে রবার্ট ওপেনহাইমার (২২ এপ্রিল, ১৯০৪ – ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭) । তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ক‍্যালিফরনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলে উঠলেন, কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্ত। গীতার শ্লোক ধ্বনিত হল ওপেনহাইমার এর কণ্ঠে। তিনি ফাদার অফ অ্যাটমিক বম্ব। লস অ্যালামোস ল‍্যাবরেটরির বড় দায়িত্বে। ম‍্যানহাটান প্রজেক্ট এরও। ১৯৪৫ এ ১৬ জুলাই অতি ভোরে জর্নাদা ডেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে ট্রিনিটি টেস্ট হবার মুহূর্তে তীব্র ঝলসানি দেখে গীতার শ্লোক উচ্চারণ করেছিলেন চল্লিশ পেরোনো ওপেনহাইমার। নিজের সৃষ্টির বিধ্বংসী ক্ষমতা দেখে শিহরিত বিকম্পিত ফাদার অফ অ্যাটমিক বম্ব।
পরমাণুর ভিতরের অন্ধ দানবিক শক্তিকে যে যুদ্ধোন্মাদ আমেরিকা দখল করে ফেলেছে, পৃথিবীকে সে কথাটা সাংঘাতিক জোরে জানিয়ে দিয়েছিল জাপানের হিরোশিমাতে লিটলবয় আর নাগাসাকিতে ফ‍্যাটম‍্যান পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। সেটা ১৯৪৫ সালের আগস্টের ৬ আর ৯। সবাই জানল সভ‍্যতাকে তছনছ করে দেবার ক্ষমতা ধরে আমেরিকার যুদ্ধোন্মাদ প্রশাসন।
বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার এর সূত্রে বলতে হয় জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান ( ৮ মার্চ, ১৮৭৯ – ২৮ জুলাই, ৯৬৮) এর কথাও। অটো হান ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ তারিখে পরমাণু ভেঙে শক্তি নিঃসরণের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। এজন‍্য ১৯৪৪ এ রসায়নবিদ‍্যায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অটো হানকে মানুষ বলেছে ফাদার অফ নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি।
কিন্তু এ হল ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম এর মতো ভারি পরমাণুকে ভেঙে ক্ষুদ্রতর পরমাণুতে রূপান্তরিত করে শক্তি নিঃসরণ।
হিরোশিমায় যে বোমা ফেলা হয়েছিল, সেই লিটলবয় এ ছিল ইউরেনিয়ম ২৩৫ আর নাগাসাকিতে ফেলা ফ‍্যাটম‍্যান বোমায় ছিল প্লুটোনিয়াম।
লিটলবয়ের ভর ছিল ৪৪০০ কিলোগ্রাম। বিস্ফোরণে শক্তি নির্গত হয়েছিল পনেরো কিলোটন টিএনটির সমতুল। আর ফ‍্যাটম‍্যানের ভর ছিল ৪৬৭০ কিলোগ্রাম। বিস্ফোরণে শক্তি নির্গত হয়েছিল একুশ কিলোটন টিএনটির সমতুল।
আমেরিকা জাপানের উপর এমন সাংঘাতিক পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে সারা পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিকে একটা স্পষ্ট ও শক্ত বার্তা দিতে চাইল। সে আসলে চোখরাঙানির সমতুল।
বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে স্ট‍্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রুমানিয়া, পোল‍্যাণ্ড, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশে নিজেদের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে মনোমত বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এগুলিকে পুতুল সরকার বললেই ভাল হয়। দেশের মাটিতে জনপ্রিয়তা ও গণভিত্তি লাভ না করেই পূর্ব ইউরোপের এইসব দেশগুলিতে যে নেতারা সোভিয়েতের সৌজন্যে ক্ষমতা পেলেন, লোকজন তাঁদের ভাল চোখে দেখল না। এইসব দেশে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ নিশ্চিতরূপে হিটলারের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু হিটলারের বদলে স্ট‍্যালিনের একনায়কতন্ত্র তাঁদের পছন্দসই হয় নি। এঁরা অনেকেই মেধাবী বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী ছিলেন।
হাঙ্গেরিতে এমন এক প্রতিভাধর বিজ্ঞানী ছিলেন এডওয়ার্ড টেলার ( ১৫.০১.১৯০৮ – ০৯.০৯.২০০৩)। আর পোল‍্যাণ্ডের এক ইহুদি পরিবারের স্টানিসল মারসিন উলাম ( ০৩.০৪.১৯০৯ – ১৩.০৫.১৯৮৪)।
টেলার ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী আর উলাম ছিলেন গণিতবিদ ও পরমাণু বিজ্ঞানী। এই দুজনেই দেশ ছেড়ে আমেরিকার পরমাণু কর্মসূচিতে জড়িয়ে পড়েন। এই টেলার উলাম জুটি আমেরিকার মাটিতে দুনিয়ার প্রথম হাইড্রোজেন বোমার জন্ম দেন। সেই বোমার নাম ছিল আইভি মাইক। প্রশান্ত মহাসাগরের মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের এনেওয়েটক অ্যাটলের এলুজল‍্যাব এলাকায় ১৯৫২ সালের পহেলা নভেম্বর ফাটানো হয় আইভি মাইককে। তাতে ১০.৪ মেগাটন টিএনটির সমতুল শক্তি নির্গত হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা, দুটি দেশই হিটলার তথা অক্ষশক্তির বিপ্রতীপে মিত্রশক্তির পতাকাতলে দাঁড়ালেও, এই মিত্রতার গোড়ায় যে খুব একটা শুভবুদ্ধির অনুপ্রেরণা ছিল না, তা স্বীকার করা ভাল। হিটলার মুসোলিনি আর জাপানের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতনের পর বিপক্ষে তেমন জোরদার কেউ না থাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, মিত্রশক্তির এই দুই বড় শরিক মিত্রতা ভুলে, পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ভুলে পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামল।
আর এর ভিতর বোনা রইল গুপ্তচর দিয়ে তথ‍্যচুরির কৌশল। জাপানের উপর আমেরিকার পারমাণবিক দৌরাত্ম্য দেখে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের শখ হয়েছিল, তারাও একটা অমন বোমা ফাটাবে। তারা আমেরিকার প্লুটোনিয়াম পরমাণু বোমার তথ‍্য চুরির অভিপ্রায়ে গুপ্তচর লাগাল। ক্লাউস ফুকস, থিওডোর হল, ডেভিড গ্রীনগ্লাস প্রমুখ গুপ্তচরদের সহযোগিতায় তথ‍্যসংগ্রহ করে ল‍্যাভরেনটি বেরিয়ার নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৌশলীরা ফ‍্যাটম‍্যান বোমার একটি নকল সংস্করণ তৈরি করল। তার নাম দেওয়া হল আরডিএস -১। ১৯৪৯ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে সে বোমা ফাটানো হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার সঙ্গে পাল্লা দিতে চাচ্ছে আন্দাজ করে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হ‍্যারি এস ট্রুম‍্যান বেজায় খাপ্পা হলেন। ১৯৫০ সালের ৩১ জানুয়ারিতে ট্রুম‍্যান ঘোষণা করে দিলেন যে, আমেরিকা নতুন প্রযুক্তির আরো ব‍্যাপক ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বানিয়ে ফাটাবে। সেই শুরু। যুদ্ধবাজ আমেরিকার তাঁবেদার পরমাণু বিজ্ঞানীরা হাইড্রোজেন বোমার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। কিন্তু খামোখা বেঁকে বসলেন আমেরিকান পরমাণু বোমা কর্মসূচির একেবারে প্রথম সারির কীর্তিমান জে রবার্ট ওপেনহাইমার। যে ওপেনহাইমার ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ম‍্যানহাটান প্রজেক্টে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে ট্রিনিটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গীতা আউড়ে ফাদার অফ অ্যাটমিক বম্ব বনেছিলেন, সেই তিনি হাইড্রোজেন বোমা বানাবার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ব‍্যস, আমেরিকার সমরলোলুপ প্রশাসন ওপেনহাইমারকে অবহেলা ভরে ঝেড়ে ফেলে হাইড্রোজেন বোমা নিয়ে অগ্রগতি অব‍্যাহত রাখতে চাইল। অবশ‍্য ওপেনহাইমারকে অসম্মানিত করতে টেলার মহোদয়েরও কিঞ্চিৎ অবদান ছিল। টেলার মানুষটাই অমন কুচক্রী ধাঁচের ছিলেন। তিনি তাঁর বোমা বানাবার সহযোগী উলামের অবদান কতটুকু, সে নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। যাই হোক, টেলার উলাম যুগলবন্দি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ‍্যারি এস ট্রুম‍্যানের হাইড্রোজেন বোমা বানাবার হুমকি সফল করে ফেললেন। ১৯৫২ সালের পহেলা নভেম্বর আমেরিকান দম্ভ আইভি মাইক নামে হাইড্রোজেন বোমা ফাটাল। তবে এর মধ‍্যে একটু অদৃষ্টের পরিহাস ছিল। হাইড্রোজেন বোমার জনক বলে পরিচিত টেলার মহোদয় মাইক বোমা ফাটানোর মঞ্চে উষ্ণ আমন্ত্রণ পেলেন না। টেলারের মনে হল, বোমা ফাটানোর এলাকায় আমেরিকান প্রশাসন তাঁকে অবাঞ্ছিত ভাবছেন। বার্কলের বেসমেন্টে একটা হলঘরে সিসমোগ্রাফ দেখে তিনি মাইকের বিস্ফোরণ নিয়ে তথ‍্য সংগ্রহ করলেন। ওপেনহাইমার এর মতো ট্রিনিটি বিস্ফোরণ স্বচক্ষে দেখার সুযোগ তাঁর এল না। চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।
আর অনেক দিন পর, প্রায় নয় বৎসর কাটলে, অনেক কেঁদে ককিয়ে ওপেনহাইমার সাহেব আবার নিজের অবস্থার কিছুটা উন্নতি করতে পারলেন।
হাইড্রোজেন বোমা বা ছোট করে এইচ বম্ব বলতে থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাকে বোঝায়। এ ধরনের বোমাতে অত‍্যধিক উচ্চ তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন এর আইসোটোপ সংযুক্ত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে। একে বলে নিউক্লিয়ার ফিউসন। আমেরিকার যুদ্ধোন্মাদদের বানানো প্রথম হাইড্রোজেন বোমা আইভি মাইক সাফল্যের সঙ্গেই ফেটেছিল। বোমা ফাটানোর জায়গাটা ছিল মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। সেখানে এনিওয়েটক অ্যাটল। অ্যাটল কি জিনিস? অ্যাটল হল লেগুনকে ঘিরে থাকা আংটির মতো প্রবালপ্রাচীর, বা দ্বীপ, বা দ্বীপপুঞ্জ। কিন্তু লেগুন কি? লেগুন হল প্রবালপ্রাচীর বা দ্বীপ বা উপদ্বীপ দিয়ে বিচ্ছিন্ন একটা অগভীর জলাশয়।
লেগুন দুই রকম। সমুদ্র সৈকতের লেগুন আর অ্যাটল লেগুন। মার্শাল দ্বীপপুঞ্জে তেইশটি দ্বীপের অন‍্যতম আরো একটি হল বিকিনি অ্যাটল। আজ থেকে সাতষট্টি বছর আগে ১৯৫৪ সালের পহেলা মার্চ, সেই বিকিনি অ্যাটলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ক‍্যাসল ব্র‍্যাভো নামে একটা সাংঘাতিক হাইড্রোজেন বোমা ফাটায়। আমেরিকার যুদ্ধবাজ প্রশাসনের তরফে একটার পর একটা হাইড্রোজেন বোমা ফাটানোর একটাই লক্ষ্য, গলা উঁচিয়ে বলা, বিশ্ববাসী দেখে নাও, চাইলে তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার ক্ষমতা ধরে আমেরিকার যুদ্ধোন্মাদ প্রশাসন। ১৯৫৪ সালে মার্কিন ডলারের মূল‍্যমান অনুযায়ী ক‍্যাসল ব্র‍্যাভো হাইড্রোজেন বোমাটি তৈরি করতে খরচ পড়েছিল মোটামুটি সাতাশ লক্ষ ডলার ছুঁইছুঁই। বোমাটি লম্বায় ছিল সাড়ে চার মিটার, আর ব‍্যাস ছিল ১.৩৭ মিটার। বোমার ডিজাইন তৈরি করা হয়েছিল ১৯৫৩ সালের চব্বিশ ফেব্রুয়ারি। আর ডিজাইন অনুযায়ী লস অ্যালামোস ন‍্যাশনাল ল‍্যাবরেটরি বোমাটি বানায় ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে। ক‍্যাসল ব্র‍্যাভো বোমাটির ভর ছিল ১০৬৫৯ কিলোগ্রাম। বোমার মধ‍্যে ছিল লিথিয়াম ৬। লিথিয়াম ৭ আইসোটোপ এর কিঞ্চিৎ পরিমাণ মিশেছিল তাতে। তাতেই মারণাস্ত্রটি আরো সাংঘাতিক হয়ে উঠেছিল। পনেরো মেগাটন টিএনটির বিস্ফোরণ ক্ষমতার তুল‍্য হয়ে উঠল ক‍্যাসল ব‍্র‍্যাভো।
বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় জঞ্জাল ছড়িয়ে পড়ল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। জঘন্যতম তেজস্ক্রিয় দূষণ ঘটিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নাম দাগিয়ে তুলল ক‍্যাসল ব্র‍্যাভো।
বাহান্ন সালের নভেম্বর, আর চুয়ান্ন সালের মার্চ, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আমেরিকান হাইড্রোজেন বোমার দাপাদাপি দেখে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের বুক ফাটতে শুরু করে। হাইড্রোজেন বোমা নিয়ে আমেরিকার লোফালুফি খেলা দেখে তাদের পক্ষে চুপ করে থাকা শক্ত হল। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধোন্মাদ শক্তি স্থির করল তারা এমন বিপুল আকৃতির একটা হাইড্রোজেন বোমা ফাটাবে, যার আকার প্রকার কেউ কখনো টপকে যেতে পারবে না। সাতাশ হাজার কিলোগ্রাম ভর নিয়ে বিশ্ববাসীকে চোখ রাঙাতে তৈরি হল জার বোম্বা। সাংকেতিক নাম এএন ৬০২, বা ইভান, বা ভানিয়া। লম্বায় আট মিটার, ব‍্যাস ২.১ মিটার দানবিক বোমাটা ফাটানো হল নোভায়া জেমলিয়ার সেভেরনি দ্বীপপুঞ্জের সুখোয় নোস অন্তরীপে। তারিখটা ছিল ১৯৬১ সালের ত্রিশ অক্টোবর। একটা তু ৯৫ ভি বিমানের সাহায্যে মাটি থেকে চার হাজার মিটার বা তেরো হাজার ফুট উচ্চতায় তুলে নিয়ে গিয়ে জার বোম্বাকে ফাটানো হয়। বোমাটির বিস্ফোরণে পঞ্চাশ মেগাটন টিএনটির সমতুল শক্তি নির্গত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ায় জারের অপশাসন দূর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হয়। আর ১৯৬১ এর অক্টোবরে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে জার বোম্বা ফেটে সর্বকালের সাংঘাতিকতম বিস্ফোরণ হিসেবে নাম কিনল। এই জার বোমা তৈরির প্রধান স্থপতিদের অন‍্যতম ছিলেন আন্দ্রেই দিমিত্রিয়েভিচ শাখারভ ( ২১.০৫.১৯২১ – ১৪.১২.১৯৮৯)। শাখারভ ছিলেন বড়মাপের পরমাণু বিজ্ঞানী। ১৯৭৫ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এই ২০২১ বৎসরটি তাঁর জন্মশতবর্ষ। তাঁর তৈরি জার বোমাও ষাট ছুঁয়ে ফেলল।
শাখারভকে সোভিয়েত যুদ্ধোন্মাদরা প্রগাঢ় সম্মান প্রদর্শন করেছেন। ১৯৫৩ সালের মার্চে স্ট‍্যালিনের মৃত্যু হয়। ওই ১৯৫৩ সালেই শাখারভকে স্ট‍্যালিন পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল। তারপর ১৯৫৬ সালে পেলেন লেনিন পুরস্কার।
সোভিয়েত যুদ্ধ পাগলরা জার বোমা ফাটানোর দশ বৎসর পর, ১৯৭১ সালে ছয় নভেম্বর, আলাস্কার আমচিটকা দ্বীপে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন মাটির অনেক গভীরে পৌনে দুই কিলোমিটারেরও বেশি গভীরে একটা বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
আমেরিকার হাজার হাজার শান্তিপ্রিয় ভদ্র সচেতন নাগরিক আমেরিকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের এই পরমাণুবিস্ফোরণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে পথে নামে। শান্তিপূর্ণ অবরোধ করে। এমনকি একটা জাহাজ যোগাড় করে অকুস্থলে গিয়ে বাধা দেবার জন‍্য জলে ভেসে পড়ে। জাহাজের নাম তারা দিয়েছিল গ্রিনপিস।
কান্নিকিন নামে ওই হাইড্রোজেন বোমাটা সাংঘাতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। হিরোশিমায় যে লিটলবয় নামে বোমাটা ফেলা হয়েছিল, কান্নিকিন তার থেকে তিনশো পঁচাশিগুণ বেশি বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। পাঁচ মেগাটন টিএনটির সমান বিস্ফোরণের ক্ষমতা ছিল ওর।
আমেরিকার সাধারণ মানুষ প্রশাসনের এই পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে পথে নেমে বলেছিলেন, ডোন্ট মেক এ ওয়েভ। এইভাবে মাটির অত গভীরে অত বিধ্বংসী বোমা ফাটালে ভূমিকম্প ও সুনামি হতে পারে। তারা অ্যান্টি নিউক্লিয়ার কমিটি ফর নিউক্লিয়ার রেসপনসিবিলিটি নাম দিয়ে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টে মামলা আনে। মোট সাতজন বিচারপতির বেঞ্চে চারজন সরকারকে সমর্থন করেন। বাকি তিনজন আন্দোলনকারীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট নাগরিকের অধিকারের পাশে দাঁড়ায় নি। শান্তির আসল গ‍্যারান্টি নাগরিকের সচেতনতায়। আমেরিকার ভিতরেও নানাবিধ শক্তি নিয়ত লড়াই করে চলেছে। আমেরিকাতেও এক‌ই সাথে পরস্পরবিরোধী শক্তি কাজ করে চলবে, এটা স্বীকার করতে হবে। ১৯৬১তে অমন সাংঘাতিক বোমা ফাটানোর টেকনোলজি সোভিয়েতকে বাঁচাতে পারে নি। গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার দাপটে পরবর্তী ত্রিশ বছরের মধ‍্যে চুরমার হয়ে যায় সোভিয়েত। সারা পৃথিবীতে শোষিত বঞ্চিত মানুষের স্বার্থে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর দাবি তুলে বোমা ফাটানোর প্রতিযোগিতাকে রুখে দিতে হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।