দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৩৭)

পর্ব – ২৩৭

মা বললেন, দাদামণি, আপনি যে ওকে অত বলছেন, ও মনে রাখতে পারবে?
জ‍্যাঠাইমা হাসছেন।
ভ্রূ কুঁচকে জ‍্যাঠামশায় বলছেন, জানো নিশ্চয়ই, বেদকে বলত শ্রুতি। কেন বলত বলো তো? মানুষ শুনে শুনে তাকে মনে রাখত। তখন তো কাগজ ছিল না।  মনের মধ্যে জমিয়ে রাখত এইরকম ছাত্ররা। চারটে বেদ। ঋক্ সাম যজুঃ আর অথর্ব। প্রত‍্যেকটার আবার দুটো করে ভাগ। ব্রাহ্মণ আর সংহিতা। আর আয়ুর্বেদ হল পঞ্চম বেদ। তারপর এল বেদান্ত। এল উপনিষদ। পরে পরে রামায়ণ মহাভারত। আরো পরে পুরাণকথা।  মানুষ এগুলো মনে রাখত। শুধু রাখত না। গেঁথে রাখত। তাইতো?
মা ঘাড় নাড়েন।
জ‍্যাঠামশায় প্রশ্ন করেন, বলতো বৌমা, কি করে রাখত?
মা হালে পানি পান না।
শোনো বলি। এই যে আমাদের মগজ, যাকে বলে মস্তিষ্ক, বা ব্রেন, তার তিনটে বড় বড় ভাগ। শিরদাঁড়াটা যেখানে মাথার মধ‍্যে ঢুকে পড়ল, সেটা ব্রেন স্টেম। ভাল বাংলায় সুষুন্মাশীর্ষক। তার উপরে সেরিবেলাম। বাংলায় ওকে বোলো লঘু মস্তিষ্ক। আর মাথার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্ক। তার‌ই ওপরের অংশের নাম কর্টেক্স। এই কর্টেক্স জিনিসটাই হল আমাদের ব্রেনের আসল জিনিস। এই কর্টেক্সটা অনেক বিকশিত হয়ে অন‍্য জীবদের থেকে মানুষকে অনেক বেশি উন্নত করে দিয়েছে।
আমাদের যে গুরু মস্তিষ্ক, মানে সেরিব্রাম, তার দুটো বড় ভাগ। ডান অর্ধগোলক আর বাম অর্ধগোলক। এই বাম অংশটাই ভাষা নিয়ে ভাবে। কথা বলায়। আর পুরো ব্রেনটার উপর খবরদারি করে। মজার ব্যাপার হলো মস্তিষ্কের এই বাম অংশটা চালায় শরীরের ডানদিককে। আর ডান অংশটা চালায় বামদিককে। বামদিকটা সব কিছুই চিরে চিরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বুঝতে চায়। ডানদিকটা সকলকে একযোগে, সামগ্রিক ভাবে দ‍্যাখে। এই সেরিব্রাম এর আবার কতকগুলো ভাগ আছে। বাড়িতে যেমন একটা ঠাকুর ঘর, রান্না ঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর, বসার ঘর থাকে, সেই রকম। ব্রেনের এই সব খুপরিগুলোর নাম ফ্রন্টাল লোব, প‍্যারেইটাল লোব, অকসিপিটাল লোব, টেম্পোরাল লোব, এই রকম। সবগুলোর নির্দিষ্ট কাজ আছে। তবে ওরা তালমিল করে বোঝাপড়া করে কাজ করে।
ফ্রন্টাল লোব ব‍্যক্তিত্ব, ব‍্যবহার, আবেগ, বিচার, পরিকল্পনা, সমস্যা সমাধান, কথা বলা, লেখা, শরীর নাড়ানো, বুদ্ধি শুদ্ধি, মনঃসংযোগ আর আত্ম সচেতনতার মতো জিনিস গুলো দ‍্যাখে।
প‍্যারেইটাল লোব ভাষাকে ইন্টারপ্রেট মানে বুঝে উঠতে সাহায্য করে। শব্দকে বুঝতে সাহায্য করে। ছুঁয়ে বুঝতে, ব‍্যথা অনুভব করতে, দেখে বা শুনে আঁচ করতে সাহায্য করে। ভিসুয়াল পারসেপশন দেয়। কোনটা কতটা লম্বা, কোনটা সাইজে বড়ো, কোনটা দূরে, কোনটা কাছে, এসব বুঝতে সাহায্য করে।
 অকসিপিটাল লোব আবার যা দেখছি তা কি রঙের জিনিস, তাতে আলো কতটা পড়ছে, তা নড়ছে কি না, এসব বুঝতে সাহায্য করে।
 টেম্পোরাল লোব আবার ভাষা বুঝতে সাহায্য করে, স্মৃতির ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে, কানে শোনায়, আর কোনটার পর কোনটা করতে হবে, তা ভাবতে সাহায্য করে।
আমাদের স্মৃতি নানারকম। কোনোটা অল্পকালের, কোনোটা বেশিদিনের, আবার কোনোটা অভ‍্যাসের সাথে জড়িয়ে যায়। কি রকম জান? ধরো, ডায়েরি থেকে একটা টেলিফোন নম্বর বললাম। শুনে শুনে তুমি টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাচ্ছ। খাতায় লেখা আছে নম্বরটা। মুখস্থ করার দরকার নেই। তবু ওই যে শুনে মনে ধরে নিয়ে ডায়াল ঘোরালে, ওকে বলবে শর্ট টার্ম মেমোরি। এক মিনিট অবধি স্মৃতি ধরে রাখতে পারবে। আর সাতটা অবধি আইটেম। তার পর ওই স্মৃতি মুছে যাবে।
এই শর্ট টার্ম মেমোরি রাখার কাজ হয় প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্স‌এ।
আর ধরো কোনো ঘটনা মনে রাখছ, ধরো তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান, ধরো তোমার খোকা দাঁড়াতে শিখল, সেই সব, যেগুলো বেশিদিন থাকে, ওরা থাকে হিপ্পোক‍্যাম্পাসে। আর মনে করো হারমোনিয়ামে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছ, রান্না করছ, তোমার বড়ো জা উল বুনছেন, খোকা সাইকেল চড়ছে, এগুলো সব স্কিল মেমোরি। এরা থাকবে সেরিবেলাম এ।
এই যে কর্টেক্স বলছিলাম, এতে আছে ষোলো বিলিয়ন নিউরন। আর সেরিবেলাম এ আছে সত্তর বিলিয়ন নিউরন।  মোট ছিয়াশি বিলিয়ন নিউরন নিয়ে তোমার পুঁজি। বিলিয়ন মানে?
খোকা বলল, বিলিয়ন মানে একেরপর নয়খানা শূন‍্য। টেন টু দি পাওয়ার নাইন।
জ‍্যাঠামশায় বললেন, এটাই তোমার লঙটার্ম মেমোরি। তুমি ঠিক ঠিক মনে রেখেছ।
জ‍্যাঠাইমা বললেন,
যিনি মহারাজা,
বিশ্ব যাঁর প্রজা,
আমি পুত্র তাঁর,
সামান‍্য তো ন‌ই
রাজপুত্র হ‌ই,
তাঁর ধনে মোর
পূর্ণ অধিকার।
জ‍্যাঠামশায় হেসে বললেন, এটাও তোমার লঙটার্ম মেমোরি।
খোকা হাত উঁচিয়ে বলল, ছিয়াশি বিলিয়ন!
মা অবাক হয়ে গেলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।