ক্যাফে গপ্পো -তে মানসী রায়

চাঁদের আলোয়

অতি কষ্টে চোখ খুলে ঝুম্পা দেখল তার চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার। বিনবিন করে মশা ওড়াউড়ি করছে। নিশ্চয়ই সন্ধে হয়ে গেছে আর দরজা-জানলাগুলো বন্ধ, নইলে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে সামান্য হলেও আলো আসত। ঝুম্পা উঠে বসার চেষ্টা করতেই টের পেল কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি অসহ্য যন্ত্রণা, নড়াচড়া করা প্রায় অসম্ভব। অগত্যা আবার শুয়ে পড়ল। কপালের টনটনে জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল – দগদগ করছে। কে জানে কতটা রক্ত বেরিয়েছে! শরীরের নীচে শক্ত মেঝে আঠা আঠা হয়ে আছে। ঝুম্পা আন্দাজ করার চেষ্টা করল বাড়ির ঠিক কোন জায়গাটায় ও আছে। গৌরাঙ্গ আর তার মা-বাবা মিলে যখন আচমকা ওর উপর চড়াও হল, তখন ও রান্নাঘরে। সবে ডালটা চড়িয়েছে। চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুঁষি তো ছিলই, সেটা রোজকার ব্যাপার, যেটা নতুন সেটা হল দরজার খিল দিয়ে পেট, কোমর, পা, পিঠ ও ঘাড়ে দমাদ্দম নাগাড়ে পিটুনি। তবে এসব অবশ্য বেশিক্ষণ ঝুম্পাকে সহ্য করতে হয়নি। ওই রকম অমানুষিক মারের চোটে একটু পরেই নীচু মশলার তাকের কোণায় কপালটা সজোরে ঠুকে গেছিল। ব্যাস, তারপর তার আর কিচ্ছু মনে নেই। হালকা একটা পোড়া গন্ধ আসছে। দুপুরের ডালটা কি? তাহলে এটা সম্ভবত রান্নাঘরই। তবে বাড়িতে যে কেউ নেই সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঝুঁঝকো অন্ধকারে পুরো বাড়িটা নিঝুম।
তার মানে তাকে ওই অবস্থায় ফেলেই গৌরাঙ্গ এবং তার শ্বশুর, শাশুড়ি পালিয়েছে! হয়তো ভেবেছিল সে মরে গেছে। সর্বাঙ্গে তীব্র ব্যথা নিয়েও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল ঝুম্পা। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ড খুঁজে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখল কোনও লাভ নেই। হয় লোডশেডিং নয়তো ইলেকট্রিকের লাইনটা ওরা কেটে দিয়ে গেছে। বছর খানেক আগেই কলকাতার কাছে বাঁকড়াহাট অঞ্চলের এই ফাঁকা জায়গায় গৌরাঙ্গ বাড়িটা করেছিল। বাড়ি মানে দুটো টালির ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা বাথরুম-পায়খানা। চতুর্দিক শুনশান, কেবল গাছপালা আর পানাপুকুর। জনবসতি এখনও নামমাত্র এই এলাকায়। এর আগে গৌরাঙ্গরা কলকাতার একটা বস্তিতে থাকত। ওই বস্তির লাগোয়া একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে প্রায়ই ইলেক্ট্রিকের কাজ করতে যেত গৌরাঙ্গ। সেখানে আবার ঝুম্পাও এক বুড়ির কাছে আয়ার কাজ করত। তার পর যা হয়…মাধ্যমিক পাশ ঝুম্পার মনে হয়েছিল তার অকর্মণ্য, মাতাল, বৌ-মেয়ে পেটানো বাপের হাত থেকে নিস্তার পেতে গেলে গৌরাঙ্গর হাত ধরা ছাড়া উপায় নেই! কিন্তু পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার পর গৌরাঙ্গর বস্তির বাড়িতে এসে বুঝল সব সংসারই আদতে অচল টাকার এপিঠ আর ওপিঠ! নিত্যি তাকে উঠতে বসতে গঞ্জনা দিত শাশুড়ি-শ্বশুর। সে ভিখিরির মতো কানাকড়িও না নিয়ে তাদের সোনার ছেলের বৌ হয়ে এসেছে! লজ্জা থাকলে সে যেন অবিলম্বেই বাপের কাছ থেকে টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি, জিনিসপত্র নিয়ে আসে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা গৌরাঙ্গকে ওসকাতেও ছাড়তনা এবং বলাই বাহুল্য, গৌরাঙ্গ তাদের দল ভারী করে বাধ্য ছেলের মতো দু-চার ঘা লাগিয়ে তাদের যোগ্য সঙ্গত করত। গরীবের গলার জোর আর খিস্তিই ভরসা। সেসবের জোরেই ঝুম্পা যাবতীয় চাপ ঠেকিয়ে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি হলনা!
শরীরটাকে হিঁচড়ে দরজার কাছে এল ঝুম্পা। একবার টানতেই দরজা খুলে গেল। যন্ত্রণার মধ্যেও তার ঠোঁটে ব্যাঙ্গের হাসি খেলে গেল। তাহলে ওরা পাকাপাকি ভাবেই পালিয়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। ঝুম্পা একবার ভাবল চিৎকার করে। কিন্তু শুনবে কে? সে বুঝতে পারছে এখনই থানায় যাওয়া উচিত। তিনজন কোনও রকম শাস্তি ছাড়াই বেঁচে থাকবে, এ হতে দেওয়া যায়না! কিন্তু এই শরীরটা নিয়ে সে ততদূর যেতে পারবে কি? রাস্তার মিটমিটে আলোর মধ্যে দিয়ে কে যেন তার বাড়ির দিকেই আসছে। কে রে বাবা! গৌরাঙ্গ নাকি? দেখতে আসছে সে মরে গেছে না বেঁচে আছে? রাস্তায় আলো কম থাকলেও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। লোকটা আরেকটু কাছে আসতেই ঝুম্পা বুঝল এ গৌরাঙ্গ নয়। তবে মুখটা খুব চেনা। লোকটা ক্রমশ তার দিকে এগোচ্ছে আর তখনই বিদ্যুচ্চমকের মতো ঝুম্পার মনে পড়ে গেল লোকটার নাম আসিফ! গৌরাঙ্গর ফোনে একটা ভিডিওতে সে একে কয়েকবার দেখেছে। যতদূর মনে পড়ছে, লোকটা ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। ছেলেধরা সন্দেহে কিছু লোক তাকে প্রচণ্ড মারছিল…আর সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হাতজোড় করে তাদের কাছে কেঁদে কেঁদে প্রাণভিক্ষা করছিল…. তা সত্ত্বেও সেই লোকগুলো ওকে নৃশংস ভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে একেবারে মেরেই ফেলল! এই চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনার পুরোটা রেকর্ড করে সেটা ছড়িয়ে দিয়েছিল কেউ। গৌরাঙ্গ রোজ রাতে ভিডিওটা দেখত।
আসিফ প্রায় তার সামনে চলে এসেছে। ধবধবে জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, যেমনটা ওই ভিডিওতে তার মরা মুখে দেখা যাচ্ছিল।…ঝুম্পা আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ বের করার শক্তিটুকু পর্যন্ত যেন লোপ পেয়েছে! কিন্তু…কিন্তু… কী আশ্চর্য, আসিফের চোখে তো রিরংসার ছিটেফোঁটাও নেই! ছলছলে চোখে বরং গভীর বেদনার ছাপ। সে পরম মমতায় ঝুম্পার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। কেন কে জানে, ঝুম্পার আর ভয় করছিল না। ভুল হোক বা ঠিক, তার আবারও মনে হচ্ছিল আসিফের হাত ধরে চলে যায়। এই বাড়িতে তো তার জন্য আর কিছুই পড়ে নেই। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে ঘরের ভেতরে নিজের পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মৃতদেহটাকে শেষবারের মতো দেখে নিল ঝুম্পা…
……………………………….
ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। এক থেকে দুই, তিন, চার, পাঁচ, অগুন্তি হয়ে ওরা হেঁটে যায়। তবুও এই নির্লিপ্ত চরাচরে নির্মম চাঁদের আলো ওদের কোনও ছায়া ধরে রাখে না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *