সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৩১)

মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস

ইওর অনার, যদি আপনি অনুমোদন করেন, তাহলে আজ আমি এখানে থামতে চাই, এবং আগামীকাল সকালে পুনরায় বাকি বক্তব্য বলার অনুমতি চাই।

(এই সময় আদালত মুলতবি হল, এবং পরদিন সকাল দশটায় পুনরায় চালু হলে মিস্টার অ্যালবার্ট পারসনস তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন।)
ইওর অনার, গতকাল সন্ধ্যায় আমি আপনার কাছে আমার বক্তব্যের সেই অংশটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যাতে আমাদের বিরাজমান সমাজব‍্যবস্থাটার কার্যপ্রণালী আর তার ফলাফল দেখানো যায়। বলতে চেয়েছি, এই  বিরাজমান ব‍্যবস্থায় একচেটিয়া পুঁজি মালিকেরা উৎপাদনের সকল উপকরণ আর সব রকম সম্পত্তি মুঠোয় পুরে রেখে শ্রমজীবী মানুষকে অর্থনৈতিক ভাবে অবনমিত ও মুখাপেক্ষী করে রেখেছে, আর এই অসম ব‍্যবস্থার গভীর থেকে উৎসারিত হচ্ছে যত অনাচার আর অপরাধ।
আমি বোঝাতে চেয়েছি যে, সামাজিক দুঃখ জ্বালা, মানসিক অধঃপতন, রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব, ইত্যাদি যা কিছু সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক, তা এই একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের একচ্ছত্র আধিপত্যজনিত অব‍্যবস্থা থেকে জন্মাচ্ছে। জীবন ধারণের সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে নিয়ে শ্রমজীবীদের উপর একচেটিয়া পুঁজিপতিদের চাপিয়ে দেওয়া এই অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার কারণেই বর্তমান সমাজে এতসব জটিল সমস্যা। যতদিন পর্যন্ত একচেটিয়া পুঁজি মালিকেরা উৎপাদনের উপকরণ আর সম্পদের উপর এমন দখলদারি কায়েম রাখবে, কিছুতেই সামাজিক সমস‍্যাগুলির মীমাংসা হবে না। মনে করে দেখবেন, আমি ব্র‍্যাডস্ট্রিটের দেওয়া তথ‍্য উল্লেখ করে দেখিয়েছি, কিভাবে মধ‍্যবিত্ত শ্রেণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
যেমনটি করে ছোট ছোট কারবারি আর মধ্যবিত্ত মানুষেরা একচেটিয়া পুঁজির লাগাতার আক্রমণে শেষ হয়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত কৃষকশ্রেণীও ওই একই রকমভাবে বিপদে পড়ছে । সংখ্যাতত্ত্ব বলছে আমেরিকার ফার্মগুলির নব্বই শতাংশ আজ বন্ধকগ্রস্ত। এই কয়েক বছর আগেও যে মানুষটা জমির মালিক হিসাবে নিজের জমিতে স্বাধীন ভাবে খাটত আজ সে জমি বন্ধক দেওয়ার কারণে ভাড়াটে মজুর হিসাবে কাজ করছে। আজ তার জমি  তার আর নিজের নেই। যে হাত দিয়ে মাটি চষে সে গোলাপ ফুটিয়েছে, ফলিয়েছে ভাল ভাল  ফল, দেখিয়েছে মানুষ চেষ্টা করলে কত চমৎকার ফসল ফলাতে পারে, সে আজ ঋণগ্রস্ত হয়ে শুষ্ক ও ফ্যাকাশে মুখে দিন গুজরান করে। এমনকি যখন সে হা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে তখনও তার মাথায় জমি বন্ধক দিয়ে নেওয়া ঋণের বোঝা তড়বড় করে বাড়তে থাকে। ঋণ আর সুদের বোঝা ক্রমেই বেড়ে চলতে চলতে নীচের থাকের  মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে চলেছে। এরই উপর এসে পড়ল রেলওয়ে কর্পোরেশনগুলোর বোঝা। চাষী আর ফসলের দাম পায় না। বোর্ড অফ ট্রেডের হাঙর মুখো মালিকেরা চাষীকে দারুণভাবে জব্দ করে। কি রকম? চিকাগো ট্রিবিউন কাগজে সে তথ্যটা উঠে এসেছিল । মালবাহী ট্রেনে আইওয়া থেকে একটা গাড়ি ভুট্টা ফড়ের কাছে পাঠিয়ে যা দাম পাওয়া গেল, তাতে ট্রেন ভাড়াটুকু উঠল না। চাষী পুরো মাল বিক্রি করে যে পয়সাটুকু হাতে পেল, তাতে ফড়ের কমিশন বাদ গেলে যা রইল, তার থেকে ট্রেন ভাড়া তিন ডলার বেশি। তার মানে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ফসল ফলিয়ে ট্রেনযোগে বাজারে পাঠালে চাষীর লোকসান তিন ডলার । আমেরিকার চাষীদের সাথে রেল কর্তৃপক্ষ আর ফড়েরা এই রকম গ‍্যাঁড়াকল বাধিয়ে রেখেছে । ইওর অনার, আজ আর জমিদারতন্ত্রের কুফল বোঝবার জন্য আয়ারল্যান্ডে যাবার দরকার পড়ে না। জমিদারেরা রায়তকে কিভাবে উচ্ছেদ করে সেটা বোঝার জন্য আর আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে অন্যত্র যাবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে । রক্তচোষা জমিদারতন্ত্র আজ আমেরিকায় রাজ করছে। এই চিকাগোয় এবং আমেরিকার সর্বত্র যেখানেই আপনি চোখ রাখবেন, দেখতে পাবেন আয়ারল্যান্ডে যেমন ভাবে জমিদারেরা চাষীর উপর অত্যাচার করে ইতিমধ্যেই তা আমেরিকা শিখে নিয়েছে।
ব্রিজপোর্টের দিকে তাকিয়ে দেখুন, ওখানেই তো আইরিশ শ্রমিকরা থাকে । তাকিয়ে দেখুন, ওরা কিভাবে বস্তির ঘুপচি ঘরে গাদাগাদি করে থাকে । সরকারের অ্যাটর্নি গ্রিনেল বলেছেন ওরা ইঁদুর । হ্যাঁ, আইরিশ শ্রমিকেরা ঠাসাঠাসি বস্তির নোংরা জরাজীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে কুটিরে ইঁদুরের মতোই গাদাগাদি করে থাকে। হ্যাঁ আয়ারল্যান্ডের শ্রমিকেরা সেদেশের রাজধানী ডাবলিনেও ওভাবেই থাকে। পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক শহরেও আইরিশ শ্রমিকদের ঠিক ওই একই রকম ইঁদুরের মতো বেঁচে থাকা। ওরা জমিদারের তীব্র শোষণ পীড়নের শিকার হয়ে মৃত্যুর জন্য দিন গোনে। অভিযোগকারী পক্ষ আমাদের লক্ষ্য করে বলেছেন যে, আইনের মানদণ্ডে বিচার হবে। আরো বলেছেন, সরকারেরও বিচার হবে। ওঁদের পক্ষে যে সব ভদ্রমহোদয়গণ উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা জুরিদের বলেছেন, সার্বিক পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে হবে। তো আইনের মানদণ্ডে এত নিখুঁত বিচার করে, এমনকি সরকারেরও তুল‍্যমূল‍্য বিচার করে শেষমেশ কি দাঁড়াল? দাঁড়াল যে এই আমরা, বিবাদী পক্ষরা দোষী, এবং আমরা খুনের আসামী‌।
তাহলে যদি নিখুঁতভাবে বিচার হয় এবং যদি সরকারেরও বিচার হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠুক, কে এই ঘটনাকে বিচারের কাঠগড়ায় টেনে তুলল। আমি আমেরিকার নাগরিকদের ওপর এই বিচারের ভার তুলে দিচ্ছি যে, আপনারা দেখুন আদৌ অভিযোগকারী পক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে কেসটা দাঁড় করাতে পেরেছে কিনা, এবং আমি মন খুলে এই কথা বলতে চাই যে, অভিযোগকারী পক্ষ, সরকারের প্রতিনিধিরা, বিচারব্যবস্থার প্রতিভূ ব্যক্তিত্বরা যাঁরা কিনা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়বদ্ধ, তাঁরা সবাই মিলে জোট পাকিয়ে আমাদের প্রতিহিংসাবশতঃ ষড়যন্ত্র করে, নিরপেক্ষতা ও ন্যায় বিচারের সমস্ত প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে পায়ের তলায় দলে পিষে আমাদের খুন করাচ্ছেন। আমেরিকার আইনে প্রতিটি আমেরিকান নাগরিকের অধিকার  স্পষ্টভাবে বিনির্দিষ্ট আছে। আর আইনের নাম জপতে জপতে এখানে অভিযোগকারী পক্ষ, সরকারের প্রতিনিধিরা, বিচারব্যবস্থার প্রতিভূরা এই মামলায় নিঃসংকোচে মতপ্রকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করলেন। এই মামলায় অভিযোগকারী পক্ষ প্রেসের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করলেন। শান্তিপূর্ণভাবে আইনসঙ্গত পথে জনগণের যে সমাবেশ করার অধিকার আছে সেটাকেও তাঁরা পদদলিত করলেন। আর হ্যাঁ, আত্মরক্ষার অধিকার নামে যে সভ্য সমাজের একটা রীতি আছে, সেটাকেও তারা নস্যাৎ করেছেন। এই সব মহান মানবিক অধিকারগুলি সাধারণ মানুষ বহু রক্ত ঝরিয়ে অর্জন করেছিল। আমাদের পিতৃপুরুষেরা এই সব অধিকার অর্জনের জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন। ওই যে প্রসিকিউশন পক্ষ গরিব সাধারণ মানুষকে ইঁদুর  বললেন, ওই কথার মধ‍্য দিয়ে আসলে তাঁরা আমাদের সেইসব  মহান পূর্বপুরুষদের সকলকে ইঁদুর বলে অপমান করলেন। আর তাঁদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সমস্ত কিছুকে ইঁদুরের গর্তে ঢোকানোর চেষ্টা করলেন। এ বেশ ভালো বিচারসভা বসিয়েছেন আপনারা। খুব চমৎকার আইনের নিক্তিতে বিচার হচ্ছে বটে। সরকারেরও নাকি বিচার হচ্ছে। তা বটেই তো ! প্রসিকিউশন পক্ষ আমার উপর যে অভিযোগগুলি হানছেন, আসলে ঠিক ঠিক সেই অপরাধগুলিই তাঁরা করেছেন, মোটেও আমি নই। তাঁরা আমাকে অ্যানারকিস্ট বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। আর নিজেরা প্রতিষ্ঠিত সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া পদ্ধতিকে তুচ্ছ করে বিচারের নামে প্রহসন করেছেন। ওঁরা বলছেন, ” ওদের কৃতকর্মের দ্বারাই ওদের জানা যায় “। ওঁদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কথাগুলো ঠিক ঠিক ওঁদের বিরুদ্ধেই থাকে ।
 এই মামলায় ওঁরাই হচ্ছেন প্রকৃত অ্যানারকিস্ট। আর আমরা সাংবিধানিক দায়িত্বের উপর ভর করে রয়েছি। আমরাই আমেরিকান সংবিধানের প্রাণসত্ত্বাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি। আমি এদেশের কোনো আইন অমান্য করিনি, কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করিনি। আর আমার সহযোগীরাও কেউ আমেরিকান নাগরিকদের একটিও আইনি অধিকারকে লঙ্ঘন করেননি। আমেরিকার সংবিধান নির্ভয়ে কথা বলার অধিকার দিয়েছে, বলেছে সংবাদপত্রের নির্বাধ স্বাধীনতার কথা। আরো বলেছে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত সমাবেশ করলে তাদের কোনোভাবে ক্ষতি করা হবেনা । আর আমরা আমেরিকান সংবিধানের দ্বারা ঘোষিত এই সব অধিকারের ভিত্তিতে আমাদের কাজ করেছি। আমরা আত্মরক্ষা ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সাংবিধানিক অধিকারগুলিকে এই মামলায় কার্যকর করতে দাবি করছি। আর প্রসিকিউশন পক্ষ যেভাবে আমেরিকান সাধারণ মানুষের এই সব মহান অধিকার লুণ্ঠন করতে চাইছেন তার তীব্র নিন্দা করছি। প্রসিকিউশন পক্ষ মহা আনন্দে আছেন যে তাঁরা সাতটা মানুষের মৃত্যুর দাবি তুলতে পেরেছেন। তাঁরা বলেছেন, আইন লঙ্ঘন করেছে বলে সাত সাতটা মানুষকে ফাঁসি  দিতে হবে। তাঁরা বলেছেন, আমেরিকান সংবিধান নাকি আমাদের এই সাজা দাবি করছে। তাঁরাই বলছেন নির্ভয়ে মতপ্রকাশের কথা,  আর আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক ওই অধিকারটি ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবি করেছে বলে এই ধর্মাধিকরণ আমাদের ফাঁসি দিতে বলেছেন। প্রসিকিউশন পক্ষের ভদ্রমহোদয়েরা, আপনারা কি মনে করেন আমাদের শুকনো মৃত হাড়গুলো মাটিতে চাপা দিয়ে আপনারা এই মামলায় পার পেয়ে যাবেন?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।