সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় পরিবেশ ,পরিস্হিতি ,পাল্টাচ্ছি আমারও ৷ বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীটা ছোটো হতে হতে হতে একসময় বোকাবাক্স বন্দী হয়েছিল৷ এখন তো মোবাইল ,ল্যাপটপে বন্দী ৷ হারিয়ে যাচ্ছে , আন্তরিকতা ,মেকী হয়ে উঠছি আমরা ৷ বোকাবাক্সের বন্দী তাও যেন ভালো ছিল ৷ মনে আছে ছোটোবেলায় যখন রামায়ণ মহাভারত দেখাতো তখন একদিন বাড়ীর খাটটা ভেঙে গিয়েছিল কারণ সেটা দেখতে পাড়াতে যাদের বাড়ীতে টিভি ছিল না তারা সবাই আসতেন টিভি দেখতে ৷ কখনো মাকে তার জন্য বিরক্ত হতে দেখেনি ৷উল্টে মা হাসিমুখে সবাইকার জন্য চা বিস্কুট , মুড়ি মাখা ইত্যাদি দিতেন ৷ কিন্তু এখন সবাই আমরা কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি ৷তখন ছিলো না মুঠো ফোন , ল্যান্ডফোন অবশ্য ছিল তাও সবার বাড়ীতে নয় ৷ বাবাকে দেখতাম বাজার যেতে, কোনোদিন বাবার সাথী হলে দেখতাম রাস্তায় যাদের সঙ্গেই দেখা খুব চেনা হচ্ছে হাসিমুখে তাদের প্রত্যেকেরই সাথেই কুশল বিনিময় করছেন তারজন্য কিন্তু এখন আমরা কালে ভদ্রে কোনো কারণ ছাড়াই এইরকম করি , করিনা বললেও ভুল হবে করি whatapp বা ম্যাসেন্জারে একই মেসেজ সবাই পাঠিয়ে নববর্ষ , বিজয়া বা দীপাবলী বা অন্যকোনো কারণে করি ৷ আগে কারোর বাড়ী যেতে জিজ্ঞেস করতে হতো না এখন যাওয়া যাবে কিনা বা অমুক দিন ফাঁকা থাকবেন কিনা ৷ কিন্তু কেউ কারো বাড়ীতে সন্ধ্যা বেলায় যাওয়াটা তো পছন্দই করেন না উল্টে তার সিরিয়াল দেখা বা ব্যক্তিগত সময়ের উপর প্রভাব পড়ছে সেটা মেকী কথার মাধ্যমে ঠিক বুঝিয়ে দেন ৷ এখন স্যোসাল গ্যাদারিং হয় কোনো পার্টিতে বা কোনো অনুষ্ঠানে তাও বেশীর ভাগ সময় নিজের বাড়ীতে নয় কোনো ভেনুতে ৷ আগে যখন তখন দিনরাত সময় অসময়ে আত্মীয় স্বজন ছাড়াও পরিচিতদের বাড়ীতে আসতে দেখতাম ৷ মা, কাকিমা ঠাকুমাদের দেখতাম রাত দশটাতেও তাদের হাসিমুখে আপ্যায়ন করতে আর এখন গ্লোবালাইজেসনের যুগে খুব উপায় না থাকলে এরকম করার কথা কেউ মনেও আনেন না ৷ কারণ আমরা সবাই এখন প্রত্যেকেই আধুনিকতার অতিশয়ে ব্যস্ত নয়ত আত্মকেন্দ্রিক ৷ আগে যখন ভরদুপুরে অহেতুক নীচের তলায় উঁকি দিয়ে ‘‘এই আজ কী রাঁধলে গো বৌদি?’’ জাতীয় কৌতূহলকে ‘এ মা, কী গায়ে পড়া!’ বলা হতো না…। এখন এটা জানতে চাওয়া মানেই ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো ৷
যখন শেয়ার শব্দটা শুধু ব্যবসার বাজারেই ছিল। পরস্পরকে সুখ-দুঃখের কথা বলাকে তো ভাগাভাগি বলা হতো…।
যখন অলিগলি এজমালি বাড়ির প্রতিটা বাসিন্দার পরিচয় ‘ভাড়াটে’ হওয়া সত্ত্বেও সবাই সবার খবর রাখতেন…।
যখন রাঁধতে রাঁধতে হঠাৎ আদা ফুরিয়ে গেলে দোকানে ছুটতে হতো না, পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে নেওয়া যেত সহজ ভাবে…।
যখন বিকেল শব্দের মানে ছিল মাঠ-দাপানো, কোচিং-কাঁপানো নয়..।
তখন দীপাবলি হতো…।
উজ্জ্বল আলোর আনন্দে মাখো মাখো উৎসবের রাত্তির।
দিওয়ালি আর ধনতেরাসের বাজারি হুজুগ তখনও গিলে নেয়নি আনন্দ শব্দের মানে।
তখন এই আলো-সন্ধে আসার দিন সাতেক আগে থেকেই ছাদভরে ওলোট-পালোট রোদ্দুর খেত চাঁপাহাটির চর্কি, তুবড়ি, ফুলঝুরি, রংমশালের দল…। রকেট, প্যারাশ্যুটরা তখন বিশেষ অতিথি হিসেবে মঞ্চ মাতিয়ে যেত কেবল…।
তখন শুভেচ্ছা জানাতে প্রদীপের থালা হাতে নিয়ে ছবি তুলে ট্যাগ করার চল ছিল না…। নিজের আনন্দের সঙ্গে অন্যকে যদি ট্যাগিয়ে নিতেই হতো, তা হলে সটান এসে হাতে ফুলঝুরি ধরিয়ে দিয়ে কোলাকুলি করে নিতে হতো…।
তখন দূষণ ছিল না, আলো ছিল কেবল…।
তখন, সেই তখন মোম-প্রদীপ-সলতের নরম আলোর আঁচে উৎসব নেমে আসত সন্ধের পায়ে পায়ে। সেই সন্ধেয় বারান্দাদের নাম রাখাই যেতো দীপান্বিতা।
তখন, সেই হাফ-সোয়েটারের হিম সন্ধেটায় আলোয় আলোয় পুড়ে যেত অনেক অবসাদ…। সঙ্গে পুড়ত কিছু মোমবাতিও। পুড়ত মাটির প্রদীপ। পুড়তে পুড়তে শেষ হয়ে যেত মোম…। কালো হয়ে যেত মাটির প্রদীপ…।
মাটির মতো দেখতে খয়েরি ফাইবারের চ্যাটালো খোলের মুখে এক বিন্দু টুনি ছুঁইয়ে দেওয়ার আশ্চর্য কেরামতি তখনও গ্রাস করে ফেলেনি এই পুড়ে যাওয়াটুকু…।
সেই আলো-সন্ধেরা জ্বলতে জ্বলতে, পুড়তে পুড়তে, গলতে গলতে কবেই বড় করে দিয়েছে শহরজোড়া নাইন্টিজ় চিলড্রেনদের…। কবেই তো সেই রঙিন ফানুসের ঝাঁক উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে তাদের সমস্ত অকারণ অবসর…। তাদের ছড়ে যাওয়া কনুই-হাঁটুতে কবেই পড়েছে ম্যাচিওরিটির মলম…। তারা এখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে কাচের জানলার এ পার থেকে শহরের আলো-আকাশ দেখে মা-কে হোয়াটসঅ্যাপ করে, “টুনির সুইচটা অন করেছো…?”
তাদের দীপাবলি পেরিয়ে যায় গাদাগাদা ‘হ্যাপি দিওয়ালি’-র বন্যায়…।
ক্যালেন্ডার ওল্টালে দিনগুলো খুব পেছনে নয়, কিন্তু স্মৃতি হাতড়ালে যেন পূর্বজন্ম…। সেই পূর্বজন্মের সমস্ত আলোটুকু চোখে মেখে দিনভর ভুলে থাকার অভ্যাস করাটাই পাল্টে যাওয়ার আর এক নাম…।
আমরা জানি চলাই জীবন , জীবন মানেই পাল্টে যাওয়া…। এতো কিছুর মধ্যেও কি কিছু ভালো নেই ৷আছে তো ৷৷তবুও আমরা যারা নব্বই দশকে মানুষ হয়েছি তারা যেভাবে নিজের আনন্দ দুঃখ সুখগুলো একে অন্যের সাথে শেয়ার বা ভাগ করেছি পরিবার ছোটো হওয়ার কারণে এবং আধুনিকতা ও নেট দুনিয়ার জগতে আমার আত্মজদের আমরা চাইলেও পারছি কোথায় দিতে ! হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব চারদেওয়ালের মাঝে ৷ আজ এই পর্যন্তই ৷ সবাই খুব ভালো থাকবেন ৷ আবার আসবো আরো অন্য কোনো উপস্থাপন নিয়ে পরবর্তীতে ৷