সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ২৯)
by
·
Published
· Updated
যাপনচিত্র – ২৫
মুখোশের আড়ালে
জীবনটা অনেকসময় পদ্মপাতার জলের মতো টলমল করে ৷ আমার বড়ো মানুষ হবার সাধ ছিলো,মানুষ হতে চেয়ে তোমাদের মত অসাধারণের দলে মিশতে গেলাম , ফেরত পেলাম লাঞ্ছনা, একবার জীবনকে ভালোবেসে মানুষকে বানিয়েছিলাম ঈশ্বর,
উপহার স্বরূপ সযত্নে পেয়েছি প্রতারণা, ভেবেছিলাম কষ্টর মুখে গুলি ছুঁড়ে উড়ে যাবো এবার অনন্ত নীলে,সময় কটুক্তি করে ডেকেছিলো আমায় অচ্ছুৎ,তারপর আর বিশ্বাসের ডানায় ভর করে ওড়া হয়নি আমার,অনুভূতির আশ্রয়ে ঠাঁই দেয়নি তোমাদের সভ্যতা,মনের ভেতর রাখা অদ্ভুত যে ছোঁয়াচে রোগটা পাগলা কুকুরের মত তাড়া করতো আমাকে,আমি গর্ব করে তার নাম দিয়েছিলাম ভালোবাসা,তোমরা কখনও ভালোবেসোনা কেউ ভালোবাসলে কেউ ভালো থাকেনা। আর ভালোবাসা যখন টাকা সর্বস্ব হয় যখন একটা মানুষের আয়ের উপর নির্ভর করে তার সামাজিক পরিস্হিতি এমনকি আত্মীয় বন্ধুদের কাছে কদর তখন ভালোবাসা নয় উঁকি মারে একরাশ ঘৃণা ৷ গরীব পরম আত্মীয় হলেও সে ব্রাত্য আর যার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিশালী অতি দূর সম্পর্কের হলেও তাকে পরিচয় দিতে সকলে উন্মুখিয়ে থাকে ৷সেদিন এক বন্ধুর সাথে দেখা হলো হঠাৎ ৷ কলকাতায় থাকে মনে হয় লকডাউনে বাড়ীতে এসেছেএসেছে,আটকে পড়ছে এড়িয়ে চলে যাচ্ছিল ৷ খুব অবাক লাগলো তাই স্কুটি নিয়ে প্রায় জোর করেই ওর রাস্তা আটকে দাঁড়ালাম ৷ বললাম কিরে এতো ব্যস্ততা কিসের ?? এখন তো লকডাউন চলছে ,এখন তো তোদের ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে যখন ব্যস্ত ছিলিস তখনো দেখা হলে কথা না বলে যেতিস না এখন তো ওয়ার্ক লোড কম তবুও কথা না বলে যে বড়ো চলে যাচ্ছিস ৷ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কেমন যেন মনে হলো ও ওর নিজের মধ্যে নেই , কেমন একটা দৃষ্টি ওর চোখে বিশ্বাস না অবিশ্বাস না উদাসীন কিছুই বুঝতে পারলাম না তবে দেখে বুঝলাম ও ভালো নেই ৷ ঘড়িতে দেখলাম প্রায় তিনটা বাজে একটু ব্যাঙ্কে গেছিলাম ,ফেরার সময় ওর সাথে মানে উজানের সাথে দেখা ৷ বললাম উঠে বস স্কুটিতে ৷ তখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে ,বললাম শুনতে পেলি না উঠে বস ৷ তারপরে কিছু না বলেই উঠে বসল ৷সোজা বাড়ীতে এলাম ৷ কোনো কথা হয় নি রাস্তায় ৷ স্কুটিটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে বললাম উঠে আয় দোতালায় ৷ কিছু না বলেই মন্ত্রমুগ্ধের মত পিছন পিছন উপরে উঠে এলো ৷ বললাম যা ফ্রেস হয়ে নে তারপরে ভাত খাই চল দুজনে ৷কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে সব করল ৷ খাওয়া হবার পরে বললাম বলতো গুরু কি হয়েছে ?? তোর এইধরনের আচরণ কেন ! কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো ,আমিও সময় দিলাম তারপরে বলল এইকদিনে মুখোশের আড়ালে অনেক মুখ দেখলাম তাই আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছি নিজেকে সবার থেকে ৷ তারপরে যা বললো তা গল্পের আকারে লেখার চেষ্টা করলাম ৷ জীবনটা চরম কঠিন ৷
‘ ।আর কত দেরি করবি? এবার আমাকে ছাড় না রাজু ৷
করোনার জন্য দোকানের সামনে বেঞ্চ পাতা। ভিতরে ঢোকা বারণ। লাইন হয়েছে বেঞ্চ থেকে। বেশ লম্বা লাইন। উজানো দাঁড়িয়েছিল লাইনেই। কিন্তু ভিতর থেকে রাজু ওকে দেখতে পেয়ে বলল-‘আপনি লাইন ছাড়ুন। একপাশে দাঁড়ান। সময় করে ডেকে নেব।’এই নির্দেশ উজানকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার জন্য নয়। লাইনটা নগদ কারবারীদের। উজান আজ বাকির খদ্দের কিন্তু সেজন্যই পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ নয় ৷ আগেও কখনো সখনো বাকী নিত তখনো খাতির করে সব দিত ৷ কিন্তু দেরির তো একটা সীমা থাকবে! কত লোক লাইনে এল, জিনিস পেয়ে চলেও গেল। কিন্তু উজানের ডাক এল না। ধারে জিনিস নিলে বুঝি এরকমই হয়। কদিন আগেও এই মুদির দোকানে কী খাতির পেত উজান! মালের স্লিপ একটু বড় হলে, রাজু বলত, আপনি চলে যান, লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর এখন…তবু ভাল, মালিককে বুঝিয়ে বলায় এক মাস ধারে মাল দিতে রাজি হয়েছেন।তাগদা দেওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পরে উজানকে স্লিপ দিতে বলল রাজু ৷ বেশির ভাগ জিনিসই নেই। আসলে নেই কিনা তা ওরাই জানে। তবে চাল আর তেলটা পাওয়া গেল। এটুকুই বা কম কী! বুঝলাম ওদের কানে চলে গেছে উজানের চাকরীটা নেই ৷
-‘করোনা না গেলে কিছুই হবে না।’
-‘আমাদের অবস্থাও খুব খারাপ রে। দোকান থেকে একেবারেই আয় নেই। রেশনের চাল খেয়ে আছি।’
উজান ফোন রেখে দিল। এক ক’দিনের অভিজ্ঞতা বলছে, ভাইয়ের শেষ কথাটাই আসল কথা। একে ওষুধের দোকান, তার উপর, নেহাৎ ছোট নয়। একেবারে আয় নেই, এ কি বিশ্বাসযোগ্য? করোনার সময়ে ওষুধের কারবারটাই যে সবচেয়ে সচল এবং ঊর্ধ্বগামী, তা যে কোনও ওষুধের দোকানের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আসলে ভাই ভয় পেয়েছে। যদি উজান সপরিবারে ওর কাছে আশ্রয় নেয় ৷বিকেলে দিদিকে ফোন লাগাল উজান। দু’মিনিট কথা বলেই বুঝল, চাকরি যাওয়ার খবর ওখানেও গিয়েছে।
-‘পাঁচ বছর চাকরি করছিস। কত গল্প শুনতাম লাখের উপর বেতন! কিছুই জমানো নেই?’
-‘ছিল। কিন্তু ফ্ল্যাটটা কিনলাম যে। ব্যাঙ্ক লোন অর্ধেক নিয়েছিলাম। বাকি অর্ধেক তো…। যা জমিয়েছিলাম সব শেষ। ব্যাঙ্কের ইএমআই ও কম নয়। ফ্ল্যাটের, সঙ্গে আমার দু’চাকার। কী যে হবে!’
-‘এই জন্যই বুঝেশুনে চলতে হয়। অত বড় ফ্ল্যাট হাঁকানোর কী দরকার ছিল তোর? এবার বোঝ!’
উজান ভেবেছিল, দিদির কাছে কিছু চাইবে। কিন্তু যেভাবে কথা বলল, তাতে টাকা চাইতে ইচ্ছে হল না। ওর কথার ভাবেই তো পরিষ্কার, চাইলে টাকা দেওয়া তো দূরস্থান, বেশ কটা কড়া কথাও শুনতে হবে। ফোন রেখে দিল উজান ৷
রাতে ছেলে তাতাইকে পড়াতে পড়াতে উজান সুমিতকে ফোন লাগাল। সুমিতও ওর মত আইটি এবং ব্যাচমেট। কিছুদিন ওর কোম্পানিতেও ছিল। তারপর ভাল অফার পেয়ে মুম্বইয়ের একটা বিরাট কোম্পানীতে জয়েন করেছে।‘হ্যালো, আমি উজান’ বলেই সরাসরি কাজের কথা পাড়ল।
-‘চাকরিটা চলে গেল ভাই। এই করোনায় খুব ঠেকে গেছি। তোর ওখানে কি…?’
-‘করোনার সময়ে নিউ রিক্রুটমেন্ট! আর ইউ ম্যাড?’ ওপার থেকে প্রায় ধমকে উঠল সুমিত।
এরপর কথা চলে না। ফোন রাখল উজান ৷
এবার অর্ককে ফোন লাগাল উজান। অর্ক ওর দুবছরের জুনিয়র। একসময় ওর কোম্পানীতে উজানই অর্ককে ঢুকতে সাহায্য করেছিল। অর্ক ও সুমিতের মত একটা কোম্পানিতে ভাল অফার পেয়ে চলে গেছে। তবে ও রয়েছে কলকাতাতেই, সল্টলেকে ওর অফিস। করোনার আগে অর্কের সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল বেহালায় ৷ একেবারে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর কফি খাইয়েছিল দোকানে নিয়ে গিয়ে।
আজ সেই অর্করো ভিন্ন সুর। রুক্ষ নয়। তবে উজানের চাকরি নেই শুনে পাছে কোনও অনুরোধ আসে সেই ভয়েই সম্ভবত বলে উঠল-‘একটু ব্যস্ত আছি গো। পরে না হয়…।’ তারপর কেটে দিল ফোনটা।
-‘তুমি কাল না হয় আমাকে আর তাতাইকে আমাদের বাড়ি রেখে আসো। মাস খানেক ওখানে থাকি গে। তুমি যা আছে তাই দিয়ে ধারবাকিতে চালিয়ে নাও কিছুদিন। এর মধ্যে তুমি নিশ্চয় কিছু একটা…’ রাতে খেতে বসে রণিতা কথাটা বলে মতামতের জন্য তাকাল উজানের দিকে। প্রস্তাবটা এই মুহূর্তে না গ্রহণ করার মত নয়। উজান পরের দিন একটা গাড়ি ভাড়া করে শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছাল।
-‘কল থেকে ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় উঠুন।’
উঠোনে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে হুকুম ভেসে এল শ্যালকের।
এই অবস্থায় হাত মুখ না ধুয়ে, বাইরের জামাকাপড় না ছেড়ে ভিতরে ঢোকার কথা কিন্তু উজান ভাবেইনি। রণিতা ,তাতাইকে নিয়ে পোঁছেও গেছে ওখানে। উজানো ও যাবে। হুকুমটা অতিরিক্তই মনে হল।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসল উজানের । বেশ কিছুক্ষণ কাটল। আগে এসে বসা মাত্রই চা নিয়ে হাজির হতেন শাশুড়িমা অথবা অন্য কেউ। আজ সেসবের বালাই তো নেইই উপরন্তু উজান লক্ষ্য করল, কেউ কোনও কথাও বলছে না ওর সঙ্গে। চা অবশ্য এল কিছুক্ষণ পরে। কিন্তু সেখানেও আজ গরমিল। প্লেট নেই। দুটোর পরিবর্তে একখানা বিস্কুট। এবার একটু হাসিই পেল উজানের ।
রাতে আরও এক কাণ্ড হল। শ্বশুর বাড়িতে এলে উজান বরাবর দোতালার পশ্চিমের ঘরটিতেই থাকত। ওর ল্যাপটপ ওখানে সেট করে নিরালায় অফিসের জমে থাকা কাজ সারত। এবারে কাজ নেই। তাই ল্যাপটপে কাজ করাও নেই। আর ওটা অফিসের ল্যাপটপ। তাই ওটা কাছে থাকারও প্রশ্ন নেই।
উজান ভাবল, পেপারটা নিয়ে ওখানে গিয়েই পড়বে।পড়বে।উজান বগলে কাগজটা নিয়ে সবে দোতালার সিঁড়িতে পা দিয়েছে, অমনি শাশুড়িমা রান্নাঘর থেকে মুখ বাড়ালেন-‘ওপরে কোথায় যাচ্ছ? ওখানে নতুন চাদর পেতে রেখেছি। বড় জামাই আসতে পারে। তুমি নিচে বসো।’
উজান কাগজ নিয়ে আবার এসে বসল চেয়ারে।
পরদিন সকালে উঠে দেখল বারান্দা জুড়ে রান্নার আয়োজন। রণিতা গ্যাস স্টোভ জ্বেলে একা হাতে সামাল দিচ্ছে সব। জামাইয়ের চাকরি যাওয়ায় মেয়েরও কদর কমে গেল তার বাড়িতে!
উজানের একবার মনে হল, ফেরার সময় সবাইকে নিয়েই ফেরে। তারপর কী মনে হওয়ায় ফিরল একাই।রণিতা অবশ্য ফিরল ঠিক দুদিন যেতে না যেতেই। কারণ কিছু বলল না। তবে উজান অনুমান করতে পারল সব।
বিকেলে বাজারে বেরিয়ে মাংস আনল উজান । তাতাইয়ের জন্য ওর পছন্দের মিষ্টি।
-‘টাকা কোথায় পেলে? পরের মাসের ইএমাইয়ের টাকাটা ভাঙছ না তো?’ রণিতা অবাক হয়ে শুধোল।
হাসল উজান । -‘ইএমআইয়ের টাকা ছাড়া আমার আর টাকা নেই ?’
-‘আছে ?’
-‘থাকবে না কেন, তুমি কি আমাকে এতটাই অসতর্ক ভাবো?
আর শোনো চাকরিও আমার যায়নি মোটেই। আমি পনেরো দিন ছুটি নিয়েছি অফিস থেকে। তারপরে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ল্যাপটপটা একদিন অফিস থেকে নিয়ে আসতে হবে শুধু!’
-‘তাহলে খামোখা এতসব-’
– ‘হঠাৎই মনে হল, চাকরি গেলে কেমন হয় চারপাশটা একবার দেখে নেওয়ার।
সেজন্যই…পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে গেল জানো-’ গলা বুজে এল উজানের।
রণিতার গলায় ঝড় থেমে যাওয়ার স্বস্তি। ‘তোমার জামাইয়ের চাকরি যায়নি’ জানাবে কি বাড়িতে একবার? মোবাইলটা হাতে নিতে গিয়েও নেয় রণিতা । উজানের সঙ্গে ওর পৃথিবীও যে টাল খেয়েছে!
-‘বাবা, আজ সেই ছেলেটা এসেছিল নিচে!’ এসময় টিভির ঘর থেকে বেরিয়ে বাবার কোমর জড়িয়ে দাঁড়াল তাতাই।
-‘কোন ছেলেটা রে?’ শুধোল উজান।
-‘সেই যে বাড়িতে কেউ নেই, কাগজ কুড়োয়, তুমি যাকে দেখে বললে, অভাব এমনই জিনিস এই করোনাতেও এতটুকু ছেলেকে পথে বেরোতে হয়েছে-’
-‘আবার এলে আমা্কে ডাকিস! শুধু ও-ই নয় ওর মত অন্য কেউ এলেও-’
ছেলেকে কথাটা বলে রণিতার দিকে তাকাল উজান -‘এত ছোট পৃথিবী নিয়ে বাঁচা কঠিন। দেখি যদি এদের নিয়ে এবার পৃথিবীটাকে সত্যিকারের একটু বড়…’
উজানের চোখেমুখে যেন নতুন ভাবে বাঁচার অঙ্গীকার। সত্যি পরিস্হিতি মানুষকে চিনিয়ে দেয় ৷ তবে মলাট দেখে বইএর বিচার করতে নেই ৷ আমরা ভুলে যাই আজ আমরা কাউকে ছোটো করছি বা মানসিক কষ্ট দিচ্ছি কাল আমাদেরও এই অবস্হা হতে পারে ৷ তাই প্রয়োজন যেকোনো পরিস্হিতিতেই নিজেদের বেঁধে বেঁধে থাকা ৷ যাবা পারেন তারা সম্পর্ক গুলোও ধরে রাখতে পারেন নইলে মুঠোর বালির মত ঝরে যায় সব ৷ ভালো থাকুন সকলে আর অন্যকেও ভালো থাকতে সাহায্য করুন ৷ টাকা পয়সা দিয়ে সবসময় সবাই সহযোগিতা করতে পারে না কিন্তু মানসিক ভাবে পাশে থেকে সাহস যোগানোও কম অংশে কম নয় ৷