• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র – ১৮)

যাপন চিত্র – ১৮

অফবিট

বর্তমানে আমরা এক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি ৷মনুষ্যত্ব গেছে তেল বেচতে ৷ নিজেকে শোআপ করার লক্ষ্যে আমরা যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কারণেই কাউকে আঘাত বা অপমানিত করতে ছাড়ি না ৷ আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন তাও এক পরিবারতন্ত্র ছিল ৷ বাড়ীর বড়োদের দেখে কিছু সহবত আমরা নিজের অজান্তেই আয়ত্ব করে নিতাম কিন্তু বর্তমানে পরিবার ছোটো হতে হতে ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে ৷শুধু নিজের টা হলেই হল ৷ আমরা ভালোবাসি এখন জেনে বুঝে স্বার্থপর থাকতে ৷ ভুলে যাই নিজে যেমন বীজ বুনবো তেমনই গাছ বেড়াবো ৷ কদিনে ঘটনা ৷ মনে দাগ কেটে গেলো ৷
মুদির দোকানে ম্যাগি কিনতে গিয়েছি। লক ডাউন চলছে ৷পাশে একজন দেহাতি মহিলা একটা বাচ্চা নিয়ে দোকানে এসেছে। মহিলাটাকে মুখ চিনি ৷ মহিলাটা হয়তো কোনো হোটেলে রান্নার কাজে সহযোগিতা করে । শুকনা ও কন্ঠার হাড্ডি বের হয়ে গেছে। লক ডাউনে সেই কাজটুকুও নেই ৷ অভাব অনটন তাকে কেমন জীর্ণশীর্ণ করে দিয়েছে। কেউ সাহায্য দিলে আর কেউ ডেকে উঠান ঝাঁট দিয়ে বা কিছু ফাইফরমাশ খেটে দু চার পয়সা যা পায় তা দিয়ে সংসারটা চলে ৷ কদিন আগে আমরাও একটা সংস্হা থেকে ডেকে কয়েকজন যৎসামান্য সাহায্য করেছিলাম ৷ তখন উনিও দলে ছিলেন ৷ আত্মসম্মান জ্ঞান প্রখর ৷বলেছিল দিদি এমনি এমনি কেন দিবি ?? কিছু কাজ থাকলে বল তবে নিব ৷ অনেক বুঝিয়ে বলেছিলাম এখন দরকার নেই স্কুল খুললে স্কুলে এসো ৷ঝাঁটিয়ে পরিস্কার করে দিও ৷ এখন রাস্তায় দেখা হলেই হাসে, কথা বলে ৷ এরা ভালোবাসা বোঝে ৷
সাথে বাচ্চাটা এনেছিল সেই বাচ্চাটারও একই অবস্থা। বউটা ২৫০ গ্রাম তেল আর লবন কিনতে এসেছে। বাচ্চাটা জুলজুল চোখে লজেন্সের বয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারা চাইতে সাহস পাচ্ছে না। ওর মা সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু দারিদ্র্য মাঝেমাঝে চোখে নির্লজ্জ টিনের চশমা পড়িয়ে দেয়। মা তো ছেলের মায়াভরা মুখটা দেখে ভালোবাসায় ভেজা গলায় বললো, “কিছু লিবি ?”
ছেলেটা লাজুক ভাবে কথা না বলে আঙ্গুল তুলে দেখালো। মা হেসে লজেন্সের বয়ামের কৌটা খুলে দুইটা লজেন্স বের করে ছেলেকে খুব আদর করে বলো, “তিনের ঘরের নামতাটা কও তো বাপ” বলেই বউটা আড়চোখে সবার দিকে হালকা , আমার দিকে তাকিয়েও বোকা বোকা হাসলো । তার সেই দৃষ্টিতে কেমন একটা চাপা উত্তেজনা। যদি না পারে? সবাই তো তাকিয়ে আছে!
আমার জিনিষ কেনা হয়ে গেছে ৷ম্যাগির প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে আমিও তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে।
দোকানদারও সরু চোখে তাকিয়ে আছে। এই ছোট্ট একটা বাচ্চা যার মার নিজের কোনো সংস্হান নেই নাক দিয়ে সিকনি ঝরছে, সে বলবে তিনের ঘরের নামতা! এই কঙ্কালসার ছেলে তিনে তিনে কত হয় সেটাই তো জানে না!
ছেলেটার হাতে লজেন্স। সে লজেন্স দুইটা এহাত-ওহাত করছে। মায়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে স্পোর্টস কারের গতিতে সে বলতে শুরু করলো,তিন অক্কে তিন, তিন দুগুনি ছয়, তিন তিরিক্কা নয়, তিন চাইরে বারো….”
কেমন টেনেটেনে গানের তালে মাথা নেড়েনেড়ে সে বলে যাচ্ছে। যেন মায়ের চোখে যেন নামতার পাতাটা ..সেঁটে আছে, ও শুধু দেখে দেখে পড়ে যাচ্ছে।
নামতা শেষ হলো ত্রিশ কি চল্লিশ সেকেন্ডে। শেষ করে সে একটা লজেন্স মুখে পুড়লো। মুখ ঝলমল করে বাবাকে বললো, “মা , চাইরের নামতাও পারি। কমু?”
সেই বউটা , হয়তো প্রতিদিন ঠিক মতো পয়সা পায় না। কারো কাছে বার বার কাজ চাইলে বিরক্ত হয় মানুষ সেই কুন্ঠা বের হয়ে যাওয়া মহিলাটা হয়তো প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধে প্রতিদিনই হেরে যায়। সমাজের কাছে, সংসারের কাছে, মাতৃত্বের কাছে৷ আজ সে হারেনি। আজ তার অনেক বেশি আনন্দ। সবার সামনে ছেলে তার মুখ উজ্জ্বল করেছে। এবার সে আড়চোখে না, পূর্ণ দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকালো। তার চোখে গর্বের অশ্রু, আনন্দাশ্রু।
যে মহিলাটি শুধু পরাজিতই হয়, আমাদের চোখে, আসলে সে পরাজিত না। সে আসলে অনেক বড় যোদ্ধা। আমাদের চেয়ে অনেক সাহসী। আমরা তো যুদ্ধের আগে নানান পরিকল্পনা করি, কত ফন্দিফিকির, কাকে নিচে নামিয়ে কাকে মাড়িয়ে আমরা উপরে উঠবো।কিন্তু এই মানুষগুলো কাউকে মাড়িয়ে উপরে উঠতে চায় না, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও প্রাণপণ যুদ্ধ করে যায় ৷মহিলাটি আজ সাহস পেয়েছে। তিনের ঘরের নামতাটা শুধু নামতা নয়, একটা সাহস, একজন মায়ের শক্ত একটা কাঁধ, একটা অবলম্বন। তিনের ঘরের নামতাটা এই দরিদ্র মহিলাটার স্বপ্ন পূরণের উপাখ্যান।
বউটা তার ছেলেকে কোলে তুলে ফেললো। সে কেঁদেই ফেলেছে। এই সময় হুট করে দোকানী ডীপফ্রিজ খুলে একটা ললি আইসক্রিম পুচকার র হাতে দিল৷”সাবাস! জজ ব্যারিস্টার হইয়া দেখায়া দিস সবাইরে! লে আইসক্রিম খা”৷
ছেলেটা খুশি মনে আইসক্রিমটা নিলো। আজ আর মা টা না করলো না ৷ আমি জানতে চাইলাম ওর বয়স কত ? বললো, “চাইরে পড়বে গো দিদি ৷ আমি একটু লিখাপড়া শিখেছিলাম৷ সেভেনের পর বাবা বিয়া দিয়ে দিলে ওই বাড়ীতে কাজ করতে করতে আর ঘুমপাড়াবার সময় মুখে মুখে ছেলেটারে শিখাই ৷” মা ছেলে চলে গেলো। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আছি।
দোকানদার বিশ্বনাথ দা বললো আমাকে বললো, “আমি তো ভাববারও পারি নাই। পুচকা টা কেমনে চ্যালচ্যালাইয়া নামতা কইয়া দিলো! দেখলেন নি কারবার ডা!একি! দোকানির চোখেও জল ! আসলে যারা ক্ষুধার কষ্ট বোঝে, তাদের একজনের মনের সাথে অন্যজনের মন একই সুতোয় গাঁথা থাকে। একজনের কষ্ট আরেকজন বুঝতে পারে, আবার আনন্দগুলোও স্পর্শ করে পারে আর আমরা? কোটি টাকার স্বপ্নে বিভোর আর প্রতিযোগীতার উন্নাসিকতায় ভুলে যাই আমরা আসলে কি!!!
আমি ম্যাগির প্যাকেট হাতে একা একাই হাঁটছি আর নিজের মনেমনেই বলছি, আমার কি কিছু বলার ছিল বউটাকে ! যাক এরপরের দিন দেখা হলে বলতে হবে ছেলেটাকে স্কুলে নিয়ে আসার জন্য ৷
একজন মা আর সর্বপরি একজন শিক্ষিকা হিসাবে আমাকেও সংক্রামিত করেছে তাদের জয়ের আনন্দ!!! ভীষণ একটা আনন্দ কাজ করছিল ভালো লাগা ৷ সবাই ভালো থাকবেন ৷সবাই জানাই নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভকামনা ভালোবাসা ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *