।। প্রতিরোধ।।
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের কথা। সিলেটের এক পাহাড়ি গ্ৰামে প্রায় প্রায় ডাকাতি হতো। ডাকাতদের ভয়ে গ্ৰামবাসীরা সবসময় ভীত হয়ে থাকত। কখন তারা ডাকাতি করতে আসবে তা গ্ৰামবাসিরা জানত না। গ্ৰামের বেশিরভাগ মানুষেরা পাহাড়ের উপরে ধাপ কেটে কেটে চাষ করত। তাদের সারা বছরের ফসলের অর্ধেকের বেশি ডাকাতরা লুঠ করে নিয়ে যেত। ফলে সারা বছর আধপেটা খেয়ে তাদের দিন অতিবাহিত করতে হত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাহস করে কেউ কখনো এগিয়ে আসে নি। ডাকাত দলের সর্দার রঘুবীর ঠাকুর প্রত্যেকবার গ্ৰামবাসির উদ্দেশ্যে কড়া কথায় বলে যেত —- ” আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস বিগত কুড়ি বছর ধরে এই গ্ৰামে কারো হয় নি, ভবিষ্যতেও কেউ দেখাবে না আশা করছি। আমার ভেজা গরম হলে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দেব। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা মোটেই সহ্য হয় না। সামান্য ফসলই তো সারা বছর তোদের কাছথেকে নিই, তোদের জানটা তো আর নিই না । ” তার এই ধমক খেয়ে একেবারে টু- শব্দটি করত না কেউ।
একবছর আকাল দেখা দেয়। অনাবৃষ্টির ফলে চাষিদের একেবারে ফসল হয় না। খুব সামান্য ফসল তাদের ঘরে মজুত ছিল। খুব কষ্ট করে কেউ কেউ বাঁচিয়ে রেখেছিল। সবার ঘরে যে ফসল ছিল এমন নয়। ডাকাত রঘুবীর ঠাকুরের ভয়ে গ্ৰাম ছেড়ে অনেকেই কাজের জন্য শহরে চলে যায়। কেউ আবার সর্দার এলে কি করবে তা বুঝতে পারে না। যথারীতি সময় মতো ডাকাত সর্দার তার দলবল নিয়ে গ্ৰামে আসে। কিন্তু কোনো কৃষকই ফসল নিয়ে তার কাছে আসে না। সে দলের দুজনকে আদেশ দেয় প্রত্যেক ঘরের পুরুষদের ঘর থেকে মারতে মারতে তার কাছে নিয়ে আসতে। দলের ওই দুজন সদস্য সর্দারের কথা মতো গ্ৰামের প্রত্যেক ঘরে প্রবেশ করে। কিন্তু মাত্র পাঁচ জন পুরুষকে পায় তারা। ডাকাত সর্দার তাদের চাবুক মেরে জিজ্ঞাসা করে — ” গ্ৰামের সমস্ত পুরুষেরা কোথায়? তোরা পাঁচজন কেন? আমার ফসলের ব্যবস্থা তোরা করিস নি কেন? আমার অত্যাচারের কথা তোরা ভুলে গেলি? কারোকে জ্যান্ত রাখব না। আমরা যদি খেতে না পাই, তবে তোদের গ্ৰামের কারোকে আমি এক মুঠো খেতে দেব না।” ডাকাত সর্দারের মার খেয়ে পাঁচজন কৃষক জানায় — ” মাই বাপ আমাদের কোনো দোষ নেই। এবছর অনাবৃষ্টির জন্য কারো জমিতে একটুও ফসল ফলে নি। আমরাও এই কটি মাস প্রায় না খেয়ে খুব কষ্টে বেঁচে আছি। গ্ৰামের বেশিরভাগ পুরুষ শহরে শ্রমিকের কাজ করতে চলে গেছে। সংসার বাঁচানোর জন্য এছাড়া তাদের কাছে কোনো উপায় ছিল না। আমরা তো আপনার কথা মতো এতদিন ফসল দিয়ে এসেছি। এবছর পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আমাদের ছেড়ে দিন। আমাদের উপর আর জোর জুলুম করবেন না।” তাদের কথা শুনে ডাকাত সর্দার খুব রেগে যায় এবং বলে — ” পুরুষেরা যদি পেটের দায়ে শহরে গিয়ে থাকে তবে তোরা পাঁচজন যাস নি কেন? নিশ্চয় তোদের ঘরে অভাব নেই। যথেষ্ট পরিমাণে ফসল মজুত করা আছে। তবে ওই ফসল বের করে নিয়ে আয়।” ওই পাঁচ জন ডাকাত সর্দারের কাছে হাত জোড় করে বলে — “ওটুকু আপনারা নিয়ে যাবেন না। তবে আমাদের ঘরের শিশুরা না খেয়ে মারা যাবে।” কোনো কথা না শুনে ডাকাতেরা ওই পাঁচজন কৃষকের ঘরে প্রবেশ করে অবশিষ্ট ফসল বের করে নিয়ে আসে। এরপর মিথ্যা কথা বলার অপরাধে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে তাদের পাঁচজনকে ডাকাতেরা ডেরায় তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে ডাকাত সর্দার রঘুবীর ঠাকুর বলে — “আমার সারা বছরের ফসল দিয়ে এদের নিয়ে আসবি। যতক্ষণ না আমি ফসল পাচ্ছি ততক্ষণ এরা আমার কাছে থাকবে। এরপর ঘরের বউদের ও বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাব। ফসল হয় নি, ফসল ঘরে নেই কিছুই আমি শুনবো না। আমার ফসল চাই ফসল।”
এদিকে না খেতে পাওয়ায় গ্ৰামের মানুষ অসুস্থ হয়ে মরার উপক্রম হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন বয়স্ক ও বাচ্চারা মারা যায়। গ্ৰামের মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। গ্ৰামে চুরি -ছিনতাই বেড়ে যায়। শহর থেকে যারা টাকা পাঠাতে পেরেছিল তাদের পরিবার কোনোক্রমে খেয়ে বেঁচে থাকে। ওদিকে ফসল না পাওয়ায় ডাকাত সর্দার এক এক করে পাঁচ কৃষককে হত্যা করে তাদের মৃতদেহ গ্ৰামে পাঠিয়ে দেয়। গ্ৰামে নেমে আসে শোকের ছায়া। এরপর গ্ৰামের বউ ও মেয়েদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় তারা। সেখানে সব ডাকাতরা মিলে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে তাদের হত্যা করে তাদের মৃতদেহ গ্ৰামে পাঠিয়ে দেয়। এই খবর পেয়ে শহর থেকে পুরুষেরা সব গ্ৰামে ফিরে আসে। গ্ৰামের সমস্ত মানুষেরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের নেতৃত্ব দেয় যদুনাথ সরকার নামের এক যুবক চাষী। সে গ্ৰামবাসিদের উৎসাহ দিয়ে বলে— ” এই ভাবে দিনের পর দিন মুখ বুজে সব সহ্য করে নিলে অন্যায়কারীদের অন্যায়ের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাবে। আপনারা সকলে মনে সাহস আনুন। মন থেকে ভয় দূর করুন। একসাথে সবাই হাত তুলে বলুন ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্ৰ মেদিনী’।”
যদুনাথ পেরেছিল সকলকে এক করতে। কয়েকমাস পরে ডাকাতদের দল পুনরায় ফসলের জন্য গ্ৰামে এসেছিল। তখন কৃষকের মাঠে ধান গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কৃষকেরা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল জীবন থাকতে একটি দানাও ডাকাতদলের সদস্যদের হাতে তুলে দেবে না তারা। ডাকাতেরা যখন গ্ৰামে এসেছিল তখন গ্ৰামের কোনো ঘরে একটাও মানুষ ছিল না। ডাকাত সর্দারের নির্দেশে গ্ৰামের সমস্ত ঘরগুলো তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়, কিন্তু কারোকে পায় না তারা। তখন ডাকাত সর্দার রেগে গিয়ে বলে —- ” কি রে ভীতুর দল, আমার ভয়ে তোরা সব গ্ৰাম ছেড়ে চলে গেলি নাকি? কারো মনে একটুও সাহস নেই দেখছি। আমি শুনেছি তোরা সব দলবদ্ধ হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে সংগ্ৰাম করবি। তা কোথায় তোরা? আমার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কোন শালা শুয়োরের বাচ্চার হয়েছে সামনে আয় দেখি। তোদের একেবারে মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দেব। বন্দুকের একটা গুলিও মিস হবে না বুঝলি?” এই বলে শূন্যে দু-রাউন্ড গুলি ছোড়ে ডাকাত সর্দার রঘুবীর ঠাকুর। বেশ কিছুক্ষণ তারা অপেক্ষা করে এবং সারা গ্ৰাম ভালোভাবে তল্লাশি করে গ্ৰামবাসিরা কোথাও লুকিয়ে আছে কিনা। শেষমেষ তাদের খুঁজে না পেয়ে ডাকাত সর্দার বলে — ” শুয়োরের বাচ্চারা গ্ৰাম থেকে পালিয়েছে মনে হয়। যেভাবে পাঁচটা শুয়োরের বাচ্চাকে মায়ের ভোগে পাঠিয়েছি ও জনা কুড়ি মাগিকে ধর্ষণ করে তাদের মৃতদেহ গ্ৰামে পাঠিয়েছিলাম তাতে মনে হয় সকলে ভয় পেয়ে আগেভাগেই গ্ৰাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে।” এরপর সকলে মিলে বিকট হাসি হাসে। এমন সময় একটা সত্তর বছর বয়সের কৃষককে দেখতে পায় রঘুবীর। সে অন্যদের বলে — ” সকলে দেখ্ ওই দূরে এক বুড়ো শুয়োর দাঁড়িয়ে রয়েছে। যা তোরা ওর ভালোভাবে সেবাযত্ন কর। দেখিস ওরে একটু কম কষ্ট দিয়ে মারিস।” চারজন ডাকাত তার দিকে গেলে সে দৌড় দেয়। তার পিছু পিছু ওই চার ডাকাত বন্দুক হাতে নিয়ে দৌড়ায়। এরপর একজন ষোলো বছরের মেয়েকে গলির মোড়ে দেখে ডাকাত সর্দার। তার কথা মতো সেদিকেও পাঁচ জন ডাকাত যায় মনে ধর্ষণ করার অভিলাষ নিয়ে। এরপর একটা গলির মুখে যদুনাথ সরকারকে দেখতে পেয়ে ডাকাত সর্দার তার দলের বাকি পাঁচজন সদস্যদের বলে — ” এই শুয়োরের বাচ্চা গ্ৰামবাসীদের এককরার চেষ্টা করছে। তাদের প্রতিবাদ করতে শিখাচ্ছে। তোরা একে ধরে আমার সামনে নিয়ে আয়। আমি ওর খাল খিঁচে নেব। গ্ৰামবাসির সামনে ওকে পায়ের তলায় পিষে মায়ের ভোগে পাঠাব।” তার কথা মতো বাকি সদস্যরা যদুনাথ সরকারকে ধাওয়া করে । ডাকাত সর্দার রঘুবীর ঠাকুর একলা হয়ে যায়। এদিকে সকল গ্ৰামবাসীরা লাঠি, ঝাঁটা, বটি, কোদাল, কুড়োল, কাস্তে নিয়ে গ্ৰামের এক স্কুলের ছাঁদে শুয়ে ছিল। তারা চার ভাগে ভাগ হয়ে ডাকাত সর্দার ও ডাকাত দলের সদস্যদের আক্রমণ করে। সঙ্ঘবদ্ধ গ্ৰামবাসীর কাছে ডাকাতেরা একেবারে অসহায় মনে হয়। যেমন খুশি তেমন ভাবে সঙ্গে থাকা সবকিছু দিয়ে রামশ্যাম ধোলাই দেয়। কেউ বটি দিয়ে পায়ে কোপ মারে, কেউ কুড়ুল দিয়ে হাতে। যদুনাথ সরকার ডাকাত সর্দার রঘুবীরের গলায় ধারালো কাস্তে দিয়ে কোপ মারে। ডাকাতেরা বুঝে ওঠার আগেই ওদের ওপর এই আক্রমণ চলেছিল। কেবলমাত্র দুজন ডাকাত তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বাকিদের মৃতদেহ পড়েছিল গ্ৰামের বিভিন্ন জায়গায়।
গ্ৰামবাসিরা প্রমাণ দিয়েছিল সঙ্ঘবদ্ধ হলে পাহাড় সমান বাঁধাকেও কিভাবে ধ্বংস করে দেওয়া যায়। পুলিশ এই ঘটনাকে একেবারে ধামাচাপা দিয়ে দেয়। ডাকাত সর্দার রঘুবীরের অন্তিম পরিণতি দেখে মানুষে বুঝতে পেরেছিল, খারাপ কাজের পরিনতি খারাপই হয়। মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হলে পারে না এমন কাজ নেই। একতাই শক্তি।