আষাঢ় মাসের এক বৃষ্টির দিন।ঘড়িতে ঢঙ ঢঙ করে সকাল দশটার ঘন্টা বাজল। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। থামার নামগন্ধ নেই। বৃষ্টি শুরু হয়েছে ঘণ্টা দুয়েক হবে। আজ ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাদলের সকাল সকাল ঘুম ভাঙেনি। বৃষ্টির দিনে জন্ম বলে ঠাকুরদা নাম রেখেছিলেন বাদল। গতরাত্রে প্রচণ্ড মেঘ গর্জন সহ বৃষ্টি হয়ে গেছে। সকাল দশটায় ঘুম ভাঙার পর বাদল চিত্কার শুরু করে দেয়।’ ইশ আজ এত দেরি হয়ে গেল, কেউ আমাকে একটু ডাকলে না’।এগারোটার মধ্যে বাদলকে অফিসে পৌঁছাতে হবে, নতুবা এবসেন্ট হয়ে যাবে সে। একদিন সূর্য নাও উঠতে পারে কিন্তু অফিস বন্ধ বাদলের দীর্ঘ পনেরো বছরে একদিনও হয়নি। নাম বাদল হলেও বৃষ্টি সে খুব একটা পছন্দ করে না। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, স্নান সেরে, ঠাকুর প্রণাম করছিল বাদল; এমন সময় তার মা বাণী দেবী পাশের ঘর থেকে জানায়– ‘টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে খেয়ে যাবি খোকা’। বাদলের অফিস দমদম নাগের বাজারের কাছে। বাদল থাকে দমদম ক্যান্টনমেন্টে। মোটরসাইকেলেই সে অফিসে যায়, কিন্তু আজ সে মনস্থির করে অটোতে অফিস যাবে। সাড়ে দশটার সময় মাথায় ছাতা দিয়ে অটো স্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা শুরু করে। হঠাৎ এমন কিছু ছোট ছোট বিষয় ছবির মতো বাদলের চোখের সামনে ঘটে যার ফলে সে ভুলেই যায় এগারোটার মধ্যে তাকে অফিসে ঢুকতে হবে।
বৃষ্টি অনবরত চলছে, সাথে হাওয়া আছে। ছাতা মাথায় যেতে যেতে বাদল দেখল রাস্তার পাশের একটি মাঠে রাজহাঁস ও পাতিহাঁসগুলি বৃষ্টির মধ্যে একসঙ্গে খেলা করছে। নিজেদের পিঠের পালক ঠোঁট দিয়ে পরিষ্কার করছে, ভিজে গা ঝাড়ছে এবং থেমে থেমে বৃষ্টির জমা জলে ডুব মারছে। কয়েকটি বারো-চোদ্দ বছরের ছেলে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে ও আনন্দ উপভোগ করছে। একটি পাগলি মেয়ে তার শাড়ির কোচরের মধ্যে বৃষ্টির জল ধরার চেষ্টা করছে। আকাশের পেঁজা তুলোর মতো মেঘেদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতে দেখল বাদল। তার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল এই দৃশ্যগুলো দেখে। হাঁসেদের গা ঝাড়া দেখে বাদলের ময়ূরের পেখম মেলার কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল মেঘেদের দেখে মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের মেঘেদের কথা। পাগলী মেয়েটির কোচরে জল ধরা দেখে বৈষ্ণব পদাবলীর অভিসারিকা রাধার কথা মনে পড়ে যায় বাদলের। অফিস যাওয়ার বিষয়টা এই রোমাঞ্চকর আনন্দ অনুভূতির মাঝে ভুলেই গেল সে। একই জায়গায় প্রায় আধা ঘন্টা দাঁড়িয়ে এই সকল সুখকর অনুভূতি হল বাদলের। তখন সকাল এগারোটা বেজে গেছে। ছেলের দল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফুটবল খেলা শুরু করেছে। বাদলের প্রিয় খেলা ফুটবল। তারপর বৃষ্টির দিনে ফুটবল খেলার মজাই আলাদা। নিমেষের মধ্যে ছাতা বন্ধ করে অপলক দৃষ্টিতে ছেলেগুলির কাছে গিয়ে বলল– আমাকে তোমরা খেলতে নেবে? বাদল যেহেতু পঁয়ত্রিশ বছরের এক যুবক, তাই তার খেলার কথা শুনে ছোট ছোট ছেলেরা একটু হেসে উঠেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একজন সবাইকে চুপ করিয়ে বাদলকে বলল–‘ কাকু আপনি অবশ্যই খেলতে পারেন, আমাদের দলে একজন কম আছে’।বাদল কম দলের একজন প্রতিনিধি হয়ে প্রায় দুই ঘন্টা বৃষ্টির জলে ভিজে ফুটবল খেলল। শরীর খারাপ হতে পারে এ ভয় একবারের জন্যও তার মনে আসেনি।
দুপুর একটার সময় অটো ধরে বাদল অফিসে পৌঁছায়। অফিসে ঢোকার সময় দ্বাররক্ষি তাকে জানায়–আজ তার অফিস আস্তে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সুতরাং কাজ করলেও এবসেন্ট হবে। সে নিজের কাজের প্রতি এতই দায়িত্বশীল ছিল যে এবসেন্ট জেনেও কাজ করে সন্ধ্যা ছটায় অটো ধরে বাড়ি ফেরে। যখন অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল তখন আর বৃষ্টি ছিল না। বৃষ্টি থেমেছে তিন ঘন্টা। অটো থেকে নেমে বাদল যখন হেটে হেটে বাড়ি যাচ্ছিল ,তখন শুনতে পেল ব্যাঙের ডাক। সেই ডাক বাদলকে নস্টালজিক করে তুলল।তার ছোটবেলার দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল।বাড়ি ফেরার পর সারারাত আনন্দে বাদলের ঘুম এলো না । আজ এই বর্ষার দিনের এমন সুন্দর অনুভূতি জীবনে কোনদিন সে উপলব্ধি করেনি।