— “তিতির এগারোটা বেজে গেছে | ওঠ এবার, কখন ভাত খাবি? আর কখন চা ??
তিতির মায়ের ডাকে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুলো|
রোজই এমন সময় ঘুমোয় | সারা রাত ধরে ফোনে কী যে করে অপর্ণা বুঝে উঠতে পারেনা| অনেকবার মেয়েকে বারণ করেছে কিন্তু তিতির মাকে পাত্তাই দেয় না | অপর্ণার ভয় করে যখন ফোন চার্জে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গুজগুজ করে |
অবশ্য এ সংসারে কেইবা তার কথা শোনে | আগে রাগ হতো এখন সয়ে গেছে| মেয়েকে কিছু শেখাতে গেলেই যতদিন শাশুড়ি বেঁচেছিল আপত্তি জানিয়ে এসেছেন | বংশের একমাত্র সন্তান বকা যাবে না অথচ নাতনি হয়েছে শুনে প্রথম প্রথম কী রাগ | মাস ছয়েক যেতে না যেতেই শুরু হলো সোহাগের বাড়াবাড়ি| যত বড়ো হচ্ছে ততই বেয়াড়া, অবাধ্য তৈরী হচ্ছে | আর এখন মা তো শত্রু | ছোটবেলায় পড়াশোনায় কত ভালো ছিল কিন্তু ফাঁকি দিয়ে দিয়ে অর্ডিনারি রেজাল্ট করে বসে আছে | আর মুখে কেবল বড়ো বড়ো কথা | ছোটোখাটো চাকরি তে ঢুকছে আর পোষাচ্ছেনা বলে ছেড়ে দিচ্ছে | পোষাবে কী করে? তারজন্য পরিশ্রম করতে হয় কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হয় | অপর্ণা সব বোঝে | একমাত্র মেয়েকে সে সঠিক শিক্ষা দিয়ে মানুষ করতে পারেনি | বাবাও তো কিছু বলবে !! সেও সমানে হাত খরচের গুচ্ছের টাকা দিয়ে মেয়েকে অলস,লোভী তৈরী করে দিয়েছে | কিছু অর্জন করতে গেলে যে তার যোগ্য হতে হয়, সে শিক্ষা আর দিতে পারলো কোই ??
— কাকিমা একটু দরজাটা খুলবে?
— কে ?
— আমি কলি …
—ও আয় আয়, ভেতরে আয়|
— কী খবর রে বাড়ির!!সবাই ভালো আছে তো??
— আছে কাকিমা | মা পাঠালো বৃহস্পতিবার মা সত্যনারায়ণ পুজো করবে | সন্ধ্যে বেলা তোমরা আমাদের বাড়ি যেও| তিতিরকে অবশ্যই নিয়ে যাবে| মা অনেক করে বলে দিয়েছে|
— দেখি ওকে বলবো, তবে কেউ না গেলেও মাকে বলিস আমি যাবো |
— বলবো,তবে সবাই মিলে গেলে মা খুশি হবে |
— তুই এখন কী করছিস কলি?
— এ বছর এম.এস.সি ফাইনাল ইয়ার দেব|
— বাহ!! খুব ভালো
— যাই কাকিমা আমার পড়ানো আছে|
— ঠিক আছে যাবি তো, তার আগে একটু মিষ্টিমুখ
করে যা | মিষ্টিটা মুখে পুরে এক ঢোক জল খেয়েই কলি ছুটলো টিউশন পড়াতে |
অপর্ণা মনে মনে ভাবে পিতৃহীন মেয়েটি তিতিরের বয়সি হবে, অথচ সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের | একে দেখলে কে বলবে আজকালকার মেয়েরা, অবাধ্য, অলস, দায়িত্বজ্ঞানহীন হয় !
— মা এক কাপ গ্রীন টি দাও| আর কিছু খাবো না |
— একটা বিস্কুট অন্তত খা |
— বললাম তো কিছু খাবোনা | তোমার ওই তেলে ঝোলে রান্না খেয়ে একেই মুটিয়ে যাচ্ছি তারপর ব্রেকফাস্ট করলে আর দেখতে হবেনা |
— আর কিছু শেখো আর না শেখো শুধু ওই কায়দাই শিখেছো | যাক, কলি এসে নিমন্ত্রণ করে গেছে|
— কিসের ?
— সত্যনারায়ণ পুজোর| তোকেও অনেক করে যেতে বলেছে| কলি দেখলাম এখনকার মেয়েদের মতো বাতিকগ্রস্ত নয়,মিষ্টি দিয়েছি খেতে, সোনা মুখ করে খেয়ে নিলো, মোটা হওয়ার বাহানা দেখালো না একবারও |
— তুমি কী বলতে চাইছো বলতো!! ও মিষ্টি খেয়েছে বলে আমাকেও খেতে হবে !! ওর ফিগার সম্পর্কে কোনো কনশাসনেস আছে নাকি !!
— অতো কনশাস হবার দরকারটাই বা কি? সুস্থ
থাকলেই তো হলো |
— দেখো মা তোমার মতের সাথে আমার মিলবে না|
বাদ দাও ও চ্যাপ্টার|
— ও চ্যাপ্টার কেন? কোনো চ্যাপ্টারই মিলবেনা | সেটা যদি মেলানোর চেষ্টা করতিস আখেরে তোরই লাভ হতো|
কোনো দিন আমার একটা কথা শুনেছিস ??
— দূর নিকুচি করেছে!! আমায় চা দিতে হবে না | দয়া করে তোমার জ্ঞান দেওয়া থামাও |
বলেই দড়াম করে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো তিতির|
অপর্ণা খানিক হতবাক হয়ে বসার ঘরের সোফায়
বসে পড়ে | মিনিট দশেক বাদে না খেয়েই তিতির গটগট করে বেরিয়ে যায় | কোথায় যাচ্ছে মাকে বলার প্রয়োজনটুকু বোধ করেনা | অপর্ণাও কিচ্ছু জিজ্ঞেস করে না| তেইশ বছরের মেয়ের এমন আচরণে কষ্ট পেলেও অপর্ণা ভেঙে পড়ে না |
রাত আটটায় অরূপ ঘরে ঢোকে| দশ মিনিট আগে তিতিরও ফেরে| অপর্ণা অরূপের জন্য চায়ের জল বসায় | চা খেতে এসে অরূপ তিতিরকে রোজকার মতো ডাক দেয় |
— তিতির কেও চা দাও|
— অপর্ণা এক কাপ চা অরূপের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে তুমি খাও|তোমার জন্যই শুধু বানিয়েছি | বলে বারান্দায় গিয়ে বসে |
অন্ধকার রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে তার বুকের ভিতরটাও নিকষ আঁধার| এই পঁচিশটা বছর কেবল অন্যের ইচ্ছে অনিচ্ছের সাথে আপোষ করতে করতে কখন যে নিজের আমি টাকে হারিয়ে ফেলেছে এই সংসারের ঘূর্ণাবর্তে নিজেই জানেনা | সারাটা দিন অনিচ্ছের
খেলনাবাটি খেলে লাভ কী হলো !! তার চেষ্টায় কোনো কী ফাঁক থেকে গেছিলো ! কোনো ফাঁকি !! এই বিরাগ তো একদিনে জন্মায়নি | শুরুতে ওতো সংসার করতেই চেয়েছিলো | কিন্তু প্রথম থেকেই ওকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল এটা তার বাড়ি নয় | থাকা খাওয়ার অভাব যেমন নেই তেমন মতামতেরও দাম নেই | সিদ্ধান্ত যা নেওয়া হবে তা এ বাড়ির জন্মসূত্রে অধিকার প্রাপ্ত সদস্যরাই নেবে কোনো বাইরের লোক নয় | সেই ধারা মেনে মেয়েও তার মাকে অবজ্ঞা করার শিক্ষাটা বেশ রপ্ত করেছে | অপর্ণা আর এসব ঘটনা ভাবতে চায় না…..
— দশটা বাজে খেতে দেবেনা | কী করছো এতক্ষন এখানে দাঁড়িয়ে |
— চলো দিচ্ছি |
একী আমার একার খাবার কেন ? তিতির খাবে না?
— জানি না
— মানে ! তিতির তিতির …
—কি বলো?
— খাবি না ?
— দিলেই খাবো ?
— কিন্তু এ বেলা আমি যে ওর জন্য কিছু করিনি|
— কেন করোনি ?
— তোমার মেয়েকে সে প্রশ্ন টা করো ! বলেই এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে অপর্ণা ব্যালকনিতে চলে আসে|
ঝনঝন করে প্লেট ভাঙার শব্দে বাতাস কেঁপে ওঠে |
সকাল থেকে ও কিছু খেয়েছে কিনা একবারও এ প্রশ্ন কারুর মনে আসে নি| শুধু সে কেন নিয়মের অন্যথা ঘটালো সেটাই বিচারের বিষয় | ভালো করেই জানি তিতির দুপুরে রেস্টুরেন্টে খেয়েই বাড়িতে ঢুকেছে |
ভাগ্যিস এই ব্যালকনিতে পর্যাপ্ত হওয়া আছে তা নইলে অপর্ণা কবেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শেষ হয়ে যেত …..