অণুগল্পে মৌসুমী মৌ 

মেঘ পেরিয়ে

সকাল থেকে আকাশের গায়ে লেপ্টে থাকা নাছোড় মেঘ দেখে তৃণার মনটা খারাপ হয়ে যায়| চায়ের জল চাপিয়ে রান্নাঘরের জানলাটা খুলে দেয় সে| হাওয়া নেই সকাল থেকেই| ভ্যাপসা গরম| চায়ের পাতা ভিজিয়ে চার বছরের ছেলে তাতানের জন্য কমপ্ল্যান  করতে গিয়ে দেখে ফুরিয়ে গেছে| চামচ দিয়ে কৌটোর গায়ে লেগে থাকা অবশিষ্টটুকু গ্লাসে নিয়ে গুলছে ইতিমধ্যে দেখে সৈকত কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে| ওর গরম নিঃশ্বাস  পড়ছে ঘাড়ের ওপর|  ফিরে তাকাতেই মুখটা দেখে মায়া হয় তৃণার| সৈকতের চোখে ঘুম নয় অনিদ্রা আর দুশ্চিন্তার ঘোলাটে দৃষ্টি|
— কমপ্ল্যান নেই বলো নি তো?
তৃণা বিরক্ত হবে না মনে করেও বলে ফেলে,
—  শুধু কী কমপ্ল্যান| সংসারের অনেক জিনিসই বাড়ন্ত| কত গুলো বলবো?
— তবুও যেটা না হলে নয় সেটা তো আনতে হবে|
— কোথা থেকে আনবে! আজ মাসের কুড়ি তারিখ হয়ে গেলো স্যালারি ঢুকিয়েছে?
— না|
— তবে?
— ভাবছি ছোটো কাকার কাছ থেকে হাজার পাঁচেক নেবো|
— গত মাসের দুহাজার টাকা এখনো দিতে
পারোনি মনে আছে| আর কত ছোট করবে আমাদের! কাকিমা কথা বলতে গেলে বিরক্ত হয়|
— দিয়ে দিতাম তো গত মাসে তোমার জন্য কতগুলো এক্সট্রা টাকা গচ্চা গেলো|
— আমি বুঝবো কী করে তাতানের ওটা ভাইরাল ফিভার ছিল|
— অকারণে অতগুলো টেস্ট করতে হলো|
— সব দোষ এখন আমার! সংসারে জিনিস ফুরিয়ে যাচ্ছে, তোমার মাইনে ঢুকছে না, ছেলের অসুখ– সব সব আমার জন্য!
— আমি কোথায় তা বললাম! ইচ্ছে করে অশান্তি করছো|
ইতিমধ্যে তাতানকে কমপ্ল্যানের গ্লাসটা এগিয়ে দিলে তাতান মুখে নিয়ে বেসিনে কুলকুচি করে ফেলে দেয়|
তৃণা রাগের মাথায় তাতানের পিঠে দুচার ঘা কষিয়ে দিলে তাতান চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,নিজে খেয়ে দেখো কী বিচ্ছিরি খেতে| একদম জল|
সৈকত তৃণার রুদ্র মূর্তি দেখে ছেলেকে আড়াল করে|
— ছেড়ে দাও ওকে বরং আমার থেকে একটু চা দাও|
— আর কী বাকি আছে! এবার ছেলেকে নেশাড়ু বানাও|
সৈকত চা না খেয়েই বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসে| ব্যাগে দেখে শতিনেক টাকা পড়ে আছে| জানেনা কাজটা থাকবে কিনা| নিজের বলতে কাকাই কাছে আছে| কিন্তু কাকার কাছে কতবার হাত পাতা যায়| জমা টাকার সুদ ও এক ধাক্কায় অনেক কমে গেছে| সৈকত কিছু ভাবতে পারে না| চারিদিক ভীষণ শুনসান| সারা পৃথিবীকে যেন ভূতে ধরেছে|
সকাল থেকে না খাওয়ার জন্য মাথাটাও ঘুরছে| মনে ভাবে তৃণারই বা দোষ কোথায়? ও এতদিন কোনো অভিযোগ না করেই মানিয়ে নিয়েছে| মাথা ঠান্ডা হতে বাড়ি ফিরে আসে সৈকত|
তৃণা ওকে ফিরতে দেখে বলে,
–স্নান সেরে এসো খেতে দেব|
ঘরে যা আছে তাই দিয়ে বর আর ছেলেকে গুছিয়ে খেতে দেয় তৃণা|
–তারপর নিজে খেতে বসে|
সৈকত খেয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা আধখাওয়া সিগ্রেট ধরায়| ইতিমধ্যে দেখে বসের ফোন|
তৃণার কানে আসে
— এই মুহূর্তে কী করে সম্ভব| স্যালারি ঢোকেনি তা ছাড়া কোম্পানি যদি প্রোভাইড না করে আমি এই মুহূর্তে কী করে ল্যাপটপ কিনবো!
তৃণা তাড়াতাড়ি উঠে আসে| ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
— কী হয়েছে?
সৈকত ফিসফিস করে বলে,
— বাড়িতে বসে কাজ করতে বলছে| কিন্তু এই মুহূর্তে কী করে সম্ভব! তৃণা বলে,
— বলে দাও একটু পরে ফোন করছি|
সৈকত বসকে জানায় স্যার আমি দু মিনিট বাদে রিং ব্যাক করছি|
— কী বলছো বলো,ফোন কাটতে বললে কেন?
— বস তোমায় কী বললো? স্যালারি কবে দেবে?
— বললো তো কাল পরশুর মধ্যে ঢুকে যাবে| তবে কাজটা থাকবে কিনা জানিনা | বাড়িতে  বসে কাজ তুলে দিতে হবে| তার জন্য ল্যাপটপ চাই| ছেলের কমপ্ল্যান কিনতে পারছিনা আর ۔۔۔
— তৃণা সৈকতের কাঁধে হাত রেখে বলে আছিতো আমি| ব্যাংকে আমার বইয়ে কিছু টাকা আছে| মনে হয় ওতেই হয়ে যাবে |
–তোমার বইয়ে!
— হুম বাবা মারা যাবার আগে আমাকে দিয়ে ছিল|
— ওটা উনি তোমাকে শেষ সময়ে দিয়ে গেছেন| ও আমি নিতে পারবো না|
— যাতে অসুবিধের সময় কাজে লাগে তাই জন্যই তো দিয়েছেন| সংসারটা তো আমারও নয় কী??
সৈকত এক দৃষ্টে তৃণার দিকে তাকিয়ে থাকে|
সকালের সেই রুদ্র মূর্তির পরিবর্তে সারা মুখ জুড়ে এক অদ্ভুত মমতা লুকিয়ে আছে|
তৃণা ফোনটা এগিয়ে দেয়|
— কী হলো ফোনটা করে জানিয়ে দাও
আজ কিনবে|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।