• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি – তে মালা মিত্র

সাদা গোলাপ

ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের সানাই এর করুণ সুরের অনুরণনেে চতুর্দিক মুখরিত।
তবু এই সুরে অদ্ভুত মাদকতা আছে।আনন্দ বিষাদ মিলেমিশে দুটি মনকে একত্রে বাঁধার যে অনুষ্ঠান, অজানা কে জানার, পরকে আপন করার যে শুভ যোগাযোগ সেটাই ঘটে চলেছে,আবহে সানাই,বাগেশ্রী রাগে হৃদয় মুচড়ে ব্যথা যন্ত্রণা নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কেঁদে চলেছে সানাই, সে নাই, সে নাই, ধ্বনি তে।
আজ সেমন্তীর কানে সানাই এর আওয়াজ বিষ তেতো লাগছে।হাতের ছোট্ট রুমালে সে বার বার তার চোখের জলে মুছে চলেছে, গোপনে।
আঠাশ বসন্ত চোখে নেওয়া, পূর্ণ ফোটা সেমন্তীর কি নেই!
ফর্সা শিখর দর্শণা সেমন্তীর পরনে দামী সাদা জারদৌসি শাড়ী,মানান মত হাল্কা গোলাপী ডিজাইনার ফুল স্লিভ ব্লাউজ,মার্জিত গহনায় অনন্যা করে তুলেছে তাকে।সেমন্তী কে সার্থক নামা মনে হচ্ছিল, দেখাচ্ছিল যেন প্রস্ফুটিত সাদা গোলাপ।চোখ ধাঁধানো রঙের মেলায় এই মেয়েটি নজর কাড়ছিল সবার।
বরবেশী পলাশ কালচে লাল ধুতি, আর ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি তে অসাধারণ!
সে বৌভাত অনুষ্ঠানের তদারকি তে ব্যস্ত।
রেলওয়ে দপ্তরের সব অফিস কলিগের সাথে তার নব পরিণীতা স্ত্রীর আলাপ করিয়ে দিচ্ছিল,পরিচয় করিয়ে দেয় সেমন্তীর সাথে ও।
ফর্সা, লম্বা, ছিপছিপে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সুদর্শন পলাশের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না সেমন্তী।চোখ দুটো বার বার জলে ভ’রে উঠছিল।
মনে তোলপাড় গত চার বছর, কতই না স্বপ্ন বুনেছে তার দীঘল চোখ, কত অন্তরঙ্গ মুহূর্ত উপহার এ চার বছরে সে পেয়েছে পলাশের কাছ থেকে।
ভুলেই গিয়েছিল সে সাদা ফুল, রঙীন স্বপ্ন তার দেখতে নেই।
সেমন্তী কে উজার করে পেয়ে একদিন পলাশ বলেছিল,’এরপর আর অন্য কিছু ভাবতে পারি না সুমী’।
যতই বিদ্যাসাগর তার অমূল্য সময় দিন বিধবাদের উন্নতিতে,সমাজ কি ঠিক ততটাই বদলেছে?তার ওপর কত বিধিনিষেধ, কোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে সে সামনে আসতে পারবে না,এ সমাজের প্রতিটি মানুষ তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে, তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য সে দায়ী,এখন তার মাঝে মাঝেই মনে হয় এর চেয়ে হয়ত সতীদাহ ঠিক হোতো, যে গেল সে তো গেল, যে রইল তাকে জীবন্ত তিলেতিলে মরতে হয় এই দেশে।
সামাজিক নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে, যে মেয়ে চলতে চায়, সে হোক না বিমানচালক অথবা বাস কন্ডাকটর, সে মেয়ের পেছনে শুধুই ফিসফাস, সে বিধবা বলে।
সেমন্তীর মনে পড়ে তার বিয়ের দিনটি, পরিবারের দুলালী মেয়েটি লাল বেনারসী গয়না গায়ে জড়িয়ে,সে যেন হয়ে উঠেছিল সাক্ষাৎ লক্ষীী মূর্তি। বুবুদাকে খুব পছন্দ করত সে,শুধু মাত্র বাবা দাদাদের কড়া পাহারার ভয়ে সে প্রেম বেশীদূর গড়াতে পারেনি।
বিয়ের দিন সেই বুবুদাই আর সবার সাথে তার পিঁড়ি ধরেছিল।
যাইহোক বাসরে স্বামী শৈরিকের সাথে তার পরিচয় হয়।সে কম কথার মানুষ ছিল,বিয়ের পর কোনো বিষয়ে তার কোনো ত্রুটি ছিল না,যা প্রয়োজন, না চাইতেই শৈরিক সব হাজির করত।বছর না ঘুরতেই দুজনের সন্তান এল,ওরা তার নাম রাখল আরিয়ান।
সেমন্তীকে একা বাচ্চার জন্য সব করতে হ’ত না, সারাদিনের খাটাখাটুনি স্বত্তেও আর্য কে ও অনেক দেখাশোনা করত।
শরিকের একটাই দাবী ছিল, অফিস থেকে এসে তার বউকে টিপটপ সেজে থাকতে হবে, সেমন্তী একটু ক্ষুন্ন হ’ত ভাবত সে কি সুন্দর নয় যে তাকে সবসময় সেজে গুজে থাকতে হবে?
নির্বিঘ্নে বিয়ের চারবছর কেটে গেল দেখতে দেখতে।
সেদিনটা ছিল ওদের বিবাহবার্ষিকী, এদিন’টা ওরা সেলিব্রেটি করে, বাইরে খাবার খেয়ে ঘরে ফেরে, শৈরিক সেদিন সেমন্তীকে একটা ডায়মন্ডের হার্টসেপ নাকছবি গিফট করে।
রাত হয়েছিল ফিরতে, ফ্রেস হয়ে তারা তারাতাড়ি শুয়ে পড়ে।
পরদিন বেলা আটটা নাগাদ সেমন্তীর ঘুম ভাঙে,তারাতাড়ি পরিছন্ন হয়ে সে রান্নাঘরে ঢোকে,দেখে এর মধ্যে শৈরিকের বাজার করা সারা, চা তৈরি করে সেমন্তীকে এগিয় দেয় সে, সেমন্তী লজ্জা প্রকাশ করে বলে,’রাখো না নিচ্ছি’,সে বলে,’থাক থাক অত লজ্জা পেতে হবে না, মেয়ে কুম্ভকর্ণ কোথাকার’!
এরপর কোথা দিয়ে সময় চলে গেছে,সেমন্তী রান্না করে ওর টিফিন গুছিয়ে শৈরিককে খেতে দেয়, আর্য কে আদর করছিল শৈরিক, ছেলে টাও খুব বাবার ন্যাওটা ছিল, কোল থেকে আসবেনা কিছুতে, জোরকরে সেমন্তী কোলে নেয়।
যথারীতি খাওয়া দাওয়া করে শৈরিক অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
দশমিনিট ও যায় না একটা সম্মিলিত চিৎকার শোনা যায়, স্টেশনের গা ঘেঁসা এই রেলকোয়ার্টাসে।
দৌড়ে আসে সেমন্তী জানলায়, বোঝেনা কিসের ভীড়, ও কাজে মন দেয়।
‘বৌদি শীগগির দরজা খুলুন’,চিৎকার করে একদল লোক, সে দরজা খুলে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?’সর্বনাশ হয়েছে’, কথা বলতে পারে না সেমন্তী, দৌড়ে চলে স্টেশনে ভীড় কে উদ্দেশ্য করে,এরপর ঘন অন্ধকার, আর কিছুই তার মনে নেই!
শৈরিক কোনোদিন ওভার ব্রীজ দিয়ে যেত না,সময় সংক্ষেপের জন্য ডাউন লাইন ক্রশ করে আপে উঠত,এরপর ট্রেনে করে অফিস যাওয়া।তারাতাড়ি তে একটা মেল ট্রেন আসছিল ও খেয়াল করে নি,তাকে পিষে দিয়ে চলে যায় মেলট্রেন, শেষ হ’ল শৈরিশ সেমন্তীর চার বছরের একসাথে পথ চলা।
অনেক জুতোর শুকতলা খুইয়ে সেমন্তী তার স্বামীর চাকরিটা পায়।
যদিও সে রেলকোয়ার্টাসে থাকে,মা ছেলে দিন এগিয়ে চলে,বড় একা একা লাগে তার, পাশাপাশি টেবিলে কাজ করতে করতে পলাশের সাথে হৃদ্যতা হয় তার,আসলে দপ্তরীয় কাজে সেমন্তী একেবারে আনাড়ি ছিল, পলাশ তাকে হাতে ধরে কাজ শেখায়,সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, চোখে চোখ পড়লে লজ্জায় কুঁকড়ে যেত সেমন্তী, আরো উড়ন্ত বহু চোখ তাকে বিব্রত করত সে তাদের এড়িয়েই চলত।
পলাশের প্রেম মাখা দৃষ্টি সেমন্তী ফিরিয়ে দিতে পারেনি, শ্রদ্ধা ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা, অথবা হয়ত কোনো জৈবিক চাহিদা ছিল তার, তা হয়ত সে নিজেই জানেনা।
সেমন্তীর জীবনে যে বিশাল ফাঁক ছিল, সেই ছিদ্রটুকু দিয়েই পলাশ পৌঁছয় তার অন্তস্তলেে, খুবই সুখে সুখী ছিল দুজন দুজনায়, সেমন্তী স্বপ্নেও ভাবতে পারে নিয়ে এরমধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটবে।
বিপন্ন সেমন্তী সানাই এর সুর থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, নিজেকে স্বান্তনা দেয় এই বলে,সেমন্তী তো সাদা, সাদা আর বহুবর্ণের রঙ মেলে কখনো?
এ সমাজ কি সাদা কে রঙিন বলে ভাববার স্পর্ধা দেখাবে?
মনে ভেসে ওঠে তার আর্য সারল্য মাখানো মুখখানি,সংযত হয় সেমন্তী।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *