গ এ গদ্যে মেরী খাতুন (পর্ব – ১)

এক মুঠো রোদ্দুর

দেখো দেখো আমার হাতে কি?রোশনী-র খুশির ডাক কানে আসল মৌরির।মৌরি ওর বাচ্চামিতে হেসে ওঠে।রোশনী বাসের জানালার থেকে আসা সূর্যাস্তের মিষ্টি আলো কে ধরে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখতে চেষ্টা করছে।মৌরি না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল কি আছে?
—-দেখো না আমার মুঠোয় সূর্যের আলো।রোশনী এই কথা বলার সাথে সাথে হাতের দিকে ইশারা করলো।
ধূর পাগল সূর্যের আলো কখনো হাতের মুঠোয় ধরা যায়?
ও তো তোমার আঙ্গুলের উপর আছে দেখো।মৌরি মেয়ের খুশি নষ্ট করতে চায় নি কিন্তু সত্যি কথা থেকেও মুখ ফেরাতে পারলা না।
মুহূর্তে রোশনী উদাস হয়ে গেল,আবার হেসেও উঠলো।রোশনীকে কিছু বলার আগেই একটা ডাক মৌরিকে অন্যমনস্ক করে দিল।
আপনার মেয়ে তো খুব সুন্দর!মৌরি ওনার দিকে তাকিয়েই রোশনীকে কোলে তুলে নিয়ে জানালার ধারে সরে বসল।আর মনে মনে হাসিকে আটকিয়ে নিয়ে ভাবল আচ্ছা বাহানা সিট নেওয়ার।
—-আপনার অফিসে আজ প্রথম দিন কেমন গেল পাশ থেকে আওয়াজ আসলো।
—-খুব ভালো।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মৌরি রোশনীর সাথে কথা বলতে লাগল।বাসের মধ্যে চেঁচামেচির শব্দ।যখন কোলকাতায় ছিলাম তখন লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করতাম।এখানকার থেকে ওখানকার সব কিছুই আলাদা।বর্ধমানে এসে রোশনীর কোন খেলার সাথী এখনও পর্যন্ত হয়ে উঠে নি।যে জায়গায় মৌরিরা আছে সেখানকার খেলার মাঠে রোশনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিবেশীরা বলে, কিন্তু মৌরি নিয়ে যায় না।কারণ কাউকেই তো সে ভাবে এখনো চিনে উঠতে পারেনি।তাই অফিসের বসকে বলে রোশনীকে কিছুদিনের জন্য অফিসে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পায়।বস খুব ভালো লোক,ও খুব দরদীও।
পরের দিন সকালে মৌরি অফিস যাওয়ার জন্য বাসে উঠতে গিয়ে দেখে আবার সেই কালকের সন্ধ্যার লোকটির হাসির চেহারা।
Good Morning mam,
—মৌরি,মৌরি মুন্সী।
—-মোহিত পাল।আপনার আফিসেই আর্ট বিভাগে কাজ করি।চলতে চলতে উনি রোশনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন ,
আর তুমি মা?
রোশনী মুন্সী।
রোজ সকাল-সন্ধ্যা বাসে ওঠা,মোহিতের সাথে দেখা,অফিসের কাজ,রোশনীর দেখাশোনা,অফিসের পার্টি এসব নিয়ে দেখতে দেখতে কখন যে বর্ধমান শহরে এক সপ্তাহ কেটে গেল মৌরির, কে জানে।অপরিচিত লোক কখন আপন হয়ে উঠলো বুঝতেই পারল না। সম্পর্কের ডাকও কখন আপনি থেকে তুমিতে পরিণত হয়ে গেছে বুঝতে পারে নি।
কোলকাতা থেকে যখন আসে তখন ও কত কসম খেয়েছিল ,যেমন করে শহর বদলেছে তেমন করে নিজেকেও বদলিয়ে নেবে।কিন্তু কোথায় আর পারল নিজেকে বদলাতে?সেই জোরে-জোরে হাসি,জোরে কথাবলা,কিছু না ভেবে অন্যকে সহজে আপন বানিয়ে নেওয়া আর বন্ধু -বান্ধবী বানিয়ে সকলকে খুব সহজেই বিশ্বাস করা।কিছুই তো বদলাতে পারল না মৌরি,শুধু শহর ছাড়া।সত্যি তো শহর বদলালেও কিছু বদলায় না।যেমন মৌরির চিন্তা,ওর সমস্যা কোন কিছুই বদলালো না।যার জন্য ও কোলকাতা থেকে বর্ধমানে আসল।সব থেকে বড় প্রশ্ন যেটা ওর সামনে এসে দাঁড়ালো সেটা হলো রোশনীর বাবার পরিচয়।ওর বাবার অস্তিত্ব।যার ওর কাছে কোন উত্তর ছিল না।ধীরে-ধীরে অফিসের বাইরে সবার কাছে মৌরির নিজের জীবন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে।সে আফিসের পুরুষ সহকর্মী হোক বা মহিলা সহকর্মী।
শুধু একটাই ওর ভালো বন্ধু ছিল মোহিত।যার সাথে বাসে ওর প্রথম পরিচয়।আসানসোলে বাড়ি।বর্ধমানে দিদি-জামাইবাবুর সাথে থাকে।বাড়িতে মা এবং বাবা আছেন।মোহিত ওকে কোন দিনও কোন প্রশ্ন করেনি।
তবে রোশনী যখন বিকালে খেলার মাঠে খেলতে যায় তখন ওর বন্ধু-বান্ধবী কেউ কিছু বলে না বা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করে না।কিন্তু ওদের মা-বাবা রোশনীকে ওর বাবার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে।রোজ রোশনী বাড়িতে মৌরির কাছে একই প্রশ্ন করে ওর বাবা কোথায়?কে ওর বাবা,কেন বাবা ওদের সাথে থাকে না এ সব অনেক প্রশ্ন।
মৌরি ক্লান্ত হয়ে পড়ে এই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।কোলকাতায় তো ঘরে ঘরে সমস্যা ছিল,আর এখানে তো বাইরেও কত সমস্যা।ঘরের লোককে তো উত্তর দিতে পারত।বাইরের লোকের সাথে কি ভাবে যুদ্ধ করবে।কি ভাবে উত্তর দেবে? ও তো এই পৃথিবীতে রোশনীকে নিয়ে খুশিতে আছে।কেন লোক ওদেরকে একটু শান্তিতে,আনন্দতে,খুশিতে থাকতে দিচ্ছে না?আর রোশনীর বাবা কে সে ব্যাপারে জেনেই বা কি হবে? মৌরি ভেবেছিল ও একা থাকলে স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে,শান্তিতে থাকতে পারবে।কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকা তো দূরে থাক এখানে লোকের মাথায় পুরনো দিনের যত সব নোংরামী প্রশ্ন।
মৌরি বেশি ভাবতে পারেনা।আর বেশি ভাবতেও চায় না এ সব নিয়ে।আজ তো ওর কাছে খুশির দিন।তাই না?আরে আজ তো রোশনীর জন্মদিন।আজকের দিন ওর জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন।কারন আজকের দিন যদি না হতো তাহলে ওর জীবনে অন্য কিছু হতো।আজ ও আর রোশনী খুব আনন্দ করবে।রোশনীকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে।রোশনীকে নতুন ফ্রক পড়িয়ে পরির মতো সাজিয়ে বাড়ি থেকে বের হবে কি দরজার বেল বেজে উঠল।মৌরি দরজা খুলে অবাক!
আরে মোহিত, তুমি?এই সময়।
মোহিত কিছু না বলে মৌরিকে ধাক্কা দিয়ে একটি বড় উপহার নিয়ে রোশনীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে দিয়ে জন্মদিনের আশীর্বাদ ও শুভকামনা জানালো। রোশনী তো উপহার পেয়ে ভীষণ খুশি।ওর চোখেমুখে এতো খুশি মৌরি আগে কখনো দেখেনি।আর দেখবেই বা কেমন করে আগে তো কেউ কখনো এমন উপহার নিয়ে রোশনীকে দেয় নি।রোশনী মোহিতকে জড়িয়ে ধরে বলে,
Thank you uncle.
মৌরি হতবাক হয়ে মোহিতকে বলল তুমি কি করে জানলে যে আজ রোশনীর জন্মদিন।
মোহিত হেসে বললো, কেন? জানার ইচ্ছে থাকলেই সব জানা যায় ম্যাডাম। যে জানতে চায় সে সব কিছুই জেনে ফেলে।
মা মোহিত আঙ্কেলকে আমাদের সাথে বেড়াতে নিয়ে যাব-যাব-যাব—
রোশনী চিৎকার করতে থাকে।মোহিত তো তৈরিই ছিল শুধু ওর হ্যাঁ বলার অপেক্ষায় ছিল।এর পর তিন জন মিলে পার্কে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়ল।রোশনী তো ভীষণ খুশি।কখনো দোলনায়,তো কখনো বোটিং, রাইডিং,মিনি ট্রেনে চড়ে বেড়িয়ে ক্লান্ত রোশনী একটু বসে।এরপর খাওয়ার বাহানা কখনো আইসক্রিম তো কখনো চিপস্ এই ভাবে ওর যত আবদার আছে মনে হচ্ছে এক দিনেই শেষ করে নিবে ও এতোটাই আজ খুশিতে মগ্ন।হঠাৎ মৌরি দেখে রোশনী একটা পাখির পিছনে পিছনে ছুঁটছে।মৌরি চিৎকার করে বলে,রোশনী আস্তে,– আস্তে– সাবধানে পড়ে যাবে।
মোহিত মৌরির দিকে তাকিয়ে বলে তোমার মেয়ে খুব সুন্দর।একটা কথা বলবো তোমাকে।
মৌরি হেসে ফেলল।মা সব সময় বলতো তোর এই যখন তখন হেসে ফেলা অন্যকে রাগানোর জন্য।
—-আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি আর তুমি হাসছ?
কি করবো— তুমি কি বলবে আমি জানি।
—-তুমি জানো মানে?আমি তো কিছু বলিই নি এখনো।
—তুমি আমার সম্বন্ধে জানতে চাইছো তো?তো শোন–আমার নাম মৌরি মুন্সী।হাইট ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি,M.A.P.G.Diploma-Computer,বয়স ২৭ বছর দুই মাস সাতদিন।কোলকাতায় বাড়ি আর আমি রোশনীর মা।
জানো মোহিত,
লোক সবসময় আমার অতীতকে নিয়ে প্রশ্ন করে। আমি ছোট থেকেই বেশি কথা বলি আর খুব হাসিখুশি।বাড়িতে আমার মা,দাদা,বৌদি। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের মতো আমিও ঠিক আমার মতো পড়াশোনা শেষ করি।আর একটি ভালো চাকরিও পাই।মা,দাদা,বৌদিও ওদের কর্তব্য পালন করতে থাকে।আমার জন্য একটা ছেলে দেখে আর আমাদের আশীর্বাদ ও হয়ে যায়।সবকিছু ভালোই চলছিল,কিন্তু একদিন আমাদের সুখের সংসারে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।