হৈচৈ ছোটদের গল্পে মেরী খাতুন 

সংকল্প

 গরম ভাতে লঙ্কা ডলে নুন দিয়ে হুশ হুশ করে বড় বড় গ্রাস মুখে তুলছিল বছর পনেরো চম্পা। একটু দূরেই মাটিতে থেবড়ে বসে ওর মা ও ছোট ভাই রাজুও গরম ভাতে মন দিয়েছে। কতদিন পর ভাতের স্বাদ পেয়েছে ওরা। এখন কি আর অন্যদিকে মন দিতে আছে!ভাগ্যিস চম্পা টিউশন পড়াতে শুরু করেছিল। না হলে শাক গুগলি খেয়ে, লোকের বাড়িতে ফাই ফরমাশ খেটে কখনো আধপেটা, কখনও না খেয়েই দিন কাটত। খিদে যে বড় বালাই। খেতে বসলেই মন খারাপ করতো চম্পার। মনে মনে নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিত —- পড়াশোনা করে ডাক্তার হলে প্রতিদিন সে মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খাবে।

বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরতে দেখেছে বাবাকে। হারিয়েছে বসতভিটাটুকু। চম্পার বাবা গণেশ মন্ডলের ছোটখাট একটা চায়ের দোকান ছিল। তিনি নিজে বেশি দূর পড়তে না পারলেও চাইতেন সন্তানরা যেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। তাই চম্পাকে বোঝাতেন শিক্ষার মাধ্যমেই অভাবের অন্ধকার ঘুচে আলো আসে। যত কষ্টই হোক পড়াশোনা করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে জীবনে।

বাবার কথা মতো চম্পাও মন দিয়ে পড়তো। ক্লাসে বরাবরই প্রথম হতো। ক্লাস ফোরে চম্পা যখন বৃত্তি পেল, বাবার আনন্দ যেন আর ধরে না। কিন্তু এই সুখ কপালে সইলো না বেশিদিন। চম্পা যখন  অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী, তখন হঠাৎ একদিন ওর বাবা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, লিভার অকেজো হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই লিভার ট্রান্সফার করতে হবে। অনেক টাকার প্রয়োজন।

টাকার অভাবে ঠিকঠাক চিকিৎসাও হচ্ছিল না মানুষটার তার উপর  আবার এতো টাকা কীভাবে জোগাড় করবে?

চম্পার মা ঊষাদেবী তখন অনেকের দারস্থ হলেন,কিন্তু সে ভাবে সাড়া মেলেনি। স্বামীর চিকিৎসার জন্য বাধ্য হলেন ভিটেমাটি বিক্রি করতে। হাসপাতালে ভর্তি তো করা হলো চম্পার বাবাকে,কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চম্পার ফাইনাল পরীক্ষার আগেই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন আকাশে তারা হয়ে। সঙ্গে পুরো পরিবারের স্বপ্নেরেও যেন সমাধি হলো। বাবার জন্য শোক করার সময়টুকুও পেল না চম্পা। কয়েকদিন পরেই বসতে হলো পরীক্ষায়। পড়াশোনা করে বড় হতে হবে যে।

এদিকে বাবা নেই, বসতভিটাও নেই। থাকবে কোথায়?
শেষমেষ বাড়িটা যাঁদের কাছে বিক্রি করেছিল, তাঁদের বলেকয়ে কয়েক মাস ছিল সেখানে। কিন্তু খাবে কি?কোন উপার্জন নেই। ছোট্ট ভাই খিদেই ঝটপট করে যা চোখেদেখা যায়না। মা ঊষাদেবী এর বাড়ি ওর বাড়ি কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে একবেলার খাবার জোটে ওদের। এই পরিস্থিতিতে  চম্পা নবম শ্রেণী থেকেই শুরু করল টিউশন পড়ানো।মাসের শেষে যে টাকা পেত তা দিয়ে পরিবারের খরচ নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো। এই ভাবে বেশ চলছিল। শুরু হলো মাধ্যমিক পরীক্ষা। হঠাৎ একদিন পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে চম্পা দেখে,বইপত্র, বাসনপত্র থেকে শুরু করে সব উঠানে ছড়ানো-ছিটানো। ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে উঠানের এক কোণে বসে অঝোরে কাঁদছেন মা। পরদিন ছিল চম্পার পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা। চম্পার তো মাথায় হাত। কি করবে কিছু ভেবে না পেয়ে  কাঁদতে কাঁদতে বইপত্রগুলো গুছিয়ে মা’র কাছে এসে বলল,

——মা, আমি কালকের পরীক্ষার পড়া কীভাবে পড়বো? আমার যে মাধ্যমিক মা!

—–ঊষাদেবী মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, যার কেউ নেই তার ভগবান আছে মা! চিন্তা করিস না। আমাদের জন্য ফুটপাত আছে। চল। ওঠ জিনিস পত্র নিয়ে ফুটপাতে।

ঠিক সেই সময় ভগবানের দূত হিসাবে হাজির পাড়ার এক কাকিমা। বললেন,—

কি রে চম্পা তোদের এমন অবস্থা কেমন করে, কি হয়েছে, সব কথা শোনার পর চম্পার মাথায় হাত দিয়ে বললেন-“তোর যতদিন মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে আমার ঘরে থাকবি। তবে হ্যাঁ, আমারও একটি মাত্র কুঁড়ে ঘর তোর মা, ভাইয়ের জায়গা হবে নারে।”

ঊষাদেবী সবকথা শোনার পর বলল, না, না– আমরা থাকবো নি গো, তুমি চম্পাকে তোমার ঘরে ঠাঁই দেবে এটাই অনেক। আমি ছোটুকে নিয়ে চলে যাব ক্ষণ।

এরপর মালদার রেল লাইনের ধারে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঝুপরি বানিয়ে ওরা বাস করতে থাকে।

এদিকে পাড়ার কাকিমার বাড়িতে থেকেই বাকি পরীক্ষাগুলো দিতে থাকে চম্পা। পরীক্ষার পর চম্পাও মা -ভাইয়ের সাথে ঝুপরিতে চলে আসে। সব কিছুর দায়িত্ব তখন কিশোরী চম্পার কাঁধে। পড়াশোনার সাথে সাথে প্রতিদিন ১০ থেকে ১১ ঘন্টা করে টিউশনি করে, মাসে কেউ ৫০০ কেউ বা ৭০০ টাকা দ্যায়। মা ঊষাদেবী পরিচারিকার কাজ করতে চাইলে, চম্পা বলে, যত কষ্ট আমি করবো। তুমিও কাজে গেলে ভাইকে কে দেখবে? তার অদম্য জেদ আর পরিশ্রমে মাধ্যমিকে রাজ্যের মধ্যে পঞ্চম এবং উচ্চমাধ্যমিকে তৃতীয় স্থান জয় করে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে এই নক্ষত্র।

বাবা এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তখন থেকেই  চম্পার সংকল্প তাকে যে ভাবেই হোক চিকিৎসক হতেই হবে। রাতে বাবার পাশে বসে পড়ার  অভ্যাস ছিল চম্পার। তাই বাবার বাঁধানো ফটো ফ্রেমের পাশে যখনই পড়তে বসে, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। গাল বেয়ে যেন অদম্য জেদ ঝড়ে পড়ে।

চম্পা উচ্চমাধ্যমিকের পর ডাক্তারির পরীক্ষা(  Neet) দেয় কোন কোচিং ছাড়াই। পরিশ্রমের ফলও পায়। ২০২০-২১ সালে Need পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে নিয়ে কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয় চম্পা।

চিকিৎসক হয়ে সে গরিব মানুষের ফ্রিতে চিকিৎসা করবে। তার কথায় একেবারে কাছ থেকে দেখেছি চিকিৎসার অভাবে মানুষ কিভাবে মারা যায়।
এতদিন পরিবারের জন্য করেছি এবার চিকিৎসক হয়ে দেশের মানুষের জন্য কিছু করার সংকল্প নিলাম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *