গল্পে মনিদীপা দাশগুপ্ত

প্রাপ্তি

“মা বাবাকে বলে দাও , উনি যেন একটু সভ্য ভব্য হয়ে মাঠে যান , আমার কিন্তু একটা প্রেস্টিজ আছে”।
” চিন্তা করিস না তোর বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। ”
” না মা তুমি বুঝতে পারছো না , অনেক বড় বড় লোকজন আসছেন , স্বয়ং ক্রীড়ামন্ত্রী আসছেন আর জেলাশাসকও আসছেন , জানতো ওনারা দুজনে সেই ছোটবেলার বন্ধু ,একই স্কুলে পড়াশুনা করেছেন । এখানে আমার একটা সম্মানের বিষয় আছে । নেহাৎ বাপিদা বললেন তাই , না হলে ওনাকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতাম “?
মা ছেলের সব কথা অমিয় বাবু শুনতে পেলেন । শেষ কবে এইসব কথায় উনি কষ্ট পেয়েছিলেন তা ভুলে গেছেন । এইসব কথা আর তিনি গায়ে মাখেন না । সারা জীবন তার পরিবারের কাছে তিনি ব্রাত্য ছিলেন । এতটুকু সম্মান তিনি পরিবারের কারোর কাছে পাননি , ভালোবাসা সহানুভূতি তো অনেক দূরের কথা । কিন্তু তিনি তার কর্তব্য পালন করে গেছেন । তবে তিনি তার কর্মস্থলের চারপাশের লোকেদের কাছে প্রচুর সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছেন । তার জন্যই হয়তো নিজের পরিবারের তার প্রতি উদাসিনতা বা অসম্মান উপেক্ষা করতে পেরেছেন ।
————————————–
ছোট বেলা থেকে অমিয়র অংকে ভীষন ভয় ছিল , তার জন্য তার বাবার কাছে তিনি কম বকা খাননি । বাবা তারিণী বাবু চাইতেন তার বাকি দুই ছেলের মতন অমিয়ও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক , তাই প্রতিনিয়ত দুই দাদার সাথে তার তুলনা শুরু হয় । প্রথমে দাদাদের সাথে তুলনা চলত তারপর তার উপর চাপ আসতে শুরু হয় , যেন দাদাদের মতন অংকে বেশি নম্বর পেতে হবে , তার ফলে ওর ভয় বেড়ে গেল । নিজেকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখত । সবার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজের এক আলাদা জগৎ তৈরী করে । নিজে দাদাদের থেকে অনেক ছোট বা হীন হয়ে আছে তা মনে করতে লাগলো । তার ফলে দাদাদের থেকে তার দূরত্ব বেড়ে গেল। একটা সময় আসলো অমিয় নিজেকে সকলের থেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো ।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর অমিয় যখন বাংলায় অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হল তখন তার বাবা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল । বাড়িতে একমাত্র তার মা ছিলেন যিনি স্বাভাবিক ভাবে তার সাথে কথা বলতেন । বাকিরা ওর ডাক্তার বড়দা আর ইঞ্জিনিয়ার ছোড়দা অবজ্ঞার সুরে কথা বলত ।
মাস্টার্স পাশ করার পর অমিয় একটি সরকারি স্কুলে চাকরি পেল । তার একবছরের মধ্যে তার মা মারা গেল । দুই দাদা সম্পত্তি ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে গেল । বৃদ্ধ বাবার দায়িত্ব নিলেন অমিয় । তারিণীবাবু শেষ জীবনে এসে বুঝতে পারলেন তার ছোট ছেলে ওনার ইচ্ছা মতন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত না হলেও মানুষ হয়েছে ।
তারিণী বাবুই সম্বন্ধ করে ওনার বন্ধুর মেয়ে সুচিত্রার বিয়ে দেন ।
বিয়ের পরেও অমিয়র জীবনটা একই রকম রয়ে গেল । সুচিত্রা তার দুই জায়ের সৌভাগ্য আর তার নিজের দুর্ভাগ্যের খোটা দিনরাত শুনিয়ে যেত । প্রতিপদে দুই ভাসুরের প্রচুর অর্থ আর প্রতিপত্তি নিয়ে খোঁটা শুনিয়ে যেত । এখানেও অমিয় তার স্ত্রীর থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে শুরু করল । বিয়ের দুই বছর পর তারিণী বাবু মারা যান । ততদিনে ছেলে অরিত্রর জন্ম হয় ।
তারিণী বাবু মারা যাওয়ার পর সুচিত্রার অশান্তি বাড়তে থাকে । এই সময় অমিয়র প্রমোশন হয় । তবে তাকে সুন্দরবনের একটি গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে যেতে হবে । অমিয় যেন তাই চাইছিলেন , তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচলেন।
পাঁচপোতা গ্রামের মাসুষেরা খুব সহজ সরল ছিল কিন্তু তাদের জীবনযাপন খুবই কঠিন ছিল । ঝড় আর বন্যার সাথে সাথে দারিদ্রও তাদের সঙ্গী ছিল ।
গ্রামের মানুষরা তাদের সরলতা সাথে ভালো মনের অমিয়কে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নেয় , যে ভালোবাসা আর সন্মান অমিয় তার পরিবার থেকে পাননি তা এই গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে পেল এমনকি তার বেশিই পেলেন । তাই অমিয়ও নিজেকে উজার করে তাদের পাশে থেকেছেন । পড়ানো ছাড়াও সবসময় সুখ দুঃখে তাদের পাশে থাকতেন । প্রথম প্রথম প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যেতেন কিন্তু তখনও সুচিত্রার অভিযোগের পাহাড় শুনতে হত । এমনকি অরিত্রও এড়িয়ে চলত। প্রয়জন ছাড়া কথা বলত না । সে যত বড় হতে লাগল তার কথার মধ্যে বাবার প্রতি যে অসম্মান আছে তা বোঝা যেত । তাই অমিয় বাড়ি আসা কমিয়ে দিলেন , তিনি মাসে একবার বাড়ি যেতেন । তিনি বুঝতে পারতেন প্রতি মাসের মাইনের টাকা ছাড়া বাড়ির সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই । তাই তিনি তার ছাত্রদের মধ্যে নিজেকে উজাড় করে দিতেন ।
রিটিয়ার্ডের পর যখন তিনি বাড়ি ফিরলেন তখন
স্ত্রী ও ছেলের থেকে তার দূরত্ব বেড়ে গেছে ।
অরিত্র বেশি দূর পড়াশোনা করেনি । ছোটবেলা থেকেই সে যে তার জ্যাঠাদের মত বিত্তশালী হতে চাইত । মাধ্যমিক পাশের পর সে প্রথমে জমির দালালি করত তারপর এখন প্রমোটারি করে , তাদের ছোট একতলা বাড়ির জায়গায় অট্টালিকা , গাড়ি সব সে করেছে । তাছাড়া সে পাড়ার ক্লাবের সভাপতি । পাড়ায় খুব প্রতিপত্তি । সে তার বাবাকে মানুষ বলে মনে করে না ।
অমিয়ও তার ছেলের সাথে কথা বলতেন না । মনে মনে খুব আহত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সামান্য পড়াশোনা করে এত অল্প বয়সে এত পয়সা করতে অরিত্র সহজ সরল পথ অবলম্বন করেনি । তিনি এত ছেলেদের শিক্ষার আলো দেখিয়েছে , সমাজে স্বচ্ছ ভাবে চলতে শিখিয়েছেন সেখানে তার ঘরেই অন্ধকার ।
–————————————-
প্রায় একমাস ধরে যাদব নগরের কলেজের মাঠে ফুটবল প্রতিযোগিতা বা টুর্নামেন্ট হচ্ছে । প্রতি বছর এই টুর্নামেন্ট হয় , তবে এই বছর প্রথম টুর্নামেন্টটি জেলাস্তরে হচ্ছে । সেই উত্তরের আলিপুরদুয়ার থেকে দক্ষিণের সুন্দরবন থেকে প্রতিযোগী দল এসেছে । একমাস ধরে সেই খেলা চলেছে । আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে বিজয়ী দলকে ও আরও বিভিন্ন স্তরে পুরস্কার বিতরণ করা হবে । তাই সকাল থেকে আয়োজন শুরু হয়েছে । অরিত্র ক্লাবের সভাপতি হওয়ার জন্য তার ব্যস্ততা বেশি ।
মা ও ছেলের কথপোকথন আর শুনলেন না অমিয়বাবু , বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঠের কাছে চলে এলেন । রিটিয়ার্ডের পর তো তিনি প্রায় গৃহবন্দী, ছেলে এবং সুচিত্রার ইচ্ছা মতন তাকে চলতে হয় । তার এই মাঠের কাছে আসলে মন ভালো হয়ে যায় , ছোট বড় সকলের হৈ চৈ আর চিৎকারে তিনি যেন মুক্ত বাতাস খুঁজে পান ।
মাঠের সামনের দিকে বিশাল এক স্টেজ তৈরী হয়েছে , তাতে নানা ফুল দিয়ে সাজান , স্টেজের ডান দিকে একটা কার্পেট পাতা সিঁড়ি তাতে লোকজন যাওয়া আসা করবে আর বাদিকে একটা বড় টেবিলে অনেক ছোট বড় ট্রফি সাজান আছে , স্টেজের মাঝখানে দুটি বড় সিংহাসন আছে তাতে দুই প্রধান অতিথিদের বসান হবে । সিংহাসনের দুই পাশে অনেক গুলি চেয়ার পাতা আছে তাতে এলাকার গন্যমান্য লোকেরা বসেছেন । তাদের মধ্যে অমিয়বাবু তার দুই দাদাকে দেখতে পেলেন । স্টেজের সামনে নিচের দিকে দুই ভাগে চেয়ার পাতা আছে একদিকে সব খেলোয়াড়রা বসেছে অন্যদিকে সাধারণ মানুষদের জন্য । মাঠে ঢোকার মুখে একটা জায়গায় পতাকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা আছে । মাইকে দেশাত্মবোধক গান হচ্ছে। অমিয়বাবু মাঠের বাইরে রেলিংয়ের সামনে দাঁড়ালেন এখান থেকে মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছে । আস্তে আস্তে লোকজন আসছে , অরিত্র ব্যস্ত হয়ে মাঠে ঢুকল , সে বাবাকে যেন দেখতে পেল না । একটু পরে একটি ছেলে অমিয়বাবুর কাছে এসে বলল, ” আপনাকে বাপিদা ডাকছেন , আপনি ভেতরে আসুন ” । বাপি দাস এলাকার কাউন্সিলর , ঘর আর পাড়ার লোকেদের অবহেলার মাঝে এই একটা মানুষ তাকে খুব শ্রদ্ধা করে । ছেলেটির পিছন পিছন অমিয়বাবু মাঠে ঢুকলেন । বাপি এগিয়ে এসে ওনাকে একদম সামনের একটি চেয়ারে বসালেন । চারিদিকে ব্যস্ততার ছাপ । একটু পরে মাঠে ঢোকার রাস্তার সামনে হৈ চৈ শোনা গেল , মাইকে প্রধান অথিতিদের আসার কথা ঘোষণা করা হল । একটু পরে দুই প্রধান অতিথি ক্রীড়ামন্ত্রী সৌমেন হালদার ও জেলাশাসক মইনুল ইসলাম মঞ্চে প্রবেশ করলেন । মাইকে তখন ঘোষণা হচ্ছে দুই সহপাঠী একজন মন্ত্রী ও আরেকজন জেলাশাসক । দুই প্রধান অথিতিদের বরণ করে মালা ও উত্তরীয় পরান হল । মঞ্চে দাঁড়ান গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সকলে একে একে তাদের সাথে আলাপ করলেন । এরপর প্রধান অতিথিদের কিছু বলার অনুরোধ করা হলে মইনুল ইসলাম মাইকের সামনে এগিয়ে এলেন । বলার জন্য সামনে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে সামনে বসে থাকা অমিয়বাবুকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলেন , ” আরে স্যার না ? আপনি এখানে ? সমু দেখ আমাদের হেডস্যার ” । এই বলে প্রায় একলাফে অমিয়বাবুর সামনে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন । সাথে সাথে সৌমেন হালদার প্রায় দৌড়ে এসে প্রণাম করলেন । অমিয়বাবু তখন থর থর করে কাঁপছেন । ওনারা দুইজনে দুই হাত ধরে অমিয়কে স্টেজে নিয়ে আসলেন । দুজনেই নিজেদের উত্তরীয় অমিয়বাবুর গলায় পরিয়ে দিয়ে আবার প্রণাম করলেন আর সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। সৌমেন মাইকের সামনে এগিয়ে গেলো ।
“আপনাদের আজকের অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কিছু বলার আগে আমাদের স্যারের ব্যাপারে না বললে অপরাধ হবে , আমাদের পাঁচপোতা গ্রামের ঈশ্বর বা আল্লা ছিলেন আমাদের হেডস্যার এক কথায় সারা গ্রামের ভগবান ছিলেন , অভিভাবক ছিলেন । আজ উনি না থাকলে আমি মন্ত্রী বা মইনুল জেলাশাসক হতে পারত না , আমাদের গ্রামে আজ কৃতি ছাত্রের অভাব নেই শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে হেডস্যারের জন্য । আমরা ছিলাম স্কুলছুট ছাত্র । আমাদের ধরে এনে স্যার পড়িয়েছেন , নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন –“। আরও কিছু বলে যাচ্ছিল সৌমেন , অমিয়বাবু কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছিলেন না ওনার চোখের কোনটা জ্বালা করতে শুরু করেছে । সকলের সামনে ওনাকে ভগবান বলছে , এইখানে উনি জন্মেছেন , বড় হয়েছেন কিন্তু সারাজীবন অবহেলা আর অপমান ছাড়া কিছু পাননি । আজ এই জায়গায় তাকে এত সন্মান জানাচ্ছে । আজ যাদের জন্য এত আয়োজন তারা হল তার ছাত্র , আজ যে তারাই তার সব অপমানের জবাব দিয়ে দিল । হঠাৎ হাততালির আওয়াজে উনি সম্বিৎ ফিরে পেলেন । সৌমেন আর মইনুলের ইচ্ছা যে আজ তাদের ভগবান হেডস্যার যেন পতাকা উত্তোলন করেন । অমিয় বাবু কেঁদে ফেললেন , হ্যা উনি কাঁদছেন এতদিনের এতলোকের অপমান তার চোখে জল আনতে পারেনি কিন্তু আজ এই সম্মানে উনি কাঁদছেন ।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।