সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৭
by
·
Published
· Updated
মর্তকায়ার অন্তরালে
|| সাত ||
স্বাভিমান বোধের এই ধারা বিদ্যাসাগর চিরদিন মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করে গেছেন | নিচের ঘটনাটি এরই সাক্ষ্য বহন করে |
ইংরাজ প্রশাসন নিজেদের আভিজাত্যের কথা স্মরণ করে কতকগুলি নিয়মের প্রবর্তন করেছিলেন | তারই অন্যতম ছিল গর্ভনরের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রার্থীকে অবশ্যই চোগাচাপকান পরে আসতে হবে | বিদ্যাসাগর কিন্তু তার সেই দেশীয় পরিচ্ছদ ধুতি চাদর পরেই আসতেন | সভাপতি হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরকে এক প্রস্থ পোশাক কিনে দিয়ে ঐগুলি পরে আসতে অনুরোধ করেন | বিদ্যাসাগর তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন না | পরদিন ঐ পোশাক পরেই লাট সাহেবের কাছে গেলেন | সেদিন সভা শেষ হলে বিদায় গ্রহণকালে বিদ্যাসাগর লাট সাহেবকে বললেন , ” আজ আপনার কথা রেখেছি | কিন্তু এরপর আর আমার এখানে আসা হবে না | ” ৭ হ্যালিডে সাহেব বিস্মিত হয়ে এর কারণ জানতে চেয়েছিলেন | বিদ্যাসাগর উত্তরে জানালেন – তিনি তাঁর জাতীয় পরিচ্ছদ ত্যাগ করতে পারবেন না এবং আরো জানালেন দরকার পড়লে তিনি চাকরি ছাড়তেও রাজী | সাহেব বিদ্যাসাগরের চরিত্রের সঙ্গে ভালোমতন পরিচিত ছিলেন | তাই হ্যালিডে সাহেব বললেন , ” বেশ আপনার পরিচ্ছদ আপনাকে ছাড়তে হবে না | আপনি যেভাবে চান , সেইভাবেই আমার কাছে আসুন | ” ৮
এখানে প্রধান লক্ষণীয় বিষয় এই যে , তিনি নিজের রুটি-রোজগারের প্রধান অবলম্বন ছাড়তে রাজী কিন্তু জাতীয় পরিচ্ছদ বর্জনের কথা ভাবতে পারেন না |
অনুরূপ আর একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি | উত্তর প্রদেশের হিন্দি সাহিত্যিক হরিশচন্দ্রের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সখ্যতা ছিল | তিনি কলকাতায় এলে বিদ্যাসাগর বন্ধু ও বন্ধুপুত্র সুরেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটি ও ভারতীয় জাদুঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন | হরিশচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথের পরনে কেতাদুরস্ত পোশাকই ছিল , কিন্তু বিদ্যাসাগরের পরনে সেই ধুতি-চাদর ও পায়ে তালতলার সেই পরিচিত চটি | হরিশচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথ অনায়াসেই প্রবেশাধিকার পেলেন | কিন্তু দারোয়ান বিদ্যাসাগরের পথ আটকে দিলেন | দারোয়ান জানায় , ভেতরে যেতে হলে চটি খুলে রাখতে হবে , নইলে হাতে তুলে নিতে হবে | বিদ্যাসাগর সোসাইটির নিয়ম মানতে রাজী হলেন না | ভিতরে ঢোকার আশা ত্যাগ করে পথে অপেক্ষারত গাড়িতে এসে বসলেন |
সুরেন্দ্রনাথের কাছে খবর পেয়ে সোসাইটির সহকারী সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র ঘোষ ক্ষমা প্রার্থনা করে বিদ্যাসাগরকে ভেতরে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন | বিদ্যাসাগর সেই অনুরোধ স্বীকার করলেন না | কারণ তাঁর কাছে ব্যক্তিগত মান-সম্মানের চেয়ে বড়ো করে দেখা দিয়েছিল স্বজাতীর প্রতি বিট্রিশ জাতীর অবমাননা ও অমর্যাদা | বিদ্যাসাগর উত্তরে জানিয়েছিলেন , ” ইংরাজি জুতো ও ভারতীয় চটির মধ্যেকার এই ভেদনীতি দূর না হ’লে তিনি ভেতরে যাবেন না | ” ৯
শুধু তাই নয় যাদুঘরের অছি পরিষদের সম্পাদক ব্লানফোর্ডের কাছে একটি প্রতিবাদ পত্র পাঠিয়েছিলেন | প্রতিবাদে তিনি জানিয়েছিলেন : ” এ তো শুধু কোন ব্যক্তি সম্পর্কিত ব্যাপার নয় , এ হল ভারতীয় সমাজের প্রতি ভেদমূলক ব্যবহার | ” ১০
বিদ্যাসাগরের প্রতিবাদ এশিয়াটিক সোসাইটি মানেনি | না মানার কারণ সোসাইটির কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা প্রায় সকলেই ইংরাজ | বিদ্যাসাগরও প্রতিবাদের অন্য পথ ধরলেন | ঘটনাটি নিয়ে পত্রিকায় আলোচনা করলেন | হিন্দু পেট্রিয়ট ও ইংলিশম্যান পত্রিকা বিদ্যাসাগরের পক্ষ নিয়ে কলম ধরলেন | ১৮৭৪এর ২জুলাই ইংলিশম্যান লিখল : ” আমরা জানতে পারলাম যে , বিতর্কিত জুতো প্রসঙ্গ আবার সামনে এসে পড়েছে আর এই বিতর্কের কেন্দ্র হ’ল একটি বিশিষ্ট সংগঠক যার নাম এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ বেঙ্গল | পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁর বিদ্যাবত্তা , ভদ্রতাবোধ এবং গুণাবলীর পরিচয় দেশের মধ্যেই শুধু নয় , দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে | দেশীয় জুতো পরে থাকার জন্য তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি | জোন্ স্ ও কোলব্রুকের উত্তরাধিকার যাঁরা পেয়েছেন , তাঁদের পক্ষে মর্য্যাদাসূচক ব্যবহার হ’ত এই ধরণের সংকীর্ণ রীতিকে পরিত্যাগ করা ; যে রীতি সোসাইটির মূল্যকে কমিয়ে দেবে এবং বিদ্যাসাগরের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও সোসাইটি ভবনে স্থান দিতে কুণ্ঠিত হবে , সে রীতিগুলি সোসাইটির কর্তৃপক্ষকে উপহাসের পাত্র করে তুলবে | ” ১১ এইভাবে বিদ্যাসাগর বিট্রিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে বার বার রুখে দাঁড়িয়েছেন |
একবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি মর্ভাণ্ট ওরেন্স সাহেব কোনো একটি জালিয়াতী মামলার রায় প্রদান কালে বলেছিলেন , ” বাঙালী মাত্র বিদ্যাবাদী | ” কথাটি শোনা মাত্রই বিদ্যাসাগর তীব্র প্রতিবাদ জানাবেন মনস্থির করলেন | সেই মর্মে রাজা রাধাকৃষ্ণদেবের গৃহে একটি সভা আহ্বান করেন | সভায় মর্ভাণ্ট সাহেবের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করে একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবের একখানা অনুলিপি পাঠান ভাইসরয়ের হাতে , লণ্ডনে ‘ সেক্রেটারী অব ষ্টেট্ ফর ইণ্ডিয়া’র নামে | বড়লাট ঘটনা অবগত হয়ে সুপ্রিম কের্টের সেই বিচারপতিকে সর্তক করে দেন |
তিনি যে মেট্রোপলিটান ইনস্টিউসন ও কলেজ গড়ে তুলে ছিলেন তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে ইংরেজ শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া , সরকারী অর্থ সাহায্য না নিয়ে একক প্রয়াসে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন | এম.এ ক্লাস পর্যন্ত এখানে পড়ানো হতো | মেট্রোপলিটনের অধ্যক্ষ ও অপর সকল অধ্যাপকগণ ছিলেন সম্পূর্ণ ভারতীয় | জাতীয় মর্যাদাকে তিনি এভাবেই মান্যতা দিতেন |
তাঁর স্বাজাত্যবোধ যে কত প্রবল ছিল নিচের ঘটনাগুলিতে তার কিছু প্রমাণ রাখব | কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কবিতায় লিখেছেন : ” ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে , / বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে |” বড়ো সত্যি কথা | বিদ্যাসাগর সেই মিথ্যে ইতিহাস , বিকৃত ইতিহাস নতুন করে লেখার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন | কিন্তু সে ইচ্ছা সম্পূর্ণ পূর্ণ করার সময় তিনি পাননি | তবু যেটুকু সময় ও সুযোগ তিনি পেয়েছেন তার কিঞ্চিত নমুনা আমরা দেখব |
‘History of Bengal ‘ বইটি মার্সম্যানের লেখা | কিন্তু সে ইতিহাস ছিল বিজিত জাতীর অহঙ্কার ও প্রভুত্ববোধের | ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের জি.টি মার্শাল বিদ্যাসাগরকে বইটি বাংলায় অনুবাদের ভার দেন | কিন্তু বিদ্যাসাগর বইটি সরাসরি অনুবাদ না ক’রে পরিবর্তন ও পরিবর্জনের মাধ্যামে বইটি নতুন করে লিখলেন | এর জন্য প্রয়োজন ছিল যথেষ্ট বুকের পাটার | তা বিদ্যাসাগরের ছিল |
সিরাজদৌল্লার নামে ‘ অন্ধকূপ হত্যা ‘ নামে মিথ্যা কাহিনী রটনা তাকে কলুষিত করার যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল বিদ্যাসাগর তার বিরুদ্ধে লিখলেন : ” অন্ধকূপ হত্যা নামে যে অতি ভয়ঙ্কর ব্যাপার প্রসিদ্ধ আছে ….এই হত্যার নিমিত্তেই সিরাজদ্দৌল্লার কলিকাতা আক্রমণ শুনিতে এত ভয়ানক হইয়া রহিয়াছে | ….এবং সিরাজদ্দৌল্লাও নৃশংস রাক্ষস বলিয়া প্রসিদ্ধ হইয়াছেন | কিন্তু তিনি ঘটনার পরদিন প্রাতঃকাল পর্যন্ত এই ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গ জানিতেন না | ” ১২
তরবারির জোরে নবারের সৈন্যদের হারিয়ে যুদ্ধ জয় করেছে এ অহঙ্কার ইংরেজদের ছিল | প্রতিবাদে বিদ্যাসাগর লিখলেন : ” যদি মীরজাফর বিশ্বাসঘাতক না হইতেন , এবং ঈদৃশ সময়ে প্রতারণা না করিতেন তাহা হইলে ক্লাইভের কোনক্রমেই জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল না | ” ১৩
নন্দকুমারের ফাঁসি সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের বলিষ্ঠ মন্তব্য : ” নন্দকুমার দুরাচার ছিলেন যথার্থ বটে , কিন্তু ইম্পি ও হেষ্টিংস তাহা অপেক্ষা অধিক দুরাচার তাহাতে সন্দেহ নাই | ” ১৪ সন্তোষ কুমার অধিকারী এই প্রসঙ্গে বলেছেন : ” ইম্পি অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পে সম্পর্কে এই উক্তি Libellous বলে তাঁকে উত্যক্ত করতে পারতো গভর্ণমেণ্ট ¦ ” খুব সত্য কথা | পরের পংক্তিতেই বিদ্যাসাগর আরো দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন | ” ধর্মাসনারূঢ় ইম্পি ….হেষ্টিংসের পরিতোষার্ধে একেবারেই ধর্মাধর্মজ্ঞান ও ন্যায় অন্যায় বিবেচনায় শূন্য হইয়া নন্দকুমারের প্রাণবধ করিলেন | ” ১৫
এ ধরণের মন্তব্য চূড়ান্ত সাহসিকতার নিদর্শন | বিদ্যাসাগর রাজরোষে পড়তে পারতেন | কিন্তু রাজরোষের ভয়ে বিদ্যাসাগর সত্য প্রকাশে পিছপা হবে এমন মানুষ বিদ্যাসাগর ছিলেন না | বিদ্যাসাগরের এই প্রতিবাদী চরিত্রের মূলে আছে তাঁর প্রচণ্ড স্বাভিমান বোধ |
————————————————————-
তথ্য প্রাপ্তি :
১| করুণাসাগর বিদ্যাসাগর , ইন্দমিত্র , আনন্দ পাবলিশার্স , সেপ্টেম্বর ২০১৪ , পৃঃ ৩০-৩১ | ২| ঐ, পৃঃ ৩১ ৩| ঐ , পৃঃ ১৩১ ৪| ঐ , পৃঃ ১৩১-১৩২ ৫| ঐ , পৃঃ ১৩২ ৬| প্রসঙ্গ : বিদ্যাসাগর , সম্পাদনা : বিমান বসু , ন্যাশনাল বুক এজেন্সী , ২৫মে ২০০৮ | পৃঃ ১৯৮ ৭| ঐ , পৃঃ ১৯৭ ৮| ঐ , পৃঃ ১৯৭ ৯| ঐ , পৃঃ ১৯৯ ১০| ঐ , পৃঃ ১৯৯ ১১| ঐ , পৃঃ ১৯৯-২০০ ১২| ঐ , পৃঃ ২০১ ১৩| ঐ , পৃঃ ২০১ ১৪| ঐ , পৃঃ ২০১ ১৫| ঐ , পৃঃ ২০১ |