গল্পেরা জোনাকি তে মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
উদয়ের পথে
স্কুল থেকে ফিরে ঘরের টুকিটাকি কাজ করতে করতে গুনগুন করা অভ্যাস দেবস্মিতার। আজ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে কাজ করতে দেখে তীর্থ বলে, “কি হলো আজ গলায় গান নেই যে?”
উত্তরে “কেন আমি কি সবসময় গান গাই?” বলে কপট রাগ দেখায় দেবস্মিতা।
কর্পোরেট অফিসে দেবস্মিতার কাজের চাপ খুব আর তীর্থ ব্যাঙ্কে কর্মরত। দুজনকেই খুব সকাল সকাল বেরোতে হয়, সকালে কথা বলার সময় পায়না। সারা দিনের কাজের শেষে বাড়ি ফিরে কাজকর্মের সঙ্গে যেটুকু বাক্যালাপ।
তীর্থ বলে…না তা নয়, তবে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তোমার কাজ করার সঙ্গে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তো, তাই জিজ্ঞেস করছি?
কিছু হয়েছ? চিন্তিত দেখাচ্ছে…”
এবার আর গোপন করতে পারে না দেবস্মিতা, বলে, “টুবলুকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি “
” কেন, কী হল আবার?”
” দেখেছ কেমন সারাদিন মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে বসে থাকে? আর কয়েকমাস পরেই যে ওর বোর্ড এক্সাম ওকে দেখলে তা বোঝা যায়? একটুও পড়াশোনা করে না। কিছু বললেই রাগারাগি চিৎকার চেঁচামেচি করে।” “বিষয়টা সত্যিই খুব সমস্যার তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু ওর বয়েসটা ভেবে তুমি রাগারাগি করবে। হিট অফ দ্যা মোমেন্টে কিছু একটা করে…” আর বলতে দেয় না , তীর্থর মুখে হাত চাপা দেয় দেবস্মিতা। তীর্থ হাতটা নামিয়ে ধরে বলে, ” সেই কারণেই তো বলছি, যা হবার হবে এই বিষয়ে বেশি কিছু বলার দরকার নেই। আর তাছাড়া এতটা আপসেট হলে তুমিই তো প্রেসার বাড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
তীর্থ আর দেবস্মিতা দুজনেই ভালো চাকরি করে তাদের একমাত্র ছেলে টুবলু তাই ছোটবেলা থেকেই কোন অভাব রাখেনি তারা। নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানো, ভালো ভালো ব্র্যান্ডেড জামাকাপড়, বছরে দু-একবার বেড়াতে যাওয়া আর অনেক বন্ধুবান্ধব আত্মীয় নিমন্ত্রণ করে জাঁকজমাকে ছেলের জন্মদিন পালন সব মিলিয়ে ছেলেকে জীবনের সমস্ত রকম আনন্দ দিয়ে বড় করছে তারা। হয়তো এই অতিরিক্ত প্রাপ্তি টুবলুকে একটু জেদি, একরোখা আর স্বেচ্ছাচারী করে তুলেছে। নামী স্কুলে পড়ার দৌলতে অনেক নামীদামী ব্যক্তি অর্থাৎ বিভিন্ন রাজনীতিবিদ সিনেমা বা সিরিয়ালের অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। তাদের মতো জীবন যাপন, ঘন ঘন পার্টি অ্যাটেন্ড করা কোনোকিছুতেই বাধা দেয়নি তারা। এতে তারাও বোধহয় এক রকম তৃপ্তিবোধ করেছে। সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে দুজনের উপার্জনের টাকায় শহরে বড় ফ্ল্যাট, গাড়ি এককথায় উন্নত ধরনের জীবন যাপন আর ছেলের স্কুলের বন্ধুদের দৌলাতে অনেক বড় বড় মানুষের সাথে আলাপ পরিচয় এতে তারাও বোধ হয় মনে মনে একটু গর্ববোধ করত। কিন্তু ক্রমশ পরিস্থিতিটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে টুবলু যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে, উদ্ধত রাগী হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন আর তাই নিয়ে এখন সর্বদা চিন্তিত থাকে দেবস্মিতা।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর টুবলু বাড়ি এসে জানায় যে তারা বন্ধুরা মিলে দুদিনের জন্য আউটিং এ যাবে। বড় হয়েছে, কিছু বলার নেই তবু একটু আপত্তি করেছিল, ধোপে টেকেনি। একদিন ভোর বেলা দুই বন্ধুর গাড়িতে করে ওরা নজন ছেলে মেয়ে বেরিয়ে গেল। রাত সাড়ে এগারোটায় টায় হঠাৎ ফোন এলো ওরা অ্যারেস্টেড হয়েছে, কাল সকালেই যেন তীর্থরা থানায় চলে আসে। কী কারণে জিজ্ঞাসা করায় খেঁকিয়ে উঠলেন অফিসার, এই বয়সের ছেলে সব, তাদের মস্তি করতে ছেড়ে দিয়েছেন আবার জিজ্ঞেস করছেন কি কারণে , মস্তি করা একটু বেশি হয়ে গেছে। কালকে থানায় আসুন সব কথা হবে।” যে বন্ধুরা গিয়েছিল তাদের বাড়িতে ফোন করে। ওদের মধ্যে দুজন ফিল্মস্টার ও দুজন রাজনীতিবিদের ছেলেরাও ছিল। ওরা সকলকে ফোন করে কিন্তু তারা কেউ ফোন রিসিভ করেন না। শুধুমাত্র কথা হয় রাহুল আর রোহনের অভিভাবকের সঙ্গে তারাও এদের মতই হতভম্ব। ভোর হওয়ার আগেই একটা গাড়ি নিয়ে ওরা রওয়ানা হয়।
পৌঁছে লকআপ নিজেদের ছেলেদের দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে মায়েরা। ওদের তিনজনকে লকআপে দেখে বাকিদের কথা জিজ্ঞেস করলে জানতে পারে, যে চারটি ছেলে প্রভাবশালী ঘরের তাদের বেল হয়ে গেছে। এদের কোর্টে চালান করা হবে, সেখান থেকে জামিন করাতে হবে। এদের বিরুদ্ধে চার্জ কী তা জিজ্ঞেস করলে অফিসার বললেন, “এদের সঙ্গে যে দুটি মেয়ে ছিল তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে এদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল রাতে হোটেলের ঘরে সব নেশা করে ওদের সাথে কিছু অশালীন আচরণ করেছে। এরকম ক্ষেত্রে বেল সাধারণত হয় না, তবু চেষ্টা করুন।” সঙ্গে সঙ্গে তীর্থ প্রশ্ন করে, “তাহলে ওই চারজনের হল কীভাবে?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকে দেখে নিয়ে অফিসার জবাব দেন, “সে কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দেব? পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলেন, “আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আমাদের অনেক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই কে জামিন পাবে আর পাবে না সবটা আমাদের উপর নির্ভর করে না। আর তাছাড়া ওদের কোন রেকর্ড থাকবে কি না ওদেরকে কোর্টে যেতে হবে কি না, এসব বিষয় আপনাকে আমরা বলতে বাধ্য নই।” অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকে তীর্থ, একটু যেন মায়া হয় অফিসারের, বলেন “এটুকু বলতে পারি মেয়েগুলি ওদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ তুলে নিয়েছে। আপনারা যদি পারেন বুঝিয়ে সুুঝিয়ে সেই চেষ্টা করুন তাহলেই কিছু হওয়া সম্ভব, না হলে এদের জামিন হওয়া কিন্তু মুশকিল।”
কোর্টে অনেক অনুরোধ উপরোধ আর মায়েদের কান্নাকাটিতে বাধ্য হয়ে ওদের সাথে দেখা করে ঐন্দ্রী আর পামেলা। ওদের রাজি করানো যায় অভিযোগ তুলে নিতে। ওদের মা-বাবারাও দেখেন শুধু শুধু দিনের পর দিন কোর্টে কেশ চলা মানে অহেতুক কাদা ছোড়াছুড়ি, সেগুলো তাদের মেয়েদের ভবিষ্যতের পক্ষেও ঠিক হবে না তাই কিছুটা নিজেদের স্বার্থেই অভিযোগ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ঐন্দ্রীর দাদু সূর্যকান্ত মজুমদার দায়িত্ব নিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে সমস্যার এই একরকম সমাধান করেন।
কোর্ট থেকে বেরোবার সময় এগিয়ে এলেন সূর্যকান্ত বাবু। বাবা মায়েদের উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় উনি বলেন, “তোমাদের সকলকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের একটি বিখ্যাত লাইন আছে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” পৃথিবীর সব বাবা মায়ের চিরন্তন প্রার্থনা এটা। এই চাওয়ার মধ্যে কোন অপরাধ নেই কিন্তু সন্তানকে সব রকমের সুখ আর আনন্দ দিতে গিয়ে তোমরা ভুলে যাও এর পাশাপাশি তার নৈতিক শিক্ষাও সমানভাবে দরকার।” তীর্থ বলে, “কিন্তু মেসোমশাই ,আমরা কি আমাদের সন্তানদের এই ধরনের কাজ করতে শিখিয়েছি?” ” না আমি তা বলছি না কিন্তু তোমরা নিজেদের জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে ছোটবেলা থেকে ওদের সময় কম দাও ওরা টিভি মোবাইল ফোন আর বিভিন্ন কমোডিটিকে আঁকড়ে ধরেই বড় হয়। ছোটবেলায় খেলাধুলো করতে সময় পায়না। আচ্ছা, তোমরা ভেবে বলতো কটা গল্প শুনিয়ে ওদের রাতে ঘুম পাড়িয়েছো। ওদের খাওয়ানোর সময় কটা রূপকথার গল্প বলেছ? কার্টুন চ্যানেল মোবাইল ফোনের সাহায্য কি নাওনি তোমরা? এটা সবটাই যে তোমাদের দোষ এমনটা নয়। আর্থসামাজিক পরিবেশটাই আমাদের বদলে গেছে। তবুও শুধুমাত্র ফিউচার, কেরিয়ার টাকা এসবের কথা না ভেবে সন্তানদের উপযুক্ত সময় দেওয়া উচিত ছিল তোমাদের। তা করতে পারনি তাই কমপেনসেট করেছ দামী দামী জিনিসপত্র কিনে দিয়ে।” মাথা নিচু করে থাকে ওরা।
বেরিয়ে এসে ছেলেদের গাড়িতেই উঠে বসেন উনি। বলেন তোমাদের এবার একটা কথা বলি, প্রভাবশালী ব্যক্তি সে যে পেশারই হোক না কেন তাদের ছেলেমেয়েরা নির্ভয়ে থাকে, তারা জানে সমস্যা হলে তারা সেই জাল কেটে বেরিয়ে যেতে পারবে ক্ষমতা বা টাকার জোরে কিন্তু স্কেপ গোট হয়ে যাও তোমরা , সাধারণ ঘরের ছেলেরা। প্রকৃতপক্ষে ওদের আর তোমাদের মধ্যে কি কোন তফাৎ আছে ? সমাজে ওদের পরিচয় ওরা খারাপ ছেলে, বাবার টাকা আর ক্ষমতার জোরে দুষ্কর্ম করে বেড়ায় কিন্তু তোমাদের মধ্যেও সেই প্রবণতা রয়েছে শুধু তফাৎ ঐ অভিভাবকের টাকা আর ক্ষমতায়। যাক বড় শিক্ষা পেলে তো সুতরাং এবারে সুস্থভাবে ভালোভাবে জীবন যাপন করার চেষ্টা করো, পড়াশোনায় মন দাও।” এরাও লজ্জায় মুখ নীচু করে নেয়।
সূর্যকান্ত বাবু গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকেন যেন ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে এদের জাগ্রত বিবেক।