• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ২৯

অপ্রতিষ্ঠানিক শিক্ষক 

|| ২৯ ||
ঊনবিংশ শিক্ষক বালক | বালক গুরু বলছেন , আমার মানাপমান বোধ নেই , নেই গৃহী ব্যক্তির মতো চিন্তা | – “ন মে মানাবমানৌ স্তো ন চিন্তা গেহপুত্রিণাম |” আমি নিজ আত্মাতেই রমণ করি এবং নিজের সঙ্গেই খেলা করি – ” আত্মক্রীড় আত্মরতির্বিচরামীহ বালকৎ |” অর্থাৎ বালকের উপর ইন্দ্রিয়ের কোনো প্রভাব নেই | সুতরাং বালক গুরুর শিক্ষা – ইন্দ্রিয় লালসা শূন্যতাই দ্বন্দ্বাতীত অবস্থা লাভের উপায় |
কুমারী অবধূতের একজন বিশিষ্ট শিক্ষক | ভাগবতে একটি সুন্দর গল্প আছে | একবার এক কুমারীর বাড়িতে কয়েকজন অতিথি এসেছিলেন | সেইজন্য কুমারী মেয়েটি উদূখলে শস্য কুটছিল | শস্য কুটবার সময় হাতের কঙ্কনগুলি পরস্পরের আঘাতে শব্দ সৃষ্টি করছিল | স্বহস্তে শস্য কুটা যেহেতু দারিদ্রকে প্রকাশ করে তাই কুমারী মেয়েটি লজ্জিত হয়ে হাতের কঙ্কনগুলি একে একে ভেঙে দিল | শুধুমাত্র একটি কঙ্কন রাখল | ফলে আর শব্দ উৎপন্ন হতে পারল না | কুমারী গুরু আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় , বহুজনের একত্র বাসই হলো কলহের কারণ | – “বাসে বহুনাং কলহো ভবেদ্ বার্তা দ্বয়োরপি | ” তাই কুমারী কন্যার কঙ্কনের মতো একাকীত্বই শ্রেয় | নির্জনতা ছাড়া বহুসঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসা আসে না | ঠাকুর বলছেন , “মাখন তুলতে গেলে নির্জনে দই পাততে হয় | দইকে নাড়ানাড়ি করলে দই বসে না | তারপর নির্জনে বসে সব কাজ ফেলে দই মন্থন করতে হয় | তবে মাখন তোলা যায় | ” ……” নির্জনে ঈশ্বরের চিন্তা  করলে জ্ঞান বৈরাগ্য ভক্তি লাভ হয় | কিন্তু সংসারে ফেলে রাখলে ওই মন নীচ হয়ে যায় | “
বাণনির্মাতাও একজন শিক্ষক | বাণনির্মাতার কাছে একাগ্রতার শিক্ষা পাওয়া যায় | বাণনির্মাতা তার কাজে এতটাই তন্ময় যে পাশ দিয়ে রাজা শোভাযাত্রা করে চলে গেলেও তার হুঁশ থাকে না | – ” যথেষুকারো নৃপতিং ব্রজন্তমিষৌ গতাত্মা ন দদর্শ পার্শ্বে |” স্বামীজি এই একাগ্রতার উপর খুব জোর দিয়েছিলেন | স্বামীজি বলছেন , “আমার মতে মনের একাগ্রতা সাধনই শিক্ষার প্রাণ , শুধু তথ্য সংগ্রহ করা নয় | আবার যদি আমাকে নতুন করে শিক্ষালাভ করতে হত আর নিজের ইচ্ছামতো আমি যদি তা করতে পারতাম , তাহলে আমি শিক্ষনীয় বিষয় নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতাম না | আমি আমার মনের একাগ্রতা ও নির্লিপ্ততার ক্ষমতাকেই ক্রমশ বাড়িয়ে তুলতাম |”
সর্পগুরু শিক্ষা দেয় বিবেকী পুরষের সর্বদা একলা বিচরণ করা কর্তব্য | “একাচার্যনিকেতঃ” এই অনিত্য সংসারের জন্য গৃহ নির্মাণে যুক্ত ঝামেলায় পড়া অসংগত এবং দুঃখের মূল | “গৃহারম্ভোহতিদুঃখায় বিফলশ্চাধ্রুবাত্মনঃ |” তাই সর্প গুরু কী করে ? -“সর্পঃ পরকৃতং বেশ্মপ্রবিশ্য সুখমেধতে |” তাহলে আমাদের কেউ কি পরের নিশ্চিন্তে কালযাপন করতে হবে ? কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে তা সম্ভব নয় | কারণ তা নিচতার পরিচয় | শ্লোকে সম্ভবত ‘অনিকেতঃ’ ভাবটিকে পাধান্য দেওয়া হয়েছে | অর্থাৎ গৃহাদিতে আসক্তিশূন্য | আমি এরূপ ঘটনাও পড়েছি অত্যন্ত গৃহাসক্তির জন্য মরার পর ঐ বাড়িরই ষাড় হয়ে জমিতে খেটে চলেছে |
এয়োবিংশ শিক্ষক মাকড়সা | মাকড়সা নিজ মুখ দ্বারা জাল রচনা করে , সেই জালেই বিচরণ করে এবং শেষকালে নিজেই উদরস্থ করে | অনুরূপভাবে পরমেশ্বর তাঁর থেকেই এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন | “অহম এব বহুস্যাম ভবেৎ |”  আমি বহু হবো – এই ইচ্ছাশক্তি দ্বারা জগতের সৃষ্টি | তাঁর সৃষ্টিতে তিনি নিজেই জীবরূপে বিচরণ করছেন – “মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ | ” ( গীতা ) শেষে তাকেই নিজের মধ্যে লীন করছেন | “অহং কৃৎস্নস্য জগত প্রভবঃ প্রলয়স্তথা |” ( গীতা ) অর্থাৎ সমস্ত বিশ্ব সূত্রের বন্ধনের মতো ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সেইজন্য জীবকে জন্ম-মৃত্যু চক্রে পড়তে হয় |
ভৃঙ্গী কীট বা তেলাপোকাও অবধূতের একজন শিক্ষক | কাঁচপোকা তেলা পোকাকে ধরে নিজ বাসস্থান বৃক্ষকোটরে নিয়ে যায় | তেলাপোকাও কাঁচপোকার ভয়ে তার প্রতি এমনভাবে ধ্যাননিষ্ট হয় যে , সে কাঁচপোকায় রূপান্তরিত হয় | তাহলে তেলাপোকার শিক্ষা এই – স্নেহে , দ্বেষে অথবা ভয়ে একাগ্রতার সঙ্গে নিজ মন কারো প্রতি সুস্থিত করে তাহলে সেই বন্ধুর স্বরূপ প্রাপ্ত হয় | – “যত্র যত্র মনো দেহী ধারয়েৎ সকলং ধিয়া | / স্নেহাদ দ্বেষাদ ভয়াদ বাপি যাতি তত্তৎসরূপতাম্ ||” অর্থাৎ শিক্ষা এই যে গভীর ধ্যানের দ্বারা ভগবৎ স্বারূপ্য লাভ করা যায় |
উপসংহারে অবধূত বালক বললেন , আমার আর একজন শিক্ষক আছেন তা নিজের দেহ | ভগবান নিজ অচিন্ত্য মায়া দ্বারা বৃক্ষ, সরীসৃপ , পশু-পক্ষী , ডাঁশ এবং মৎস্য আদি যোনী সৃষ্টি করেও তৃপ্তি লাভ করতে পারলেন না | শেষে মানবশরীর সৃষ্টি করে তিনি পরিতৃপ্ত হন | কারণ একমাত্র মনুষ্য শরীরই ব্রহ্ম সাক্ষাৎকার করতে সক্ষম | সুতরাং এই দেহ দ্বারা মোক্ষ প্রাপ্তির চেষ্টা করা কর্তব্য | অথচ আমরা অধিকাংশই শরীর দ্বারা পরমার্থের পরিবর্তে অর্থ  সাক্ষাৎকারের জন্য লালায়িত | তাই ঠাকুর বলেছেন ,”টাকা জীবনের উদ্দেশ্য হতে পারে না | টাকায় কী হয় ? ভাত হয় , ডাল হয় , কাপড় হয় , থাকবার জায়গা হয় , এই পর্যন্ত | কিন্তু এতে ভগবান লাভ হয় না |” মনুষ্য শরীর লাভ করেও ভগবান লাভের প্রতি আমাদের উদাসীনতা দেখে সাধক কবি তুলসীদাসজি বলছেন , “শোতে শোতে য্যা কর ভাই ওঠ ভজো মুরার | / আয়সে দিন আতে হ্যাঁয় লম্বা পা পসার ||”
————————————————————
তথ্যপ্রাপ্তি :
১|তুলসীদোঁহাবলী , চৈতালী দত্ত , নবপত্র প্রকাশন |  ২| শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত , শ্রীম , সাহিত্যম |  ৩| শ্রী মদ্ভাগবত মহাপুরাণ ( ২য় খণ্ড ) , গীতাপ্রেস | ৪| শ্রী শ্রী সঙ্ঘ গীতা , ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ | ৫| শ্রী গুরু সঙ্গে : শ্রী গুরু প্রসঙ্গে , স্বামী নির্ম্মলানন্দ , ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ | ৬ | আমার ভারত অমর ভারত , রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার | ৭| জগদগুরু শ্রীকৃষ্ণের শেষ উপদেশ , মহানামব্রত বহ্মচারী | ৮| শ্রীমদ্ভাগবতদ গীতা |

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।