কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ২)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
হিন্দুদের দুর্দশার কথা স্বামী প্রণবানন্দ তাঁর তপস্যালব্ধ প্রজ্ঞার দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি জাতি গঠন ও ধর্মরাষ্ট্র গঠনের জন্য নির্মাণ করলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। সেই সঙ্ঘ কিভাবে ধর্ম এবং রাষ্ট্র উভয়কে রক্ষার কাজে নিয়োজিত সে কথাই সংক্ষেপে আলোচনা করব।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ। শ্রীশ্রীমাঘী পূর্ণিমার পুণ্যদিনে সিদ্ধি লাভের পর ব্রহ্মচারী বিনোদ উচ্চারণ করলেন : “এ যুগ মহাজাগরণ, মহাসমন্বয়, মহামিলন ও মহামুক্তির যুগ।”ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অভিমুখ ও কার্যধারার লক্ষ্য নির্দেশিত হল। এই কার্য সাধনের উপায় কী? “ভারত, ভুলিও না তুমি ঋষির বংশধর। তোমার ধর্ম ও সমাজ ঋষির হস্তে গঠিত, ঋষির সনাতন অনুশাসনে অনুশাসিত ও পরিচালিত। তোমার জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি কর্তব্য ত্রিকালজ্ঞ ঋষি নির্দিষ্ট। ত্যাগ,সংযম, সত্য, ব্রহ্মচর্য্যই তোমার সনাতন আদর্শ, জাতীয় জীবনের মূলমন্ত্র। এই আদর্শকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাক, পড়ে গেলেও তোমার বিনাশ নাই, পুনরভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী।”
ভারতবর্ষ ভিতরে এবং বাইরে উভয় দিক থেকেই এই আদর্শ থেকে চ্যুত হচ্ছিল ধীরে ধীরে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ধীরে ধীরে জটিল হচ্ছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন প্রশাসনিক কাজের সুবিধার অজুহাত দেখি বাংলা ভাগের চক্রান্ত করল। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ মদতে ঢাকায় তৈরি হল মুসলিম লীগ। মুসলিম লীগের বীজ বহু পূর্বেই রোপিত হয়েছিল। স্যার সৈয়দ আহম্মদ আলিগড় আন্দোলনে হিন্দু বিদ্বেষের যে বিষবৃক্ষ রোপন করেছিলেন তারই মহীরুহ রূপ মুসলিম লীগ। অন্যদিকে ব্রিটিশদের বেপরোয়া শোষণে ও শাসনে দেশীয় শিল্প একবারে ধ্বংসের মুখে। এর সঙ্গে যুক্ত হলো উচ্চবর্ণের জমিদারদের দ্বারা জাতপাতের নামে দুর্বল হিন্দুদের উপর অমানবিক অত্যাচার। ভারতবর্ষের মানুষ ধীরে ধীরে তার স্বাভিমান বোধ হারাচ্ছিল।
বালক ও যুবকদের নৈতিক দুরবস্থা এতখানি হল তা অকল্পনীয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ। বিনোদের বয়স ১৩/১৪। তখনই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে বলছেন : “মাস্টার মশায়! আপনারা জানেন না, আমি জানি-ব্রহ্মচর্য্যহীন, সরলতাহীন, আশা- উদ্যোমহীন -যত ছেলের দল। উচ্ছন্ন যাবে দেশ-জাতি, যদি এ বন্ধ না হয়; ব্রহ্মচর্য্য, ব্রহ্মচর্য্য, ব্রহ্মচর্য্য। ব্রহ্মচর্য্য হারা হয়ে বালক যুবক সব অধঃপাতে যাচ্ছে! শক্তিহীন যারা,তাদের দ্বারা কি দেশ, জাতি, সমাজের কিছু হতে পারে? ‘স্বদেশী’, ‘স্বদেশী’ করে কি হবে? যারা কাজ করবে তারা মনুষ্যত্বহীন হয়ে যাচ্ছে -কেউ দেখবার নেই।”৫ ওই ছোট বয়স থেকেই দেশ জাতি রক্ষা করার চিন্তা। ঠিক পরেই বলছেন : “ছেলেদের ব্রহ্মচর্য্য রক্ষা করতে শেখাতে হবে, কষ্টসহিষ্ণু করতে হবে, স্বাবলম্বী করতে হবে,- ভারতীয় প্রাচীন আদর্শে ফিরিয়ে দিতে হবে।”ভারতবর্ষকে ভারতবর্ষে ফিরিয়ে আনার জন্য তখনই চিন্তিত। দেশকে স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধের মতো উচ্চারণ করলেন-সন্ন্যাস। “ভালো লাগছে না মাস্টার মশাই! সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যাবো,সন্ন্যাসী হবো;- না হলে কিছু করা যাবে না, দেশকে বাঁচানো যাবে না।”৬
দীক্ষা নিলেন ব্রহ্মচারী বিনোদ। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে শুক্লা একাদশী তিথিতে উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর মঠের তদানীন্তন অধ্যক্ষ যোগী মহাত্মা গম্ভীরনাথজির নিকট। হিন্দু ধর্মের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। ব্রহ্মচারী বিনোদ পরবর্তীকালে যুগসংগঠক স্বামী প্রণবানন্দের বিরাট আধ্যাত্মিক শক্তি ভাণ্ডারে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নিক্ষেপিত হল। মহাত্মা গম্ভীরনাথজি ব্রহ্মচারী বিনোদদের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করলেন : “আজ ভগবানের বিশেষ ইচ্ছায় এবং জগতের মহৎ কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই তোমাতে এই সমস্ত যোগৈশ্বর্য্য সঞ্চারিত করলাম। এর দ্বারা ভবিষ্যতে জগতের মহাকল্যাণ সাধিত হবে।”৭ এরপর কয়েক বছরের জন্য কঠোর তপস্যা। তপস্যার পর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১৩২২ সালে পূর্ণময়ী মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে বাজিতপুর সিদ্ধপীঠে এক কদম্ব বৃক্ষতলে ব্রহ্মচারী বিনোদ সিদ্ধি লাভ করলেন। সিদ্ধি লাভের পর শ্রীমুখে প্রথম উচ্চারণ করলেন মহামিলন ও মহামুক্তির বাণী যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। ঠিক এক বছর বাদেই ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বাজিতপুর আশ্রমে প্রথম মাঘী পূর্ণিমা উৎসবের সূচনার মধ্যে দিয়ে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। ধর্ম ও কর্মচক্রেরও প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় দিন। ধর্ম এবং ভারতবর্ষকে রক্ষা করার জন্যই স্বয়ং বিধাতা পুরুষের ঐকান্তিক ইচ্ছায় এই সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা। আচার্য প্রণবানন্দ পরে এই প্রসঙ্গে বলেছেন : “উৎসবে ৪/৫ দিন পূর্বেও কিছুই জানতাম না। হঠাৎ সর্বনিয়ন্তার আদেশ পেলাম-এই মাঘী পূর্ণিমার পুণ্যদিনেই সঙ্ঘের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সময় সংক্ষেপ, তখনই চেষ্টা করে সমস্ত ব্যবস্থা করতে লাগলাম।”৮
এই সঙ্ঘের উদ্দেশ্য কার্যপ্রণালী এবারে ধীরে ধীরে আলোচিত হবে। এই সঙ্ঘের মূল উদ্দেশ্য হলো তিনটি। সেবা, ধর্মপ্রচার এবং সনাতন বৈদিক আদর্শে জাতি গঠন। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে আচার্য প্রণবানন্দ বললেন : “বৌদ্ধ সঙ্ঘের পর এই আড়াই হাজার বছরের মধ্যে সঙ্ঘ কি জিনিস তাহা ভারতবর্ষ জানে না। বৌদ্ধ সঙ্ঘের পর অনেক সম্প্রদায়, মঠ, আশ্রম প্রভৃতির উদ্ভব হইয়াছে, কিন্তু সেগুলিকে সঙ্ঘ বলা চলে না, সেগুলি সব প্রতিষ্ঠান। সঙ্ঘ একটা গোটা মানুষের মতো জীবন্ত বস্তু। ভিতরে যেন এক জীবাত্মা বর্তমান থেকে, মনবুদ্ধিও যাবতীয় অঙ্গপ্রতঙ্গসহ শরীরটাকে পরিচালিত করিতেছেন। বুদ্ধ ছিলেন বৌদ্ধসঙ্ঘের আত্মা। তাঁর সঙ্কল্পে, তাঁর প্রেরণায় তাঁরই নীতি নির্দেশে তাঁরই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হইয়া সমগ্র সঙ্ঘ এক লয়, এক ছন্দে চালিত।…আমার সঙ্ঘ হইবে দ্বিতীয় বুদ্ধের সঙ্ঘ।”৯ এখন এই সঙ্ঘের নীতি, আদর্শ এবং সঙ্কল্পের বাস্তবায়নের গতি-প্রকৃতি নিয়ে ধীরে ধীরে আলোচনা করব।
(ক্রমশ)