• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ২৬

অপ্রতিষ্ঠানিক শিক্ষক

 || ২৮ ||

মধুহারী মানুষও অবধূতের শিক্ষক | মধুকর মধু কেবল মধুচক্রে সঞ্চয় করেই চলে , নিজে ভোগ করে না | আর মধুহারী মানুষ মৌচাক ভেঙে মধু নিয়ে পালায় | সেইরূপ জগতে লোভী পুরুষগণ কষ্ট করে ধন সঞ্চয় করে | সঞ্চিত ধন না করে ভোগ ,না করে দান – “ন দেয়ং নোপভোগ্য চ লুব্ধৈর্যদ্ দুঃখসঞ্চিতম্ |” মধু সংগ্রহকারীরা যেমন সঞ্চিত ধন কেড়ে নিয়ে যায় , ধনীরও সঞ্চিত ধনের তদ্রূপ অবস্থা হয় – “ভুঙক্তে তদপি তচ্চান্যো মধুহেবার্থবিন্মধু |” পাঁচভূতে ভোগ করে | সাহিত্য সম্রাট বড়ো মোক্ষম কথাটি বলেছেন , “চুরির মূল যে কৃপণ তার দণ্ড হয় না কেন ?” এখানে সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে বিষেদাগার নয় – ভোগবিহান সঞ্চয় , দানবিহীন সঞ্চয়ের দুর্দশা বর্ণিত হয়েছে | ভোগবিহীন সঞ্চয় , দানবিহীন সঞ্চয় ২০১৬তে জলে ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল |
হরিণ গুরুর শিক্ষা কী ? আপাত মধুর বিষয়ালাপে কর্ণের আসক্তি আত্মবিনাশের মূল কারণ | তাই বিবেকী পুরুষের কক্ষনো বিষয়ালাপ উচিত নয় – “গ্রাম্যগীতং ন শৃণুয়াদ যতির্বনচরঃ ক্কচিৎ |” কেন ? তাহলে হরিণের মতো দুর্গতি হবে | ব্যাধের সংগীতে (বাঁশীর সুরে ) মোহিত হয়ে ব্যাধেরই পাতা ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারায় | “শিক্ষেত হরিণাদ্ বদ্ধান্মৃগয়োর্গীতমোহিতাৎ | ” ঋষ্যশৃঙ্গো মুনি এর একটা জলন্ত উদাহরণ | মুনিবর নারীদের গীত-বাদ্যে-নৃত্যে বশীভূত হয়ে তাদের হাতের পুতুল হয়ে পড়েন | “নৃত্যবাদিত্রগীতানি জুষন গ্রাম্যাণি যোষিতাম্ | / আসাং ক্রীড়নকো বশ্য ঋষ্যশৃঙ্গো মৃগীসুতঃ ||”
মৎস্য অবধূতের আর এক বিশিষ্ট শিক্ষক | মৎস্য টোপে গাঁথা মাংস খণ্ডের লোভে নিজের প্রাণ দেয় | তেমনভাবেই স্বাদলোভী ব্যক্তিগণ নিজ জিহ্বার বশীভূত হয়ে প্রাণ হারান | জগৎগুরু আচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি ঐ কথাই বলেতেন , ” যত লোক না খাইয়া মরে তাহার চেয়ে বেশি লোক মরে অধিক খাইয়া |” রসনার লালসা যে কী সাংঘাতিক তার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে |
ঘটনাটি শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের জীবনের কোনো এক সময়ের | তিনি একবার ধারে রসগোল্লা খেয়ে টাকাটা আর শোধ করতে পারছিলেন না | টাকা না পেয়ে দোকানদার ঠাকুরকে কিছু অপশব্দ বলে | তাতে ঠাকুরের খুব লাগে | কোন ক্রমে টাকাটা শোধ দিয়ে প্রতিজ্ঞা করে এভাবে আর রসগোল্লা খাব না | বেশ কিছুদিন কাটার পর আবার তাঁর মনে হলো – আজ খাই | একদিন খেলে আর কী হবে ? এই কথা মনে উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও গুটি গুটি পায়ে রসগোল্লার দোকানের দিকে এগোতে লাগলেন | পরক্ষণেই ঠাকুরের মনে হলো লোভ তো তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে | লোভের কাছে আমি হেরে যাচ্ছি – এই বলে দাঁড়িয়ে পড়লেন | তখন ঠাকুরের মনে হলো তাকে যেনো কে রসগোল্লার দিকে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে | সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে শুয়ে পড়লেন | শুয়েও তাঁর মনে হলো তিনি নিজেকে সামলাতে পারছেন না | তখন তিনি একটি অড়হর ক্ষেত্রে ঢুকে দুই হাত দিয়ে অড়হর গাছগুলিকে জড়িয়ে ধরে পড়ে থাকলেন | ভীতরে তখন কুরুক্ষেত্র চলছে | মন একবার বলছে , “যা না রসগোল্লা খেলে কী হবে ? ওটা তো এমন অখাদ্য কিছু নয় | আর বেশি বাকী না পড়লেই হলো , সময়মতো যদি শোধ দিয়ে দিস কিংবা বাকী না করিস তাহলে ক্ষতি কী ? পরক্ষণেই বলছে -না | লোভকে  প্রশয় দিলে আরো পেয়ে বসবে , খাওয়া হবে না |” এইভাবে ঘণ্টাখানেক সংগ্রামের পর লোভ রণে ভঙ্গ দিল | তাহলে বুঝ ব্যাপার ! সাধারণের কী অবস্থা ! রসনাকে সামলে রাখা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটা | রসনা জয় করাই হলো প্রধান সাধন | অন্য সকল ইন্দ্রিয় বশীভূত কিন্তু রসনেন্দ্রিয় বশীভূত নয় তাকে জিতেন্দ্রয় বলা যাবে না – “তাবজ্জিতেন্দ্রিয়ো ন স্যাদ বিজিতান্যেন্দ্রিয়ঃ পুমান | ন জয়দ রসনং যাব ……. | ” যিনি রসনাজয়ী তিনি সর্বইন্দ্রিয় জয়ী – “জ্জিতং সর্বং জিতে রসে |” আমরা রসনাজয়ের জন্য চেষ্টিত হবো কীভাবে ? জগৎগুরু আচার্য স্বামী প্রণবানন্দজি বলেছেন , “ক্ষুধারূপ ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ঔষুধ স্বরূপ নির্লোভচিত্রে আহার্য গ্রহণ | “
পিঙ্গলা নারীও অবধূতের শিক্ষক | বিদেহী নগরীতে পিঙ্গলা নামে এক গণিকা বাস করতেন | কোনো এক রাত্রে সে সুন্দর পোশাক পরে ধনশালী পুরুষকে আকর্ষণের জন্য দুয়ারে দাঁড়িয়েছিল | কিন্তু রাত্রির দ্বিপ্রহর পর্যন্ত কোনো পুরুষ তাকে সঙ্গ দিতে এগিয়ে এলো না | তখন নৈরাশ্যে তার মুখ শুকিয়ে গেলো | নিদ্রাশূন্য শয্যায় সে ছটফট করতে লাগল | হঠাৎ তার মনে নির্বেদ( বৈরাগ্য ) এলো এবং তিনি বললেন , “নির্বেদ আশাপাশানাং পুরুষস্য যথা হ্যসিঃ |” মানুষ আশাবাদী ফাঁসির মঞ্চে ঝুলছে | সেই ফাঁসির দড়িকে বৈরাগ্য সম তরবারি দিয়ে কাটা সম্ভব | আরো ভাবলেন , আমি অত্যন্ত মূঢ় | আমার অন্তরে অন্তর্যামী রূপে যে পুরুষ আছেন , তাঁকে ভজনা না করে আমি তুচ্ছ পরপুরুষের ভজনা করছি | ধনলোভে নিন্দনীয় গণিকাবৃত্তি করছি | না , আর নয় | “বিহারম্যমুনৈবাহমাত্মনা রমণেন বৈ |” অন্য পুরুষের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে নিজ হৃদয়েশ্বর আত্মস্বরূপ প্রভুর সঙ্গে বিহার করব | সুতরাং পিঙ্গলা গুরু আমাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছেন যে , “আশা হি পরমং দুঃখং নৈরাশ্যং পরমং সুখম |”
কুরর পাখি চঞ্চুতে যতক্ষণ মাংসখণ্ড ছিল সেই মাংসখণ্ড কেড়ে নেবার জন্য অন্য শক্তিশালী পাখিরা তাকে তাড়া করে ফিরছিল | কুরর এক মুহূর্ত কোথাও শান্তিতে বসতে পারছিল না | কিন্তু যখন মাংসখণ্ডটা নিজ চঞ্চু থেকে ফেলে দিল তখন সে অন্য পাখি সকলের হাত থেকে রক্ষা পেলো – “তদামিষং পরিত্যজ্য স সুখং সমবন্দিত |” তাহলে কুরর পাখির শিক্ষাটা হলো – বিষসাসক্তি শত্রু সৃষ্টি করে আর বিষয় ত্যাগেই নির্বৈর হওয়া যায় | কিন্তু বর্তমানে কুরর পাখির শিক্ষা আমরা এতটাই ভুলতে বসেছি , সম্পত্তির জন্য বাপ ছেলেতে লাঠালাঠি হচ্ছে | ছেলে বাপকে খুন করে বসছে | সম্পত্তি বিভাগের মারপ্যাঁচ নিয়ে কৃষ্ণকান্তের উইলের মতো কালজয়ী উপন্যাসের সৃষ্টি হলো | তবু আমরা শিক্ষা নিচ্ছি কই ?

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।