একদিন উদয় শ্রেণিতে গিয়েছি | একটি ছোট্ট মেয়ে খুব কাঁদছে | কারণ কী ?সে অঙ্ক কষবে না | অঙ্ক তার ভালো লাগে না | তাকে জিজ্ঞাসা করলাম , ” তুমি এখন কী করতে চাও ? ” সে উত্তরে জানাল ,”নাচবে |” আমাদের স্কুলে নাচগানের যে দিদিভাই আছেন , তাকে সে চায় | যাইহোক তখনকার মতো তাকে শান্ত করলাম এই বলে পরের কালাংশে ( ক্লাস ) ঐ দিদিভাইকে পাঠিয়ে দেব | ঘটনাটি আমাকে স্পর্শ করল | তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কিন্তু নাচের দিকে | তখন যদি তাকে জোর করে অঙ্ক কষার জন্য পীড়াপীড়ি করতাম তাহলে মেয়েটির কান্নার বেগ দ্বিগুণ হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই | মেয়েটির মা ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না | সন্দেহ এই কারণেই মায়েরা ছেলেমেয়েদের বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য আদাজল খেয়ে আসরে নেমেছেন | মনে দৃঢ় বিশ্বাস সন্তান ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার অথবা মোটা মাইনের চাকুরিজীবী জীব না হলে জীবনটা যেন ব্যর্থ |
এখন অধিকাংশ মা বাবা বলে থাকেন , তাঁর শিশু সন্তানটি পারছে না | পারছে না মানে ? ইংরেজি অথবা অঙ্কটা ওদের বাড়ির সুমন যেমন পারে তেমন পারছে না |
বোঝা গেল | আপনি এর জন্য কী কী ব্যবস্থা নিয়েছেন ?
মায়েরা বলবেন –
– পুরানো টিউশন স্যার বদলিয়ে নতুন স্যার রেখেছি |
– টিউশনের সংখ্যা আর একটা বাড়িয়ে দিয়েছি |
– মাছ , মাংস , ডিম বা ঐ জাতীয় প্রোটিন খাদ্য তালিকায় বাড়িয়েছি |
– খেলার সময় বন্ধ করার জন্য বিকেলে টিউশন দিয়েছি |
– পড়া না পারলে চড় চাপড়ের মাত্রা বাড়িয়েছি অথবা টিউশন স্যারকে বলে দিয়েছি পড়া না পারলে ভালো রকম উত্তম মধ্যম দিবেন | আমার তরফ থেকে কোনো অভিযোগ যাবে না |
– ছেলের টিভি দেখার উপর ফতোয়া জারি করেছি
– বন্ধুদের সঙ্গে মেলা মেশার উপর রাশ টেনে দিয়েছি | ইত্যাদি ইত্যাদি |
আচ্ছা আপনাদের যদি বলা হয় –
-আপনি ওদের বাড়ির পারমিতাদির মতো রাঁধতে পারেন ?
– যূথিকাদির মতো গান গাইতে পারেন ?
-অথবা ওদের বাড়ির মালতীদি যেমন হাতের কাজ পারেন আপনি পারেন ?
আপনি হয়তো কাঁচুমাচু করবেন |
আচ্ছা এবার যদি আপনি যেগুলো পারেন না তার জন্য , আপনার শিশু সন্তানটির উপর আপনি যে নিয়ম লাগু করেছিলেন সেই একই বিধান যদি জারি করা হয় ? এই যেমন ধরুন বিকালে আপনার বেড়ানোটা বা গল্পটা বন্ধ করে দেওয়া হল অথবা ধরুন সন্ধ্যায় আপনার টিভি দেখার উপর লাগাম টানা হল | আপনার ভালো লাগবে ? নিশ্চিত ভাবে বলা যায় লাগবে না | এই একই সূত্রানুসারে বলা যায় আপনার চাপিয়ে দেওয়া ফতোয়াগুলি আপনার সন্তানের ভালো লাগবে না |
তাহলে এখন আমাদের করণীয়টা কী ? আমাদের দৃষ্টি ভঙ্গির পরিবর্তন চাই | ছেলে অঙ্কে সুমনের মতো নয় মানে কিছুই নয় এমনটা নয় | ছেলে কিসে কিছু বটে সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে | অভিভাবক হিসাবে এটাই আমাদের প্রধান ও প্রথম কর্তব্য | নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলেছেন , ” মানুষের মনুষ্যত্ব , তার ক্রিয়েটিভিটি | “কত টাকা জোরগার করছি এটা মনুষ্যত্বের মাপকাঠি হতে পারে না | সৃজনশীলতা মানুষকে মানুষ করে তোলে |
রজনীকান্তের নাম শুনেছেন ? জানি সবাই শুনেছেন | অভিনেতা | তিনি বলছেন :At the age of 25 I was a bus conductor . বিলগ্রেটস বলছেন : I didn’t even complete my University Education . ধিরুভাই আম্বানী – ধনকুবের | তিনি বলছেন : I warked in a Petrol Pump . আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছেন : At my childhood days , I stitched shoes . শচীন তেণ্ডুলকর বিশ্ববরেণ্য ক্রিকেটার | তিনি বলেছেন :I failed in the 10th standard . মেসি , বিখ্যাত ফুটবলার | তিনি বলেছেন : I used to serve Tea at a shop to support my Football training .
এরা কিন্তু কেউ পুঁথিগত বিদ্যায় সফল নয় | কিন্তু এতটাই সফল , যে বিশ্ববরেণ্য।কেন ? এরা স্বাধীন সত্ত্বাটাকে মরতে দেয়নি | ঘুরিয়ে বলা যেতেই পারে এদের অভিভাবক তেমন ভাবে বাধ্য করেনি | করলে কী হতো ?
লতা মঙ্গেশকরকে গান করতে না দিয়ে যদি নাচ করতে বলা হতো তাহলে কী হতো ? তাহলে কী আমরা একজন সংগীত শিল্পীকে পেতাম ? আইনস্টাইনকে জোর করে যদি নাচ বা গান শেখানো হতো তাহলে কী আমরা একজন মহাবিজ্ঞানীকে হারাতাম না ? অথবা ধরুন শচীন তেণ্ডুলকরকে ক্রিকেট খেলতে না দিয়ে যদি শুধু পড়তে বলা হতো তাহলে শচীনকে আমরা ক’জন জানতাম ? ঠিক একই ভাবে অমর্ত্য সেনকে পড়তে না দিয়ে যদি খেলায় চাপ দেওয়া হতো তাহলে কী আমরা একজন নোবেল জয়ীকে পেতাম ? না , পেতাম না | অর্থা অমর্ত্য সেন তাঁর সমস্ত এনার্জি লাগিয়েছিল পড়াশোনায় আর শচীন সমস্ত এনার্জি ব্যয় করেছেন খেলাধুলায় | তাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে উভয়েই খ্যাতির শিখরে পৌঁছাতে পেরেছেন |
আপনার ছেলে সুমনের মতো অঙ্ক পারে না , আর অঙ্কটাই যদি জোর করে ভালো লাগানোর চেষ্টা করা হয় তবে নিশ্চিত বলতে পারি আপনার ছেলের তোতা পাখির মতো অবস্থা হবে | রবীন্দ্রনাথের ” তোতাকাহিনী ” পড়েছেন তো ? পড়া থাকলে অবস্থাটা আঁচ করতে সুবিধা হবে |
আপনার ছেলে শচীনের মতো বিরাট মাপের ক্রিকেটার হবে , না অমর্ত্য সেনের মতো বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ হবে সেটা ওকেই খুঁজে নিতে দিন | আপনি খালি স্টিমুলেটর হবেন | তার অর্থ এই নয় যে স্বাধীন ইচ্ছাটাকে লালন – পালন করতে গিয়ে আপনার ছেলে মূর্খ থাকুক | তার ভালো লাগার বিষয়টা প্রাধান্য পেলে পড়াশোনায় ক্ষতি হবে সেটা কিন্তু ভুল ধারণা | অর্থাৎ এখানে তার ভালো লাগার বিষয়টা মুখ্য বাকিগুলো গৌণ।গৌণটাকে মুখ্য করার প্রচেষ্টাটা বন্ধ হোক |