কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ১)

হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ
ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে স্বামী প্রণবানন্দ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আবির্ভাব। ১৯০২। স্বামীজি চলে গেলেন। বিবেকানন্দের অকাল প্রয়াণে হিন্দু সমাজে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হল। বাংলার রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই বদলে গেল। আরো তিন বছর গড়িয়ে গেল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত নিলেন। বাংলা ভাগ রধ করার জন্য পথে নামলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ভগিনী নিবেদিতা লর্ড কার্জনের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে উঠে পড়ে লাগলেন। আন্দোলন দমন করতে পুলিশও তৎপর হলেন। এইরকম একটি পরিস্থিতিতে বাজিতপুরে বড় হচ্ছে হিন্দুধর্মের রক্ষাকর্তা ও পরিত্রাতা স্বামী প্রণবানন্দ। তখন ছোট্ট ন’বছরের বালক বিনোদ। কিন্তু বিনোদের জীবন কোন খাদে বইবে এই ঘটনা যেন তারই একটি পটভূমি তৈরি করছিল।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন ও পরে লর্ড মিন্টো যে একটি ঘৃণিত চক্রান্ত করেছিলেন অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে বলতে হচ্ছে সেই চক্রান্তে সহযোগী ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা সালিমুল্লাহ ও স্যার সুলতান মহম্মদ শাহ। কার্জন এবং মিন্টো সালিমুল্লাহকে ঘুষ দিয়ে পূর্ববঙ্গে দাঙ্গা বাঁধালেন।১ সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নেমে এলো নৃশংস অত্যাচার। এই অত্যাচারের ব্যাপক ফলশ্রুতিতে আমরা দুটি ঘটনা দেখলাম। কলকাতা দাঙ্গা ও নোয়াখালী গণহত্যা। সেই দাঙ্গা ও গণহত্যার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত না থাকলে হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ভূমিকা অনুধাবন করতে পারব না।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বোম্বে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। জন্ম থেকেই মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের জন্য ভারত ভূমি থেকে পৃথক স্বতন্ত্র একটি আবাসভূমি আদায় করা। এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে এলাহাবাদে মুসলিম লীগের সম্মেলনে মহম্মদ ইকবাল মুসলিমদের জন্য পৃথক প্রদেশের দাবি করেন। ইকবালের এই দাবি ভারতবর্ষকে এক বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ১৯৩২ সালে কংগ্রেস যখন তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠক বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন আম্বেদকর মহাত্মা গান্ধীকে তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান। কোরান ভিত্তিক মুসলিম রাষ্ট্রের পরিকল্পনা আম্বেদকর বুঝতে পেরেছিলেন। স্বামী প্রণবানন্দও তাঁর দূরদৃষ্টির ফলে বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালি হিন্দুর অবস্থা খুব শোচনীয়। তিনি বলতেন : “আপনারা বুঝিতেছেন না, কিন্তু আমি দেখিতে পাইতেছি বাঙালি জাতি ধ্বংসোম্মুখ। এমনি সময় আসছে সামনে যখন বাঙালি জাতি পাগলের মত ছুটে বেড়াবে। মাথা গুঁজবার ঠাঁই পাবে না, পোকামাকড়ের মত পথে ঘাটে পড়ে মরবে।”২
এই কথা যে কত সত্য কলকাতা হত্যা এবং নোয়াখালী গণহত্যায় চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই বোম্বেতে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সুকৌশলে মুসলমানদের বোঝানো হলো : “রমজান মাসেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলাম এবং পৌত্তলিকতাবাদীদের মধ্যে লড়াই হয়। ৩১৩ জন মুসলমান এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন। আবার এই রমজান মাসে ১০হাজার মুসলমান পরম সত্য পয়গম্বরের নেতৃত্বে মক্কা জয় করেন। এখানে স্বর্গের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলাম শাসন। মুসলিম লীগ অত্যন্ত গর্বিত যে এই পবিত্র মাসেই আমরা এমন একটি মহা সংঘর্ষের ডাক দিয়েছি।”৩
সেইমতো ১৬ আগস্ট থেকে শুরু হল লুঠ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ,অপহরণ এবং ধর্মান্তকরণ। কলকাতা জুড়ে চলল তাণ্ডব নিত্য। এই লুঠ,হত্যা, ধর্ষণের পূর্বে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ.এস.সুরাবর্দী সাংবাদিকদের সামনে ঘোষণা করেন, তিনি বাংলার বুকে বিশৃঙ্খল অবস্থায় জন্য দায়ভার বহন করবেন না।
সেই সময়ের সংবাদপত্র যথা স্টেটসম্যান, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, অমৃতবাজার, লাইভ পত্রিকা, মডার্ন রিভিউয়ের পাতায় কলকাতা দাঙ্গার খবর বিস্তারিতভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল। অনুরূপ গণহত্যা হয়েছিল নোয়াখালীতে।
বাংলার এই দুর্দিনে হিন্দুদের উপেক্ষিত স্বার্থ নিয়ে বারবার কথা বলেছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। আর এই শ্যামাপ্রসাদই ছিলেন যুগাচার্য প্রণবানন্দের নির্বাচিত মানুষ। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্মাষ্টমীর দিন রাসবিহারী এভিনিউয়ে সম্মেলন মঞ্চে সহস্র সহস্র উৎসুক দর্শকের সামনে স্বামী প্রণবানন্দ নিজের গলার মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদের গলায়। সেদিন শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন : “বাঙালি হিন্দুর সামনে দাঁড়াবার লোক ঠিক করে দিলাম।”৪ যুগাচার্য প্রণবানন্দের এই আশীর্বাদ কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ তা কয়েক বৎসরের মধ্যেই বোঝা গেল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন তৈরি হল সমগ্র বাংলা ও পাঞ্জাব পাকিস্তানে চলে যাবার উপক্রম হল। জিন্নাহর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বাংলার শরৎ বসু, কিরণশংকর রায় প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির বলিদান অনুমোদন করতে উদ্যত, তখন শ্যামাপ্রসাদ পাকিস্তানের গ্রাস থেকে সমগ্র বাংলাকে রক্ষা করবার জন্য একাই উঠে পড়ে লাগেন। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাংলাকে উৎসর্গ করবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্যামাপ্রসাদ একাই লড়াই নেমে বাংলার এক তৃতীয়াংশ ভূমি (পশ্চিমবঙ্গ) ছিনিয়ে এনে বাঙালি হিন্দুদের দাঁড়াবার স্থান করে দিলেন। এর পিছনে সঙ্ঘনেতা যুগাচার্য প্রণবানন্দজির আশীর্বাদ ও শক্তি সঞ্চার কাজ করেছিল।
(ক্রমশ)