কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৫)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

স্বামী দয়ানন্দের অন্ধ স্বধর্মপ্রীতি রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দে ধর্ম সমন্বয় এবং স্বামী প্রণবানন্দের সমাজ সমন্বয় আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নিয়েছিল। তাই বিবেকানন্দ এবং প্রণবানন্দ দুই যুগনায়কই আর্য সমাজ থেকে তাঁদের কর্মপদ্ধতিকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখলেন। তাছাড়া যুগাচার্য প্রণবানন্দজি দেখলেন আর্যসমাজীরা সমাজের উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর মধ্য সীমাবদ্ধ হয়ে হিন্দু ধর্মের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে। তবে অবশ্য দয়ানন্দের শুদ্ধি আন্দোলনের প্রশংসা আচার্যদেব করতেন। অনুরূপভাবে ব্রাহ্মসমাজও চিরাচরিত হিন্দু সমাজ থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে এলিট সম্প্রদায়ের ধর্ম হয়ে দাঁড়াল। তাই আচার্যদেব আর্য সমাজের মতো ব্রাহ্মসমাজকেও দূরে রাখলেন। আচার্যদেব বললেন : “গত একশোবছর ধরে কেউ ডাক দিয়েছে- ‘ব্রাহ্ম’বলে কেউ ডেকেছে ‘আর্য্য’ বলে, কেউ ডেকেছে -ভারতীয় জাতি বলে, কোনো পক্ষ তাকে আখ্যা দিয়ে রেখেছে ‘অমুসলমান’! বিরাট ভারতীয় হিন্দু জাতটা অসাড় অবশ হয়ে আত্মভুলে ঘুমিয়ে রয়েছে। আজ সময় এসেছে হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দেবার। আমি তাই হিন্দুকে হিন্দু বলে ডাক দিতে চাই! আমি সমগ্র হিন্দু জনসাধারণকে ‘আমি হিন্দু’ ‘আমি হিন্দু’ জপ করাবো। এই হিন্দুত্ববোধ জাগার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিলুপ্ত তেজোবীর্য্য, শক্তি-সামর্থ্য জেগে উঠবে।”

ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের জাতিগঠনমূলক কার্যাবলীকে মূলত পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-১। ধর্ম প্রচার, ২। তীর্থ সংস্কার, ৩। শিক্ষা বিস্তার,৪। জনসেবা, ৫। হিন্দু-সমাজ-সমন্বয় আন্দোলন। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে যুক্ত হল – অনুন্নতোন্নয়ন, অস্পৃশ্যতা নিবারণ, আদিবাসী কল্যাণ, শুদ্ধি আন্দোলন এবং দেশে ও বিদেশে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রচার।

পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে উপরোক্ত বিষয়গুলি সংক্ষেপে আলোচিত হবে।

।। নৈতিক আদর্শ ও ব্রহ্মচর্য আন্দোলন।।

আচার্যদেব বললেন : “ছাত্র ও যুবকগনই দেশের ভবিষ্যৎ আশা-ভরসাস্থল। তাই তাদের জীবন গঠনই আমার প্রথম ও প্রধান কাজ।” সংযমী, নিষ্ঠাবান, তেজস্বী, সাহসী ও শক্তিশালী মানুষ ছাড়া কেউ দেশ এবং জাতিকে রক্ষা করতে পারবে না। তাই তিনি প্রথম শুরু করলেন ব্রহ্মচর্য আন্দোলন। বললেন : “রিপুদমন ও ইন্দ্রিয় সংযমের দ্বারা যাহারা মনুষ্যত্বের সাধনায় ব্রতী, তাহারা আমার প্রাণপেক্ষা প্রিয়তর। দূরে বা নিকটে যেখানেই থাকুক না কেন, আমার তপঃশক্তি তাহাদিগককে রক্ষা কবচের মতো রক্ষা করিবে।”

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ। কলিকাতা আশ্রম ১৬২ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে উঠে এল। একদিন আশ্রমে সঙ্ঘ সেবক সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হল।তার পর থেকে প্রতি রবিবার অপরাহ্ণে বসত সম্মেলনীর অধিবেশন। আচার্যদেবের নির্দেশে স্কুল, কলেজ, হোস্টেল, পার্ক,বাড়িতে সর্বত্র বিতরিত হতে লাগল ‘ব্রহ্মচর্য ও নৈতিক চরিত্র গঠনের অভিনব শিক্ষা সাধনা’ নামক আহ্বানপত্র। আচার্যদেব বললেন : বীর্য্যই জীবন, বীর্য্যই প্রাণ, বীর্য্যই মানুষের যথাসর্বস্ব, বীর্য্যই মানুষের মনুষত্ব। এই বীর্য্য রক্ষা করলেই মানুষ দেবতা হয়, আর এই বীর্য্য নষ্ট করলেই মানুষ পশুত্বপ্রাপ্ত হয়। তাই তোমরা কায়মনোবাক্যে বীর্য্য ধারণ কর।”

বীর্য্য ধারণের সমস্ত নিয়মাবলি এবং তার সাধন ছাত্র যুবকদেরকে শিক্ষা দিতে লাগলেন। বেশ সাড়া পড়ে গেল। এই সময় আচার্যদেবের ব্রহ্মচর্য বিষয়ক সাধনাগুলি ‘ব্রহ্মচর্য্যম্’পুস্তকে প্রকাশিত হল। পাঁচ বছরের মধ্যে আটটি সংস্করণ হল পুস্তকটির। এবং প্রত্যেক সংস্করণে দশ হাজার করে পুস্তক ছাপানো হয়েছিল।

সঙ্ঘসেবক সম্মিলনীর অধিবেশনগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণীর বিভিন্ন বয়সের ছাত্রের সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও অধ্যাপকগণ আসতে লাগলেন। আসতে লাগলেন সরকারি কর্মচারীর দলও। ফুটপাত হতে তেতলায় আচার্যদেবের কক্ষ পর্যন্ত মানুষের অসম্ভব ভিড় হতে লাগল। ছাত্র থেকে শিক্ষক সকলেই চায় আচার্যদেবের দর্শন ও কৃপালাভের সৌভাগ্য।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সঙ্ঘের মির্জাপুরষ্ট্রীটে সঙ্ঘের কার্যালয় স্থাপিত হলে আশ্রমভবনে শনি ও রবি দুই দিন ‘সঙ্ঘসেবক সম্মেলনীর’ অধিবেশন বসত। স্বামী বেদানন্দ সেই সময়ের বর্ণনা দিচ্ছেন : “চৈত্র বৈশাখ মাসের নিদারুণ গ্রীষ্মে ৫/৬ ঘন্টা এক ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া আচার্য্যদেবের দর্শন লাভ করিত; উপদেশ গ্রহণান্তে বাইরে আসিলে দেখিতাম দর্শনার্থী যেন স্নান করিয়া আসিয়াছেন; সমস্ত জামা কাপড় ঘর্ম্মাক্ত,তথাপি তাহার মুখে কী উৎসাহের ভাব, আনন্দের হাসি, আত্মপ্রসাদের তৃপ্তি! বহু ব্যক্তি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়া পরিশেষে হতাশ হইয়া ফিরিতেন, পর দিনের আশায়। অনেকে এমনি দু’চার পাঁচ দিন চেষ্টার পর দর্শন লাভে সমর্থ হইতেন। আচার্য্যদেব রাত্রি তিনটার সময় হইতে আসনে বসিতেন। দ্বিপ্রহর কয়েক ঘণ্টা মাত্র আসন ত্যাগ করিতেন। পুনঃ আসনে বসিয়া রাত্রি ১১টা পর্যন্ত দর্শন, উপদেশ, আশীর্ব্বাদ ও ‘ব্রহ্মচর্য্য সাধন’ দান করিতেন।১৪

আচার্যদেব চেয়েছিলেন এই বিলাসিতা,নাস্তিকতা এবং অবিশ্বাসের হাত থেকে যুবকশক্তিকে রক্ষা করতে। তা না হলে একটি আদর্শ জাতি গঠন কখনই সম্ভব নয়। তাই হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করার প্রথম পদক্ষেপ ব্রহ্মচর্য আন্দোলন।

এই ব্রহ্মচর্য কী এই সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার আছে। “বীর্য্যধারণং ব্রহ্মচর্য্যম।”বীর্য ধারণ করাই ব্রহ্মচর্য। আমাদের শরীর সাতটি ধাতুতে গঠিত। যথা রস, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, মজ্জা ও শুক্র। এই শুক্রকেই বীর্য বলে। আমরা প্রতিদিন যা খাবার খাই -তা পাঁচ দিনে পরিপাক হয়ে রসে পরিণত হয়। ঐ রস পাঁচদিনে পরিপাক হয়ে রক্তে, ওই রক্ত পাঁচ দিনে মাংসে, ঐ মাংস পাঁচ দিনে মেদে, ঐ মেদ পাঁচ দিনে অস্থিতে, ঐ অস্থি পাঁচদিনে মজ্জায়, ঐ মজ্জা পাঁচদিনে শুক্রে পরিণত হয়। ব্রহ্মচর্য পালনের প্রধান কয়েকটি অঙ্গ হল-আহার সংযম, নিদ্রা সংযম, বাক সংযম, সঙ্কল্প সাধন এবং মৃত্যুচিন্তা।
(ক্রমশ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *