কথা সাগরে মৎসাপুরুষ ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী (পর্ব – ৯)

হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ ও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ

হিন্দু সমাজ সমন্বয় আন্দোলন : হিন্দু মিলন মন্দির, হিন্দু রক্ষীদল ও হিন্দু সম্মেলন 

আচার্য প্রণবানন্দজী দেখলেন হিন্দুর বিদ্যা আছে, বুদ্ধি আছে, অর্থ সামর্থ্য সবই আছে; নেই কেবল সংহতি শক্তি। এরই অভাবে হিন্দু লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত। তাই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হিন্দুজাতিকে সঙ্ঘবদ্ধ করে শক্তিশালী জাতি গঠনের উদ্দেশ্যে আচার্যদেবের ‘হিন্দু-সমাজ-সমন্বয় আন্দোলন। এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করার জন্য হিন্দু মিলন মন্দির ও হিন্দু রক্ষীদল গঠন। আচার্যদেব নিজ মুখে বলছেন : “সর্বশেষে সর্বনিয়ন্তার বিশেষ ইচ্ছায় হিন্দু সংগঠন ও হিন্দু মিলন মন্দির আন্দোলন আরম্ভ- অধ্যাত্ম সাধনার মহাব্রত। ভারতের তথা সমগ্র বিশ্বের মঙ্গল ইহাতেই নিহিত রয়েছে।”২০  আরো বললেন, “আমি দিব্যচক্ষে দেখছি যে, হিন্দু সংগঠন ও হিন্দু মিলন মন্দির ভারতের তথা জগতের সেই মহাজাগরণ আনয়ন করবে।”২১

কেন আচার্য প্রণবানন্দজী হিন্দু-সমাজ-সমন্বয় আন্দোলন চাইলেন? তিনি জানতেন : “হিন্দুতে হিন্দুতে মিলন যত শীঘ্র গড়ে উঠবে, হিন্দু মুসলমান খৃস্টানে মিলন তত শীঘ্র সম্ভব হবে। কারণ মিলন হয়- সমানে-সমানে, সবলে-সবলে; সবলে ও দুর্বলে কখনও মিলন হয় না। সুতরাং বিশাল হিন্দু জনগণ যখন সমস্ত ভেদ-বিবাদ-বিরোধ অস্পৃশ্যতা ভুলে সম্মিলিত ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে শক্তিশালী হবে, তখনই অন্যান্য জাতির সঙ্গে তার মিলন সহজ ও সম্ভব হবে।”২২

এখন খুব সংক্ষেপে হিন্দু মিলন মন্দির সম্পর্কে পাঠককে কিছু জানানো দরকার। হিন্দু মিলন মন্দির হিন্দুদের এমন একটি মিলন ক্ষেত্র যেখানে উচ্চ নীচ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর হিন্দু জনসাধারণ একত্রে মিলিত হয়ে মিলন, সখ্যতা, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ভাব প্রতিষ্ঠা করবে। এই মিলন মন্দিরে কোনো দেব-বিগ্রহের অধিষ্ঠান বা পূজা-অর্চনা হবে না। আচার্যদের নির্দেশ দিলেন : “এটাই হচ্ছে বর্তমান যুগে সমগ্র হিন্দু সমাজের একমাত্র মিলন ভূমি, ধর্মক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র, সমস্ত সমস্যার সমাধান ক্ষেত্র -উৎসাহ, উদ্যম, শক্তি ও প্রেরণা লাভের উৎসস্থল -একমাত্র তীর্থস্থান। এই মিলন মন্দিরের মধ্য দিয়েই সমগ্র হিন্দুর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জাতীয় জীবনের যাবতীয় সমস্যা সমাধান হবে।”২৩

হিন্দু মিলন মন্দিরের কর্মপদ্ধতিকে প্রধানত ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

১। ধর্ম প্রচার বিভাগ, ২। সমাজ সংগঠন ও সমাজ উন্নয়ন বিভাগ, ৩। সেবা বিভাগ, ৪। শিক্ষা বিস্তার বিভাগ, ৫। পল্লী উন্নয়ন বিভাগ, ৬। রক্ষী দল স্বেচ্ছাসেবক বিভাগ। এই সমস্ত বিভাগের আবার বিভিন্ন উপবিভাগ আছে।

একটি মিলন মন্দিরে কী কী থাকবে আচার্যদেব নির্দিষ্ট করে দিলেন।

 সার্বজনীন প্রার্থনা মন্দির – এখানে দৈনিক নিয়মিতভাবে পূজা প্রার্থনা, ভজন কীর্তনাদি হবে। হিন্দু মাত্রেরই মন্দিরে প্রবেশের অধিকার থাকবে।

নাট মন্দির -মন্দিরের সম্মুখে একটি নাটমন্দির থাকবে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে সমবেত উপাসনা ও আলোচনা সভাদি হতে পারবে। এছাড়া থাকবে দাতব্য চিকিৎসালয়, অবৈতনিক বিদ্যালয়, লাইব্রেরী, ব্যায়ামাগার, রক্ষীবাহিনী, প্রচারক বাহিনী, মাতৃমন্ডলী যজ্ঞকুণ্ড(তামার নির্মিত)।

তাছাড়া প্রতি সপ্তাহে অন্তত একদিন করে (বৃহস্পতিবার) সাপ্তাহিক অধিবেশন বসবে। ঐদিন সন্ধ্যায় সকল শ্রেণীর হিন্দু স্ত্রী ও পুরুষ মিলন মন্দিরে উপস্থিত হয়ে হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রাদি পাঠ করবে। কোনো সমস্যা হলে সকলে মিলে তা আলোচনা করবে। শেষে ভজন-কীর্তন, পূজা-প্রার্থনা, প্রসাদ বিতরণ হবে।

প্রত্যেক মিলন মন্দিরে থাকবে একটি করে রক্ষীদল। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ বাংলা ২৩ ফাল্গুন ১৩৪৬ সন শ্রীশ্রীশিবরাত্রি উপলক্ষ্যে কলকাতার বালিগঞ্জ আশ্রমে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার মন্মথনাথ  মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক বিরাট হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। সেখানে আচার্যদেবের নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে ৫ লক্ষ রক্ষী সহ এক বিরাট রক্ষী দল গঠনে প্রস্তাব গৃহীত হল।

কারণ এই সময়ে আচার্যদেব হিন্দু জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। তিনি দিব্য চোখে দেখছেন বাঙালি হিন্দু পোকামাকড়ের মতো পথে ঘাটে মারা পড়বে-যে কথার উল্লেখ পূর্বেই করেছি। কারা এই রক্ষী? এদের কাজই বা কী হবে? আচার্যদেব বললেন : “অন্যায় -অত্যাচারের প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জন্য স্থিরসঙ্কল্প যে, দেহে এক বিন্দু রক্ত থাকতেও হিন্দুর ধর্ম, মান, ইজ্জত, স্বার্থ ও অধিকারে কাকেও হস্তক্ষেপ করতে দিব না-এরূপ সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা যার সেই হবে প্রকৃত রক্ষী।”এখন রক্ষীদলের কাজের একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় নেওয়া যাক। রক্ষীদল চায়-

*হিন্দুর লাঞ্ছনা ও নির্যাতন দূরীকরণ।

*হিন্দুর উপর অনুষ্ঠিত অন্যায় জোরজুলুম,অত্যাচারের প্রতিবাদ ও প্রতিকার।

*হিন্দুর মন্দির, বিগ্রহ, ধর্মস্থানের পবিত্রতা রক্ষা ও নির্বিঘ্নে,নিরুপদ্রবে পূজার্চনা আরতি, নগর সংকীর্তন,শোভাযাত্রাদি  ধর্মানুষ্ঠানের ব্যবস্থা।

*নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষা।

*সর্বপ্রকার অত্যাচার উৎপীড়নের কবল হইতে হিন্দু জনসাধারণের রক্ষা বিধান।

*সামাজিক দুর্নীতি ও দুষ্ক্রিয়া সমূহের প্রতিরোধ।

*সর্বশ্রেণীর হিন্দু জনসাধারণের ভেতর প্রেম, প্রীতি, সৌহৃদ্য ও মিলন সংস্থাপনপূর্বক অন্যান্য বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের সহিত ঐক্য ও সখ্য ও  মিলন সংসাধন।

আচার্যদেবের কড়া নির্দেশ ছিল রক্ষীদলের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ের কোন সম্পর্ক থাকবে না। এই রক্ষীদল নিয়ে তৎকালীন সময়ের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়, মহা মহাপাধ্যায় কবিরাজ গণনাথ সেন সরস্বতী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও দার্শনিক শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ব্যারিস্টারে শ্রীযুক্ত বি.পি চ্যাটার্জী প্রমুখ ব্যক্তিগণ রক্ষী দল তথা আচার্যদেবের কর্মদক্ষতার বিশেষ প্রশংসা করলেন।(ক্রমশ)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *