সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মানস চক্রবর্ত্তী – ৪

মর্তকায়ার অন্তরালে
|| চার ||
এইখানে আর একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন এই যে , চম্বার ছাত্রদের ছেড়ে আসতে অনিচ্ছুক অথবা ছাত্ররা তাঁকে ছাড়তে চায় না ক্ষিতিমোহনের পরোক্ষ স্বীকারোক্তি রবীন্দ্রনাথের ঔৎসুক্যের কারণ | ভূপেবাবুকে লেখা চিঠি থেকেই তা পরিষ্কার | রবীন্দ্রনাথ লিখলেন :
“আমি একজন সুযোগ্য অধ্যাপকের সন্ধান পাইয়াছিলাম তিনি পশ্চিমে অধ্যাপনা করেন | সেখানকার ছাত্রগণ তাঁহাকে ছাড়িতে চান না তিনিও তাহাদিগকে ছাড়িতে অনিচ্ছুক | তিনি এম. এ ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত , পালি জানেন – ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহসম্পন্ন , আমাদের বিদ্যালয়ের ঠিক উপযুক্ত | যদিও তিনি তাঁহার ছাত্রদের ছাড়িয়া আসিতে সম্মত নহেন জানাইয়াছেন , তথাপি আমি তাঁকে অনুরোধ করিয়া আর একখানি পত্র লিখিতেছি | যদি তাঁহার আসন টলাইতে পারি তবে খুশী হইব | দুই একজন রীতিমতো সুপণ্ডিত লোক না পাইলে আমাদের বিদ্যালয়ের গৌরব হইতেছে না | এই কারণে এবার লোক বাছিতে আমি এত বিলম্ব করিতেছি |”
ইতিমধ্যে ক্ষিতিমোহন পিতা ভুবনমোহন ও কাশীর বন্ধুদের সঙ্গে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে এক প্রস্থ আলোচনা সেরে নিলেন | পিতা তাঁকে আর্থিক লাভালাভের দিকটা ভালো করে দেখে নেবার পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখলেন | সেইজন্য ক্ষিতিমোহনের পরবর্তী চিঠিতে অর্থপ্রাপ্তির প্রসঙ্গটা এল | ১২ই ফাল্গুনের চিঠির সূত্র ধরে ১৫ই ফাল্গুন ক্ষিতিমোহন লিখলেন :
“আপনি লিখিয়াছেন যাহাতে আমার আর্থিক ক্ষতি না হয় সেরূপ ব্যবস্থা করিবেন | এখানে আমি অল্পদিন হইল ১০০্ টাকা মাসিক বেতনে আসিয়াছি | বৎসরে ১০্ বৃদ্ধি হইয়া ৬ বৎসরে ১৬০্ টাকা হইবে | আগামী জুলাই হইতে ১১০্ টাকা পাইব | ইহা বিদ্যালয়ের অধ্যাপনার মাহিনা |
আমাকে মধ্যে মধ্যে রাজা এবং রাজ্যের কার্য্যে ভ্রমণ করিতে হয় – তাহাতে বার্ষিক বরাদ্দ আছে | এখানে বাড়ী ভৃত্য পাচক অশ্বযানাদি রাজার ব্যয়ে পাই | অনতিবিলম্বে একটা মিউজিয়াম হইবে তাহার ভারও আমাকে লইতে হইবে | আপনার ওখানে মাসিক কত পাইতে পারি ? এবং কত পর্য্যন্ত বৃদ্ধি হইবে এবং বার্ষিক বৃদ্ধি কত ? “
এই চিঠিতে ক্ষিতিমোহন আর্থিক প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন | “অনেক চেষ্টা করিয়াও প্রশ্নগুলিকে হৃদ্য করিতে পারিলাম না – তাই যেমন মনে আসিল লিখিয়া দিলাম | ক্ষমা করিবেন | আমি বাধ্য হইয়া অতি সঙ্কোচের সহিতই কথাগুলি উপস্থিত করিতেছি বাধ্য হইয়া – কেননা আমার উপার্জ্জনশীল জ্যেষ্ঠভ্রাতা হঠাৎ আমাদের ছাড়িয়া পরলোকগমন করিয়াছেন | তিনি পরদুঃখকাতর ছিলেন – বহু ঋণ করিয়া যান – তাঁহার চিকিৎসাতেও ঋণ হয় | আমার পিতা এই শোকে মূহ্যমান হইয়া ব্যবসা ত্যাগ করেন | এবং এখন দৈন্যের যাহা কিছু চাপ সব আমার শোকাতুরা জননীকে সহ্য করিতে হয় – তাই ইচ্ছা হইলেও সৎকার্য্যে নিজেকে উৎসর্গ করিতে পারি না | না হইলে বোলপুরের কার্য্যটি জীবনে কতবার যে শ্রেষ্ঠতম প্রার্থনীয় মনে করিয়াছি তাহা বলিতে পারি না | যাহাদের মনোরথ হৃদয়ে উঠিয়া হৃদয়েই লীন হয় – তাহাদের সম্বন্ধে বোধহয় আপনি অল্পই জানেন |”
শেষে অবস্থা অনুকুল হলে তিনি যে যেতে প্রস্তুত তাও জানালেন | “শেষ কথা যদি আর্থিক অবস্থা আমার অনুকূল হয় তবে আপনার নিতান্ত প্রয়োজন থাকিলে মে মাসের শেষভাগে বা জুনের প্রথমে যখন অবকাশ পাইব তখনই বোলপুরে কার্য্য আরম্ভ করিব | বাড়ী যাইব না | বরং জুলাই মাসে ১৫দিনের অবকাশ লইয়া আসিয়া এখানকার ছাত্রদের প্রমোশন দিয়া বেতন লইয়া ও চার্জ বুঝাইয়া দিয়া যাইব |”
ক্ষিতিমোহনের ১৫ই ফাল্গুনের চিঠি পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ যে চিঠি লিখলেন তাতে অর্থের অঙ্কটা উল্লেখ আছে | আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথের ১৬ই ফাল্গুন পত্র লেখার আগে ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রনাথকে পর পর দুখানা পত্র লেখেন | ১২ই ফাল্গুন ও ১৫ই ফাল্গুন |রবীন্দ্রনাথের ১৬ই ফাল্গুনের লেখা চিঠি ১২ই ফাল্গুন ক্ষিতিমোহনের লেখা চিঠির উত্তর তা পূর্বেই উল্লেখ করেছি | রবীন্দ্রনাথ এবার ক্ষিতিমোহনকে যে চিঠিটা লিখলেন তাতে তারিখ ১৯শে ফাল্গুন | সম্ভবত ১৫ই ফাল্গুন ক্ষিতিমোহনের লেখা চিঠির উত্তর | চিঠিখানাতে এবার আমরা চোখ রাখব |
ওঁ
শিলাইদহ
বিনয় সম্ভাষণপূর্ব্বক নিবেদন
গত পরশ্ব যদিচ আপনাকে নিষ্কৃতি দিয়া পত্র লিখিয়াছি কিন্তু তথাপি অন্তঃকরণকে ফিরাইতে পারি নাই – বোধ হয় আপনাকে পাইবই বলিয়া এইরূপ ঘটিতেছে | আজ আপনার পত্র পাইয়া আমি মন হইতে সমস্ত বাধা দূর করিয়া দিলাম | আপনি যেরূপ প্রস্তাব করিয়াছেন তাহাতে আমি আনন্দের সহিত সম্মতি জানাইতেছি | এক্ষণে মাসিক একশত ও প্রতি বৎসর দশ টাকা করিয়া বৃদ্ধি লইয়া ক্রমে দেড়শত পর্য্যন্ত যদি বৃদ্ধি স্থির করেন তবে আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইবে না | কারণ আর দুই বৎসরের মধ্যে আমেরিকা ইংলণ্ড হইতে চারিজন ছাত্রই ফিরিয়া আসিবে তখন আমার অনেকটা ভার লাঘব হইবে | আমার সাধ্যমত আপনাদের অসুবিধা হইবে না ইহা নিঃসন্দেহ | বিদ্যালয়ও ক্রমশই যেরূপ সাধারণের বিশ্বাস আকর্ষণ করিতেছি তাহাতে অনতিকালের মধ্যে এ বিদ্যালয় আমাদের সাহায্যের অপেক্ষা রাখিবে না বলিয়া আশা করিতেছি | এই সময়ে আমি একজন কাহাকেও অন্বেষণ করিতেছি যিনি এই বিদ্যালয়টিকে সম্পূর্ণরূপে নিজের করিয়া লইবেন | জানি না , কি কারণে আপনার সঙ্গে পরিচয় না থাকিলেও আপনাকেই আমার চিত্ত এই কাজে বরণ করিয়া লইতেছে | ঈশ্বর যদি ইচ্ছা করেন তবে নিশ্চয়ই আপনি সমস্ত সঙ্কোচ ও চিন্তা দূর করিয়া দিয়া ধরা দিবেন – আপনি না আসিয়া কোনোমতেই থাকিতে পারিবেন না – আপনার পর্বত হইতে আপনি নদীর মত এখানে ছুটিয়া আসিবেন | আমার নিজের কাজ হইলে আমি আপনাকে এমন করিয়া ডাকিতে পারিতাম না | আমি যাহাকে মনে করিয়া ডাকিতেছি তাহার কাছে নিষ্কৃতি পাইবেন না | আমি পাবনা কনফারেন্সের কাজের অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও একটি বালকের কাছে আপনার কথা শুনিবামাত্র অত্যন্ত নিঃসংশয় চিত্তে তৎক্ষণাৎ আপনাকে আহ্বান করিয়া লিখিয়াছি – আমার আহ্বান কখনই ব্যর্থ হইতে পারে না |
ভবদীয়
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর