• Uncategorized
  • 0

গল্পেরা জোনাকি তে মৌমিতা চক্রবর্তী

ফটিকচাঁদ

ফটিকচাঁদ বৈদ্য | বয়স জানতে চাইলে বত্রিশ পাটি বের করে বলে-
— উনিশ | তবে মা বলেছে আরও কম। পনেরো কী ষোলো |
পনেরো , ষোলোর ঘাট পেরিয়েছে আজ প্রায় বারো বছর হলো | ওর বালোয়ারি ইসকুলের বন্ধুরা যে যার জীবিকা , সংসার নিয়ে ব্যস্ত | কাজ থেকে ফিরে মদনার মিষ্টির দোকানে তাসের আড্ডায় বসে প্রায় সকলে , ওর এসব বদ গুণ নেই | মা বকবেন যে ! মাতৃআজ্ঞা পালন করতেই সে জিন্দা হ্যায় | ওর বড়দি ফুলুরি দুই ছেলে চাঁদ, সূর্য- কে নিয়ে সসুরাল থেকে পা রাখলো মাইকেতে। কিন্তু ওর ব্ল্যাক বিউটি লেডিস বরটা আসেনি। হাম সাথ সাথ হ্যায় শপথ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা সরল দাশগুপ্ত- কে না দেখে একমাত্র শ্যালক ফটিক- এর সরলতর জিজ্ঞাসা–
— জামাইবাবু আসেননি বড়দি?
— এসেছেন। ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছি।
ঝাঁঝিয়ে উঠলো ফুলুরি–
— এলে তো দেখতেই পেতিস।
মা, মা বলে হনহনিয়ে ঘরে ঢুকছে বিন্দুবাসিনী’র মেয়ে কম, বেশি সখি। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মায়ের চোখের জল, নাকের জলে আঁচল সিক্ত হওয়ার দশা। স্নেহময়ী বললেন–
— আগে একটু জিরিয়ে নে তো। কতটা পথ দুটো বাচ্চাকে নিয়ে একা একা এসেছিস!
বাচ্চা! এরা তো চৌবাচ্চা! নবম-একাদশের জাপানি পুঁটি।
বিন্দুবাসিনী জগে করে জল নিয়ে আসতে বললেন ফটিক- কে, সঙ্গে গ্লাস। জল খেয়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বড়দির ভাষণ–
— আমি কেন এসেছি জানিস নিশ্চয়ই? এবার তোর বৌ না এনে বাড়ি ফিরবো না, শ্বশুর বাড়িতেও বলে এসেছি।
বউয়ের কথা শুনে লাজে রাঙা হয়ে উঠছিল হবু বর ফইটক্যা। পাড়ার সভ্যতাবিগর্হিত ছেলেছোকরারা এই নামেই ডাকে ওকে , সন্ধি বিচ্ছেদও করে, ফ গেছিলো আইটক্যা, তাই হইলো ফইটক্যা। সব শোনা কথা। কপিপুশির দল। রাগ করে না ফটিক। গুরুদেব বলেছেন, ক্রোধ, কৌতূহল, কামনা, কষ্ট সংবরণ করতে। এই জন্য ক জাতীয় অনেক কিছুই ও পরিত্যাগ করেছে। কলা খায় না, পুজোর সময় কাঁসর বাজায় না, আগে পোষা পায়রাদের চাল ছিটিয়ে ডাকতো– ‘আয়, আয়, আয় কবুতর, আয়।’
এখন আর এসব করে না। আজ সকাল থেকেই ব্যস্ত বিন্দুবাসিনী, সহযোগিতায় কন্যারত্ন ফুলুরি। ফটিকের আগমন আকাঙ্ক্ষাতেই শুরু করেছিলেন কার্তিক পুজো। ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ঠাকুর সু-পুত্র উপহার দিয়েছেন তাকে, তাই কার্তিক- কে তুষ্ট করা প্রধান এবং অন্যতম কর্তব্য বলে মনে করেন বিন্দুবাসিনী। এ নিয়ে পাড়ার অসুর প্রকৃতির ছেলেগুলো ফটিক- কে দেখেই ছড়া কাটতে শুরু করে দেয়।
— ‘ড্যাং ড্যাঙা ড্যাংলা
কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা
একবার আসেন মায়ের সাথে
একবার আসেন একলা।’
সঙ্গে বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি আর মুখে কু কু ধ্বনি। কিন্তু ফটিক এসব নিয়ে ভাবে না। কার্তিক ঠাকুরের সাথে যে ময়ূরটা আছে, তার কথা ভাবছে। সে যেন পেখম তুলে নাচছে আর বলছে– বিয়া হইবো ফইটক্যা তোর, আইতাসে নতুন ভোর।
নতুন ভোরে দুধ-সাগু খেয়ে পিতৃদেব দ্বারিকা এবং ছোটোকাকা সুদাম বৈদ্যের পায়ে পা মিলিয়ে ফটিক চললো স্টেশনের দিকে। পাত্রী দেখতে যাবে ছেলে, মায়ের জম্পেশ প্রস্তুতি। মা,মেয়ে উলুধ্বনি দিয়ে মঙ্গল ঘট বসালেন ঠাকুর ঘরে, ছেলের যাত্রা শুরু করার আগেই ঠাকুর- কে জল, বাতাসা সাজিয়ে দিলেন, চোখ খুলেই গুরুদেব- কে লাঞ্চ সেরে ফেলতে হবে। এবং দিনের বাকিটুকু সময় ক্ষুধা সহ্য করে ফটিকের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গুরুদেব হওয়া এতো সোজা!
পাত্রীর বাড়িতে গিয়ে কী বলতে হবে, ঠিক কতটুকু বলতে হবে, সব বড়দি পুনঃ পুনঃ বুঝিয়ে বলেছে। গাম্ভীর্য বজায় রেখে শুধু মাথা নাড়াতে হবে, কিন্তু কোন কথায় কিভাবে, সেটা দেখিয়ে দিতে হয়তো ভুলে গেছে। থুতু ছিটিয়ে, বাঁ হাতের কনিষ্ঠায় দাঁত ছুঁইয়ে দুর্জনের মুখে ছাই দিয়ে ছেলেকে রওনা করালেন মা।
উত্তর দিকটায় দুটো কাঠের চেয়ারে গুরুজনদ্বয়, দরজার মুখোমুখি পশ্চিম দিকে খাটিয়ায় ফটিক এবং পাত্রীর দাদা ভোলা। প্লেট ভরে মিষ্টি এলো। সাথে স্টিলের গেলাসে জল। আরেকটা থালায় ছাতু, চিড়ে, মুড়ির লাড্ডু। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ছাতুর লাড্ডু একাই সব আস্বাদন করে, কিন্তু মা, বড়দি বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, কোনো মূল্যেই হ্যাংলামো করা চলবে না।
পাত্রীর শুভ আগমন ঘটলো। ফটিক একবার আড়চোখে লক্ষ্মীর চরণদ্বয় দেখে এই যে ভূমি দর্শন করতে লাগলো, ওই বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে পর্যন্ত দু’নয়ন আড় হইলো, সিধা হইলো না।
ভোলা এবার গুরুজনদের উদ্দেশ্যে বললো–
— চলুন আমাদের চারটে পুকুর, ধান খেত, সবজি খেত, পলট্রির ফার্ম দেখে আসবেন। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলুক।
ক্যাবলাকে একা রেখে যেতে অনিচ্ছুক হলেও সৌজন্যতা রক্ষার্থে পাত্রপক্ষের গুরুজনদ্বয় বাধ্য হলেন পাত্রীপক্ষ- কে অনুসরণ করতে।
ঘর ফাঁকা হলে চেয়ার টেনে পাত্রের সামনে এসে বসলো পাত্রী। পাত্রের অবস্থা তথৈবচ। ক খ গ ঘ, মাথা নিচু করো গো। প্রশ্নোত্তর পালা নিজ দায়িত্বে শুরু করলো পাত্রী। কলা বিনুনিতে হলুদ ফিতা, শরীরের দৃশ্যমান অংশের তুলনায় অধিক ধবধবে মুখশ্রী, টকটকে লাল লিপস্টিক, কাজল দিয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দৈর্ঘ্যের নয়নযুগল, টিয়া পাখির কাছ থেকে ধার করা গাঢ় সবুজ রঙা শাড়ি, ফলিডল সমৃদ্ধ বেগুন রঙা ব্লাউজ পরিহিতা পাত্রী নিমকি।
— আপনার নেইম?
অষ্টম শ্রেণী অনুত্তীর্ণ হলেও কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা জানে বিন্দুবাসিনী’র পুত্র।
— আইজ্ঞা, ফটিক। ফটিক চাঁদ বৈদ্য।
— কোন সিরিয়াল সবচেয়ে বেশি লাইক করেন?
— আইজ্ঞা, মহাভারত।
— এমা, আপনি টিভি ওয়াচ করেন না?
— দেখি, যখন ওর গা পর্দা ঢাকা থাকে, তখন।
— তা ফুল ডে কী কাজ করেন?
এবার কাজের তালিকা দিতে লাগলো ফটিক।
— আইজ্ঞা গোয়াল পরিষ্কার, ঘুঁটে দেওয়া, মা- কে বাসন ধুয়ে দেওয়া, গরুর জন্য ঘাস কাটা, নদী থেকে ঘাসগুলো ধুয়ে আনা, বাতের ব্যথায় রাতে ঘুমোতে পারে না মা, তেল মালিশ করতে করতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ি। অনেক কাজ।
খুব বুঝলো নিমকি।
— ফেবারিট হিরো?
— আইজ্ঞা, ধৃতরাষ্ট্র।
চড়াক করে মাথায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পেলো নিমকির।
— কী! ও তো অন্ধ! হিরো হলো কবে?
— আইজ্ঞা, অন্ধ বলেই তো কোনো যুদ্ধে নাই।
— এই আপনি মহাভারত ছাড়া আর অন্য কিছু ওয়াচ করেন না?
— আইজ্ঞা না। মা বলেছে এসব দেখা ভালো নয়।
— শুনুন, বিয়ের পর আপনার ড্রেসিং ইস্টাইলটা পালটাতে হবে। আর মাথায় শিশি ঢেলে অয়েল দেওয়া চলবে না।
— আইজ্ঞা, আপনি যেভাবে বলবেন।
সংসার পরিক্রমার অদ্য সবেমাত্তর চতুর্থ দিন। ফুলশয্যায় ফুলের গন্ধ চরম সংকটে পৌঁছালেও গোবরের গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত টিপটপ নিমকি সুন্দরীর। প্রাণেশ্বরীর এহেন কষ্ট সইতে না পেরে ক্যাবলাচরন ফটিক ঘটিয়ে ফেললো স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। শূন্য গোয়াল ! না রইলো বাঁশ, না বাজবে বাঁশরী। নদী পেরিয়ে গরু বাহিনী পৌঁছে গেছে চোরাদের হাতে।
হায় হায় রব উঠলো বৈদ্য বাড়ির আকাশে-বাতাসে। চার রাতেই পর হয়ে গেলো কার্তিক ঠাকুরের কৃপায় প্রাপ্ত পুত্র! মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে গর্ভধারিণীর। অনিদ্রা বোধকরি এবার বিন্দুবাসিনী’র নিত্যসঙ্গী হলো।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।