সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ২৪
by · Published · Updated
অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক
আমরা কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শিখি ? নিশ্চয় না | আমরা কি শুধু মানুষের কাছ থেকে শিখি ? নিশ্চয় না | তাহলে আমরা কতভাবে শিখতে পারি ? সুনির্মল বসুর কবিতার লাইন এ’ক্ষেত্রে যথাযথ উত্তর হতে পারে – “বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র |”
আমরা প্রধানত দুভাবে শিখতে পারি | একটি – প্রতিষ্ঠানগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক অন্যটি অপ্রাতিষ্ঠানিক | আমরা এই প্রবন্ধে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব |
সুনির্মল বসুর কবিতা দিয়েই শুরু করি | স্কুলজীবনে আমরা সবাই পড়েছি , ভালোবেসেই পড়েছি | ভালোবাসাটা এখন চলে যায়নি | তাই পুনরুল্লেখ বিরক্তির কারণ ঘটাবে না ধরে নিয়েই প্রতিশ্রুত কর্মে মনোনিবেশ করি | কবি কবিতাটিতে এগারো জন শিক্ষকের নামোল্লেখ করেছেন | ‘আকাশ’ দিয়েছে উদার হবার শিক্ষা , কর্মী হবার মন্ত্র পাওয়া যায় ‘বায়ুর’ কাছ থেকে , ‘পাহাড়ের’ শিক্ষা মৌন-মহান হবার , দিলখোলা হবার শিক্ষা দেয় ‘খোলা মাঠ’ , ‘সূর্যের’ মন্ত্রণা আপন তেজে জ্বলা , হাসতে মধুর কথা বলার শিক্ষা দেয় ‘চাঁদ’ , রত্নাকর হবার শিক্ষা ‘সাগরের’ কাছ থেকে পাওয়া যায় , ‘নদী’ শেখায় আপন বেগে চলতে , ‘মাটি’ র শিক্ষা সহিষ্ণুতা , ‘পাষাণের’ দীক্ষা আপন কাছে কঠোর হওয়া , প্রাণে গান জাগায় ‘ঝরণা’ , ‘শ্যামবনানীর’ শিক্ষা সরসতা | এরা কেউই স্কুল ,কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নন – এরা সব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক | স্বামীজি প্রার্থনা জানাচ্ছেন : “হে গৌরীনাথ , হে জগদম্বে , আমায় মমুষ্যত্ব দাও ; মা আমার দুর্বলতা কাপুরুষতা দূর কর , আমায় মানুষ কর |” মানুষ হবার শিক্ষে এরা খুব ভালোভাবে দেয় | কিভাবে ?
নবম শ্রেণিতে উঠলাম | নতুন সংযোজন ভাবসম্প্রসারণ | যাদের ভাবের তেমন বাড়বাড়ন্ত নেই তাদের কাছে ব্যাপারটা মতেই চলে | আর যাদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি একটু আধটু প্রীতি আছে তাদের কাছে ভাবসম্প্রসারণ ব্যাপারটা – বড়লোক হওয়ার জন্য পরিশ্রম করায় যে আনন্দ – কতকটা সেই রকম | সাহিত্যে বড়লোক হওয়ার চেষ্টা | যাই হোক একটা ভাবসম্প্রসারণ ছিল এই রকম :
“প্রাচীরের ছিদ্র এক নামগোত্রহীন
ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন |
ধিক ধিক করে তারে , কাননে সবাই ,
সূর্য উঠি বলে তারে ভালো আছো ভাই ? “
ওপরের ভাবসম্প্রসারণটিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের শিক্ষাটা ঠিক এইরকম – ‘বসুধৈব কুটুম্বকম |’ এই লোক আত্মীয় , এই লোক পর – এই ভেদ বুদ্ধি রহিত | সূর্য যেমন পুষ্প সমাজে অপাঙক্তেয় , বাত্য তাকেও কিরণ দেয় ; আবার বাগানের দামী গোলাপটিকেও অনুরূপ কিরণই দেয় | জল , বায়ু সকলেরই সেই একই কথা , “গাহি সাম্যের গান |” জলতো কখনো বলে না শুধু পুণ্যবানেরাই আমাকে ব্যবহার করে করবে আর পাপী তাপীরা আমাকে স্পর্শ করবে না | বায়ুতো পাপী- পুণ্যবান , চোর-সাধু , ধনী-গরীব সকলেরই ফুসফুসে জ্বালানী সরবরাহ করে চলেছে | এদের স্বভাবটা কেমন ? তুলসী দাসের দোঁহাবলীতে এর যোগ্য উপমা লিপিবদ্ধ আছে | “সজ্জন চিত কবহঁ ন ধরত দুরজন জনকে বোল | পাহন মারে আম কেউ তউ ফল দেত অমোল ||” অর্থাৎ হাজার কষ্ট পেলেও সজ্জন কখনও অন্যায় আচরণ করে না | আম গাছে ঢিল ছুঁড়লেও আম গাছ যেমন ঐ অনিষ্টকারীকে সুমিষ্ট ফল দান করে তৃপ্তি দেয় অনুরূপ সজ্জনগণও কখন শত্রু-মিত্র ভেদাভেদ করে না সকলেই তার কাছে সমান আদরণীয় |
সমস্ত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটাই – “মানুষ মানুষের জন্য |” শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথায় , “এসে দাঁড়াও ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে দাঁড়াও মানুষ বড়ো কাঁদছে , তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও মানুষ বড়ো একলা , তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও |”
পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আর একটি বিশেষ কাজ হলো বিবেকানন্দের ভাষায় – character form( চরিত্র তৈরি ) | শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে অবধূতের যে চব্বিশজন অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকের কথা জানা যায় তাদের শিক্ষায় চরিত্র তৈরির শিক্ষাটি খুব ভালোভাবে পাওয়া যায় |
অবধূতের প্রথম শিক্ষক পৃথিবী | কত আঘাত , কত উৎপাত পৃথিবীকে সহ্য করতে হয় | এর জন্য পৃথিবী সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায় না | শ্রী শ্রী মা সারদা প্রায়ই বলতেন , “পৃথিবীর মতো সহ্যগুণ চাই |” কেন সহ্য দরকার ? যে সয় সে মহাশয় , যে না সয় সে নাশ হয় |
দ্বিতীয় শিক্ষক বায়ু | পৃথিবীর নানা স্থান নানা গন্ধ যুক্ত | কোথাও সুগন্ধ আবার কোথাও দুর্গন্ধ | বায়ু গন্ধ বহন করলেও গন্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকে না | সে কারো গুণ বা দোষের সম্মুখে আত্মসমর্পণ করে না , কারো প্রতি আসক্তি বা দ্বেষে যুক্ত হয় না | এই নির্লিপ্ততা বায়ু গুরুর শিক্ষা | যেমন বড়লোক বাড়ির দাসী বলে , ” ‘আমার রাম’ , ‘আমার হরি’ কিন্তু মনে বেশ জানে এরা আমার কেউ নয় |” ( কথামৃত )
তৃতীয় শিক্ষক আকাশ | আগুন লাগে , বৃষ্টি হয় , অন্নাদির সৃষ্টি ও বিনাশ , বায়ুর দ্বারা মেঘাদি আসে ও চলে যায় | এই সব ঘটনার পরেও আকাশ কিন্তু অসংলগ্ন থেকে যায় | এই অপূর্ব নিঃসঙ্গতা আকাশ গুরুর শিক্ষা |
চতুর্থ শিক্ষক জল | জলের স্বভাব সম্বন্ধে ‘শ্রীমদ্ভাগবতে’ বলা হচ্ছে , “স্বচ্ছঃ প্রকৃতিতঃ স্নিগ্ধো মাধুর্যস্তীর্থভৃর্নৃণাম |” অর্থাৎ জলের স্বভাব – স্বচ্ছ , স্নিগ্ধ , মধুর ও পবিত্রতা প্রদান | জল থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী ব্যক্তি কেমন হবে ? -“মিত্র মীক্ষোপস্পর্শকীর্তনৈঃ |” ব্যক্তিটি নিজ দর্শন , স্পর্শন ও নাম উচ্চারণের দ্বারাই সকলকে পবিত্র করে দেন |
অগ্নিগুরুর শিক্ষা হলো সাধন রহস্য | “তেজস্বী তপসাদীপ্তো দুর্ধর্ষোদরভাজনঃ |” ‘তেজস্বী’ – তেজ যুক্ত | ‘তপসাদীপ্তো’ – জ্যোতির্ময় এবং অন্যের তেজের প্রভাব তাঁর উপর পড়ে না | আর কী ? “সর্বভক্ষোহপি মুক্তাত্মা নাদত্তে মলমগ্নিবৎ |” – সর্ব বস্তু গ্রহণ করার পরেও গ্রহণীয় বস্তুর দোষে লিপ্ত হয় না | অর্থাৎ অগ্নি গুরু থেকে শিক্ষা নেওয়া ব্যক্তি বিষয়ের উপভোগ কালে নিজের মন ও ইন্দ্রিয় নিচয়কে নিজের বশে রাখে এবং সেই সঙ্গে অপরের দোষের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে |
চন্দ্রগুরু আমাদেরকে শিক্ষা দেন ক্ষয় বৃদ্ধি দেহের ধর্ম , আত্মার নয় | শুক্ল প্রতিপদ থেকে প্রতিদিন চন্দ্রের এক একটি কলা বৃদ্ধি পায় | আবার কৃষ্ণ প্রতিপদ থেকে এক একটি কলা হ্রাস পায় | এই ক্ষয় বৃদ্ধি মূলত চন্দ্রের নয় | অনুরূপভাবে জন্ম হতে দেহ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং পূর্ণ যৌবনের পর আবার ক্ষয় হতে শুরু করে | এই ক্ষয় বৃদ্ধি দেহের ধর্ম – দেহীর নয় | চন্দ্রগুরু আমাদেরকে বলছেন, “হে মানবকুল দেহের ক্ষয় বৃদ্ধিকে প্রকৃত স্বরূপ ভেবো না |” – “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ | অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমান শরীরে || – এই স্বরূপ বিশিষ্ট আত্মাই আমাদের আত্মস্বরূপ | ” ( গীতা )
চলবে
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন