দরদী
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ‘ প্রবন্ধে বলেছেন , ” এখানে প্রত্যেক ছাত্রের মনের উপর শিক্ষকের প্রাণগত স্পর্শ থাকবে , তাতে উভয়পক্ষেরই আনন্দ | “এটাকে ছাত্রদরদ বলেই বুঝতে হবে | পেষ্টালৎসীর ভাষায় , ” ……my head lay on their hand, my eye rested on their eye . My tear flows with theirs and my smile accompanied drink was mine . I had nothing , no house- keeping , no friend , no servants ; I had them alone . “
রবীন্দ্রনাথ বোধহয় স্বয়ং এর উদাহরণ | ‘ ঠাকুর বাড়ির গল্প ‘ শিরোনামে পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বেশ কিছু লেখা ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল সংবাদ পত্রিকায় | বিষয় নির্ধারিত ও নির্বাচিত তারই কিছু অংশ – ” আশ্রম অধ্যক্ষ ভূপেন্দ্রনাথ স্যানালকে জোড়াসাঁকো থেকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ,” স্নানের পর ঠাণ্ডা লাগানো কোনো মতেই হিতকর নয় , ….. তেল মেখে জল ঢালতে অহেতুক যেন দেরি না করে , শীতের হাওয়ায় খোলা জায়গায় তেল না মাখিয়ে বদ্ধ ঘরে তেল মাখাতে হবে | ……ঝম ঝমানো প্রবল বৃষ্টিতে কবি আশ্রমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলেছেন | এলোমেলো হাওয়ায় ভিজে জবজবে , সপসপে পোশাকে কোথায় চলেছেন কবি | হেমলতার ( দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্রবধু ) বুঝতে অসুবিধে হয়নি | ওদিকে ছাত্রাবাস , ছেলেরা ভিজে গেল কিনা দেখতে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ | বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল , ঘুম ভাঙতেই হয়তো কবির মনে হয়েছে ছাত্রাবাসের খড়ের চাল দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ছে , ভিজে যাচ্ছে ছেলেরা , তাদের নিরাপদ জায়গায় রাখতে গিয়েছিলেন কবি | “
কবি শঙ্খ ঘোষের স্মৃতি চারণায় এইরকম এক ছাত্র দরদী শিক্ষকের কথা উঠে এসেছে | কবি জানিয়েছেন তাঁর এক অপ অভ্যাস ছিল পরীক্ষা ঘরছেড়ে পালানো | চতুর্থ বর্ষে উঠার আগে কলেজের যে বার্ষিক পরীক্ষা সেইপরীক্ষায় বন্ধুদিকে বসিয়ে দিয়ে নিজে কলেজ স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোড়ের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ঠিক পরবর্তী ভবিষ্যত ভাবছেন | এমন সময় পিঠের উপর কারো একটি হাত | কবির ধারণা কোনো বন্ধু | কিন্তু না | অধ্যাপক দেবীপদ ভট্টাচার্য | শক্ত গলায় বললেন , “তুমি এইখানে কি করছ এখানে দাঁড়িয়ে ? সব জায়গায় আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাকে | চলো , চলো শিগরির কলেজে | “
পরের ঘটনা টুকু কবির ভাষায় – “আমি কিছুতেই যাব না আর উনি কিছুতেই ছাড়বেন না | টানতে টানতে নিয়ে চলেছেন , অনিচ্ছুক আমাকে , পথচারীরা সকৌতুকে দেখছে সেই দৃশ্য | কলেজে পৌঁছে , তিন তলায় উঠে , পরীক্ষা ঘরের প্রহরারত অর্থনীতির সদ্য আগত তরুণ অধ্যাপক তাপস মজুমদারকে বললেন , ‘একটা খাতা আর প্রশ্নপত্র দাও তো একে |’ তখন এক ঘণ্টা হয়ে গেছে এবং তরুণ অধ্যাপকের ক্ষীণ প্রতিবাদ কিছুই ধোপে টিকল না |”
ঘটনার মূল্যায়ণে কবি নিজেই বললেন : “একটি ছেলে কোনো পরীক্ষা দিল কি দিল না , এতটাই কী আসে যায় তাতে , একজন মাস্টারমশাইয়ের ? সেইজন্য কি পলাতক ছাত্রের খোঁজে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারেন কেউ ? এটি নিছক কর্তব্যবোধ , না হৃদয়ের টান ? “
আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব | ক্ষিতিমোহন সেনের ছাত্র সুব্রত | নবদ্বীপের ছেলে | একসময় বাড়ি থেকে অর্থ আসা বন্ধ হয়ে গেল | কিন্তু ক্ষিতিমোহন তাকে ফিরে যেতে দিলেন না | নিজের পরিবারে সন্তানের মতোই রেখে দিলেন | শুধু তাই নয় ছুটির সময়ে সে ক্ষিতিমোহনের তিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে ভাইয়ের মতো থাকত |
” আশ্রমের রূপ ও বিকাশ ” প্রবন্ধের আর এক জায়গায় কবিগুরু বলছেন , ” গুরুর অন্তরের ছেলে মানুষটি যদি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তা হলে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য হন |” বড়ো সত্যি কথা | শিক্ষককে ছাত্রদের বন্ধু হতে হবে | রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – স্বশ্রেণীর জীব , প্রাগৈতিহাসিক মহাকায় প্রাণী নয় |
অধ্যাপক প্রদীপ নারায়ণ ঘোষ তাঁর শিক্ষক সাহিত্যিক বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধুত্বের দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন | শিক্ষক মহাশয় ছাত্রটির চেয়ে বছর পনেরোর বড়ো হলেও অনেক বিকেলে দু’পয়সার চিনাবাদাম কিনে ছাত্রবন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে হাঁটতেন | এ’রূপ একটি ঘটনা অধ্যাপক প্রদীপ নারায়ণের স্মৃতিকথায় , ” আনোয়ার শাহ রোড় ধরে যাওয়ার পথে পড়ত একটা মিষ্টির দোকান , ‘ মান্নার খাবার ‘ | তার পুরানো সাইন বোর্ডে লেখা থাকত ‘ খেয়ে ও খাইয়ে সমান তৃপ্তি | ‘ আমি একবার বললাম , ” স্যার লেখাটা বেশ অর্থবহ | ” বরেনবাবু ইঙ্গিত বুঝে বললেন , ‘ও তোরা কিছু খেতে চাস | ‘ তখনই কয়েকটা জিলিপি কিনে বাড়ি নিয়ে যেতেন | “
“আমি অকৃতি অধম বলে ও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি | ” শিক্ষকের প্রতি এইরকম ছিল ছাত্রের সশ্রদ্ধ স্বীকারোক্তি | কবি- প্রাবন্ধিক – গীতিকার পল্লব মুখোপাধ্যায় যে শিক্ষকের প্রতি এই বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তিনি একজন জার্মান দিদিমণি | নাম – সুজান স্যারিয়্যাফে | ঘটনার বর্ণনা করি কবি পল্লব মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় – ” লাস্ট ট্রাইমেস্টারের বৈদ্যুতিন বিপণনের ফাইনাল প্রজেক্টের ড্রাফট জমা দেবার দিন সময় ঠিক হল | রাত এগারোটা ঊনষাটের পরে ইন্সটিউটের ইণ্টারনেটে কোনো ড্রাফট পেপার ঢুকলে দশ শতাংশ নম্বর কাটা যাবে |
আমার টাইপিং স্পিড খুব কম | আমি অনুরোধ করেছলাম বয়স, পেশাগত অনভ্যাসকে মাথায় রেখে যদি কয়েক ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় দেওয়া যায় | উনি ক্লাসের সবাইয়ের মতামত নিয়ে রাত এগারোটা ঊনষাটের জায়গায় একটা ঊনষাট অবধি সময় দিলেন | পরের দিন সকাল বেলায় প্রথম ক্লাসে ঢোকার মুখে বললেল- তুমি ভালোই লিখেছ | আমি লাঞ্চে তোমার সাথে কথা বলব বলে আমাকে ড্রাফটের পুরো সাড়ে সাতশো পাতার প্রিণ্ট আউট দিলেন | ফাঁকে ফাঁকে দেখেছি প্রত্যেক পাতায় উনি সংশোধন করেছেন | রাত দুটোয় পাওয়া সাড়ে সাতশো পাতার মেল অনুপুঙ্খ পাঠ করে সংশোধন করে ছোটো ছোটো দুই সন্তানের জননী ষাট মাইল গাড়ি চালিয়ে সকালের ক্লাস নিতে এসেছেন | তাও একমুখ হাসি নিয়ে | “
ঘটনাটিকে কী বলা যেতে পারে ছাত্রদরদ , নিষ্ঠা , কর্ত্তব্য , সংবেদনশীলতা ?
( চলবে )