ব্যক্তিগত ঝুলবারান্দায় নিত্যদিন দোল খাওয়া
হলদে ঝুটিওয়ালা পাখিটিকে
ইদানিং আর কোথাও দেখিনা
খুঁজেছি অনেক
ভাবলেশহীন ভর দুপুরে
মন খারাপের বিষন্ন বিকেলে
এমনকি কোজাগরি জোৎস্নায়
না কোথাও চিহ্ন মাত্র নেই
নিন্দুকেরা হয়তো বলবে ছিল নাকি কখনো
আরও ভালো করে খুঁজে দ্যাখো
হাইওয়ের পাশে দখল হয়ে যাওয়া ধানক্ষেতে
হঠাৎ হাঁটু গেঁড়ে বসা স্বপ্ন প্রকল্পের খালি জায়গায়
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কর্তিত বৃক্ষের পড়ে থাকা অপাঙ্ক্তেয় ডালে
অথবা অভিমানী চ্যাটবক্সের ডিলিট করে দেয়া মেলোড্রামাটিক মেসেজে
পাখিটা আমার ওপরে না জানি রাগ করে অকষ্মাৎ দানাপানি খাওয়া ছেড়ে দিলো কিনা
ভীষণ শান্ত আর নির্বিবাদী বলেই তো জানতাম এতদিন
মানুষের অনায্য কোনো আচরণে হয়তো সে প্রবল প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে
যেভাবে ভাষা কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের প্রশ্নে বিক্ষুব্ধ রাজবন্দি মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও ঔপনিবেশিক কারাগারে আমরণ অনশনের কৌশল বেছে নেয়
অবলীলায়
নাকি -এই আষাঢ়ে জবুথবু হয়ে নীড় খুঁজে ফিরছে
অন্য কোনো হরিৎ হৃদয়ারণ্যে…
২| আমি সত্যিসত্যিই হারাবো একদিন
আমি সত্যিসত্যিই পালাবো একদিন
চন্দ্রাবতীর মৃণাল বাহুপাশ ছিঁড়ে;
ময়ুরাক্ষী আকাশের নিরালোক প্রান্তরে,
হারাবো, কোটালের কুটিল পাতা থেকে নামগন্ধহীন;
হতোদ্যম হাবল দূরবীন আর গুগল মানচিত্রের
স্থানাঙ্ক পেরিয়ে।
আমার কারণে যদি কারো হৃদয়ালিন্দে
সুতীব্র ঘাই মারে কাঁটাওয়ালা জলজ্যান্ত জিওল মাছ,
ছাই দিয়ে হাতেনাতে ধরা হোক অনতিবিলম্বে সেই ছদ্মবেশী অনুপ্রবেশকারীকে।
আমি একদম চাইনা আমার জন্য প্রেরিত শোকবার্তা, ছিটেফোঁটা সাহিত্যকর্মের প্রশস্তিগাঁথা, বন্ধুবান্ধবদের রচিত নিবেদিত সব কবিতা ফলাও করে ছাপা হোক পছন্দের প্রতিটি দৈনিকে, সাহিত্য সাময়িকী আর লিটল ম্যাগাজিনে ;
তবে গণবিনোদনের মহানব্রতে চাঞ্চল্যকর আরেকটি নতুন ঘটনার জন্ম না হওয়া অবধি আমার একান্ত ব্যক্তিগত পত্রাবলি, ডাইরীর ছেঁড়া পৃষ্ঠা, আড়িপাতা ফোনালাপ কিংবা গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত খিস্তি খেউড় অথবা রগরগে দৃশ্যাবলির অভব্য কাটপিস ভাইরাল হোক সোশ্যাল মিডিয়ায়, প্রচারিত হোক প্রতিটি টিভি চ্যানেলের মারমুখী টকশোতে এবং সচিত্র কেচ্ছাকাহিনীসহ চাররঙা ট্যাবলয়েড পত্রিকার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায়।
অধিকন্তু, আমার জন্য যদি নিভৃতে কারো চোখে সত্যিসত্যিই জল আসে,
খুব করে চাইছি এখনই নেমে আসুক সে জলের অবিশ্রান্ত প্রপাত শ্রাবণধারায়
৩| ছোট ছোট লোকমার দুঃখগুলো
সুলোচনা –ছোট ছোট লোকমায় তোমার দেয়া দুঃখের মহার্ঘ সঞ্চয়গুলোই আমাকে প্রতিনিয়ত
বেজোস, বাফেট কিংবা গেটসের চাইতেও
ঐশ্বর্যশালী করে চলেছে ;
আর সেকারণেই তোমার মৃণাল বাহুপাশে নিজেকে জড়িয়ে রেখে ঈজিয়ান সাগরের তীরে স্যান্টোরিনির সুর্যাস্ত দৃশ্য অবলোকনের স্বপ্নসাধ লালন করার চাইতেও মীর মশাররফ এর বিষাদসিন্ধুর জলভাগে নিশ্চুপ অশ্রুপাত অধিকতর শ্রেয় মনে হয়।
সুলোচনা– তোমার নিপাতনে সিদ্ধ নৈয়ায়িক নিরুত্তাপ ভালোবাসা এই আমাকে
গড়চাপড়ার চালচুলোহীন মৌসুমী জাদুকর ফৈজদ্দির পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে;
অথচ দেখো তোমার উৎকেন্দ্রিক উপেক্ষার প্রতিটি প্রহর যন্ত্রণাদায়ক না হয়ে ক্রমাগতভাবে অনন্যকুশল উৎপ্রেক্ষায় রূপান্তরিত হচ্ছে ।
ভালোবাসার কাঙাল হয়তো ছিলাম এতোদিন না বুঝেই–
সুলোচনা বিশ্বাস করো– আমি তোমার ছোট ছোট লোকমায় দেয়া দুঃখগুলোর জন্য দারুণ ক্ষুধার্ত থাকি নিশিদিন.…
৪| প্রত্যাখ্যান
আকষ্মিক প্রত্যাখানের এক বেদনাবিধুর প্রেক্ষাপটে
অপ্রস্তুত আমি একদম দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিলাম
প্রবল ঘুর্ণিঝড়ে ভূপাতিত সুবিশাল বৃক্ষের মতোই
প্রাগুক্ত মনখারাপের দগদগে ক্ষতে মলমের
প্রলেপ লাগানোর জন্য সেদিন কিন্তু কেউই ছিলনা আমার চতুর্পাশে
লোকমুখে খানিকটা শুনে আর বাকিটা আমার বিষাদাক্রান্ত মুখের ত্রিকোণমিতি থেকে অনুমান করে
স্থিতধী কবি বলেছিলেন -প্রত্যাখ্যাত হওয়া কিন্তু
একপ্রকারের সফলতাই
তাঁর প্রাজ্ঞ বিবেচনায় একপাক্ষিক ভালোবাসার অযাচিত প্রাপ্তি আর মোহান্ধ সুখের মৌ মৌ সৌগন্ধের চাইতেও নাকি
প্রবঞ্চনার প্রসাদরূপে আপতিত বর্ণগন্ধহীন ম্যাড়মেড়ে দুঃখ
শিল্পের জন্য ঢের বেশি প্রাসঙ্গিক ও হৃদয়স্পর্শী
আর তাই প্রত্যাখ্যাত দুঃখের মর্মরে গড়া শিল্পসুকৃতির আবেদন
পত্রপুটে টলায়মান শিশিরকণার মতো ক্ষীণায়ু জীবৎকালের মধ্যে পরিব্যপ্ত না থেকে
অমরত্বের অন্বেষায় প্রতিনিয়ত শামিল হচ্ছে মহাকালের আনন্দমিছিলে….
৫| আমার কিছু কথা আছে
ছাতাপড়া কালচে পাথরের গায়ে ফুটে থাকা নাম না জানা নীলচে বেগুনি ফুলেদের কাছে আমার কিছু কথা আছে;
শেষবার সুবর্ণ এক্সপ্রেসে তোমায় তুলে দিতে গিয়ে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে জানালার ধারে যে কথাটি বলতে শুরু করে আর শেষ করতে পারিনি — ঠিক সে কথাটি নয়;
গণমাধ্যমে প্রত্যহের মুখোমুখি আলাপানুষ্ঠানে আনুগত্যের তুলাদণ্ডে মাপজোখ করে যেসব ওজনদার কথা বলা হয়ে থাকে- উঁহু সেসব কথাতো নয়ই;
এমনকি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংলাপ কিংবা বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক ফোরামে অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ অথচ অমীমাংসিত কিছু ইস্যু রয়ে গেছে -না না সেসব বিষয়েও নয়;
প্রতিদিনের আসা যাওয়ার পথের ধারে পড়ে থাকা পাথরের গায়ে সবার অলক্ষ্যে ফুটে থাকা বেদনার্ত বেগুনি ফুলগুলোর সঙ্গে আমার বহুদিনের জমে থাকা বেশ কিছু দরকারি কথা আছে।