ক্যাফে গল্পে মৌসুমী

নিউ – নর্মাল ডায়েরি

সেদিন বিশুদাকে জিজ্ঞাসা করলাম , এই যে চারদিকে এতো নিউ – নর্মাল লাইফ বলে রব শুনছি , এটার ঠিকঠাক মানেটা কি বলতে পারো ?
বিশুদা মুখটা খাট্টা করে বললেন , ” সাধে কি তোকে মুখ্যু বলি ? নিউ – নর্মাল মানে হল , আমাদের মহামান্য সরকার বাহাদুর বলছেন , তোমাদের একটা নর্মাল লাইফ দিলাম , তোমরা সেটা বরণ করে নিও |
— কোথায় নর্মাল লাইফ বিশুদা ?
— আরে , কি বেইমান রে তুই ? সমস্ত অফিস কাছারি খুলে গেলো , বিনা মাস্কে বিয়েবাড়ি গিয়ে গান্ডেপিন্ডে গিললি , রাস্তায় দাঁড়িয়ে মৌজে সিগারেট টানলি , সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ভুলে গিয়ে রকবাজদের মত বন্ধুবান্ধবের গলা জড়িয়ে হ্যা হ্যা করলি , সব ভুলে গেলি ?
— তা , এখন তো চতুর্গুণ বেগে কোভিড অ্যাটাক হচ্ছে ……
— হবেই তো ! সরকার কি বলেছে , নিউ নর্মালের ফলটাও সরকার দেবে ? এখন রাস্তায় হাঁটতে গেলে লোকের মুখে মাস্ক দেখতাম না , পায়ের নিচে হরদম মাড়াতাম ! সরকার হ্যাজ নো রেস্পন্সিবিলিটি , নিজের থুতু নিজে বুঝে নাও | দরকার হলে রাস্তা থেকে চেটে তোলো |
আমি বাজার করে ফেরার পথে বিশুদা আর অমলদার আলাপচারিতার অল্প অংশ শুনে এলাম…… বিশুদা তো ঠিকই বলেছেন ! ” নিও নর্মাল “….. অর্থাৎ , নর্মাল দিলাম , নিও | না নিতে পারলে সেটা দাতার দোষ না গ্রহীতার দোষ ?
বাড়ি এসে সিঁড়ির নিচে জুতোটা ছাড়তে না ছাড়তেই মা হৈ হৈ করে ওঠেন ……
— থলিগুলো সিঁড়ির নিচে রাখ ! একদম সিঁড়ির রেলিং ধরবি না ! জামাকাপড় শুদ্ধু বাথরুমে ঢোক …… একবারে চান করে জামাকাপড় কেচে বেরোবি !
এই কথাগুলোই আমি গত এক বছর ধরে পাখিপড়া করে বলে বলেও মা বা ছোটকাকুকে দিয়ে করাতে পারিনি | মায়ের তো নিজের মাস্কও ছিলো না , কোথাও পরতে বাধ্য হলে আমার বা কাকার মাস্ক ….. যা হাতের কাছে পেতেন , সেটাই গলিয়ে নিতেন , আর একটু পরেই “ওরেব্বাস , দম বন্ধ হয়ে আসছে ‘ বলে সেটিকে জর্দা আর পানপরাগের সাথে থলিতে পুরতেন | নিও নর্মাল লাইফ আমার মাকেও সচেতন করে তুলেছে , এ কি চাট্টিখানি কথা ?
জামাকাপড় সমেতই শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ি | সাবান এমনভাবে মাখি , যাতে আমার জামা আর আমার দেহ , দুটোই একসাথে জীবাণুমুক্ত হয় | কে বার বার আলাদা করে জামাকাপড় কাচবে বাপু ?
পরদিন সকালে দেখি , ড্রইংরুমের টেবিলের ওপর চারটে স্যানিটাইজারের শিশি….. রোমান্টিক নীল , শিহরণ জাগানো সবুজ , মনভোলানো গোলাপি আর বর্ণহীন জলের মত | মা নিজে জাল পাতা শিকারীর মত ওঁৎ পেতে বসে |
প্রথমেই জালে পড়লো আমাদের রান্নার লোক | বেচারি ডবল মাস্ক পরে সাইকেল তালা মেরে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা ঝাঁপিয়ে পড়েন ……
— এ্যাই …… মুখের মাস্কটা খোল ….. সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখ |
রেখেছিস ? এবার বাইরের কলে গিয়ে হাত পা ধো !
বেচারি আকস্মিক আক্রমণে এমনিতেই থতমত খেয়ে গিয়েছিলো , বাক্যব্যয় না করে মাস্ক সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে হাত পা ধুতে গেলো | এই অর্ডার ওর কাছে নতুন | এর আগে আমি বলে বলেও এই অভ্যাসটা চালু করতে পারি নি | কিছু বললেই মা ঝাঁঝিয়ে উঠতেন ….. কেন , ও তো হাত ধুচ্ছে …. সাইকেলে আসে , আবার পা ধোয়ার কী আছে ? তোর সব বেশি বেশি …..
হাত পা ধুয়ে আসার পর মা গোলাপি স্যানিটাইজারের শিশিটা এগিয়ে দেন |
— নে , এটা ভালো করে দু হাতে রগড়ে রগড়ে মাখ | তার পর ওই যে ম্যাক্সিটা রেখেছি (তাকিয়ে দেখি , আমারই একটা ভালো ম্যাক্সি মা দানছত্র করছেন ) ওটা পরে নিয়ে রান্না করবি , রান্না হয়ে গেলে ওটা ছেড়ে বাইরের দড়িতে মেলে রেখে যাবি |
এখানেই শেষ নয় ….. মা একটা নতুন মাস্ক বাড়িয়ে দেন |
— রান্নার সময়ে এটা পরে রান্না করবি , যাওয়ার সময়ে ওটা ওই ম্যাক্সিটার সাথে ছেড়ে রেখে যাবি , এখানে এসে আবার ওগুলো পরবি |
বুঝলাম , এটাই নিও – নর্মাল লাইফ | সেই সাথে এটাও বুঝলাম , ওই বর্ণহীন স্যানিটাইজারটা হল লাইফবয় | বাড়ির মেম্বারদের জন্য | গোলাপিটা রান্নার লোক আর বাসন মাজার লোকের জন্য , সবুজটা মিটার দেখতে আসা লোকের জন্য , আর নীলটা সবজিওয়ালা , মাছ ওয়ালার জন্য | আমার আর ছোটকাকুর পকেটে বা ব্যাগে সব সময়েই স্যানিটাইজারের শিশি থাকে , কিন্তু মা ওগুলোকে পাত্তা দিতে নারাজ |
এর পর আমাদের বাড়ির ছবিটা হল এইরকম ……
রান্নার লোক বাড়িতে ঢুকে আপাদমস্তক স্যানিটাইজ করে আমার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আমার কালো সাদা ফুলছাপ ম্যাক্সি পরছে , বাসন মাজার লোক আপাদমস্তক স্যানিটাইজ করে আর একটা ঘরের দরজা বন্ধ করে আমার লাল খয়েরি ডোরাকাটা ম্যাক্সি পরছে , কাজের শেষে সেগুলো আবার ধুয়ে বাইরের তারে মেলে দিয়ে যাচ্ছে | দেখে আমার বুকটা হু হু করে উঠছে ! ওই ম্যাক্সি দুটো আমার বড় প্ৰিয় ছিলো | কিন্তু সে কথা মাকে কে বোঝাবে ? পেটের ঝিয়ের থেকে বাড়ির ঝি যে অনেক বেশি মূল্যবান , এই সার সত্যটা যে মা বুঝে গেছেন !
প্রতি বৃহস্পতিবার মায়ের তবলচির সাথে রেওয়াজ করার দিন | এ যাবৎ দেখেছি , উনি ডবল মাস্ক পরে আসেন , এসে সোজা দোতলায় উঠে যান , মা তানপুরা নিয়ে রেডি থাকেন , ঘন্টা দেড়েক জোরদার রেওয়াজের পর উনি বিদায় নেন | এমনই এক বৃহস্পতিবারের আগে মা খুব চিন্তিত মুখে ছোটকাকুর কাছে গেলেন |
— সমীর …… এই যে এতো করোনা বাড়ছে , গৌতমকে (বেচারি তবলচি ) বারণ করে দিই আসতে ? ও তো সেই বালি থেকে অটো , টোটো তে আসে ……
ছোটকাকু আর কি বলবেন , “বারণ করে দাও ” ছাড়া ?
সেই বৃহস্পতিবার গৌতম বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মা হাঁ হাঁ করে উঠলেন ……
— বাথরুমে যাও , বাথরুমে যাও …… হ্যান্ডওয়াশ আছে , ভালো করে হাত ধোও , পা ধোও !
সে বেচারি এই অতর্কিত আক্রমণে থতমত | এতদিন ধরে আসছে , মা কোনোদিন ওঁকে হাত পা ধুতে বলেন না |
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মা বললেন , তোমার সাথে একটু কথা আছে , বোসো |
সোফায় বসার পূর্বমুহূর্তে মা আবার হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন …..
— দাঁড়াও , দাঁড়াও !
তবলচি আধবসা অবস্থায় স্থাণু হয়ে যান | মা কোত্থেকে একটা পুরোনো ছেঁড়া পর্দার কাপড় এনে সোফায় বিছিয়ে দিয়ে বলেন …… এবার বোসো |
নিজের অত্যাশ্চর্য কার্যকলাপের ব্যাখ্যা নিজেই দেন …… বুঝতেই তো পারছো , চারিদিকে যা হচ্ছে , আমরা খুব ভয় পাচ্ছি | তুমি বরং এখন এসো না …… ঘরে থাকো | একটু নর্মাল হলে এসো |
এতক্ষণে বেচারা স্বস্তির শ্বাস ফেলে | নিশ্চয়ই ভাবছিল , কি রে বাবা , আমার কুষ্ঠ বা ওই ধরণের কিছু ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে , না কি ওঁর মাথা খারাপ হয়েছে ! এতক্ষণ পর সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পেরে হাল্কা মনে বিদায় নেন |
তিনি চলে যাওয়ার পরেই মা ওই ছেঁড়া পর্দার কাপড় বাড়ির কুয়োতলায় বালতিতে ফেলে দেন | পরদিন সেটা সার্ফ আর ডেটল জলে কেচে আবার সোফায় পাতা হয় |
দুদিন পর সন্ধ্যাবেলা বাজার করে ফিরে এসে সবে থলিটা নামিয়েছি , মা স্যাভলন স্যানিটাইজার স্প্রে আমার গায়ে ধোঁয়ার মত স্প্রে করলেন , এমন সময় আমার পেয়ারের পাগটা আমাকে দেখে লেজ নেড়ে গাল চেটে দেওয়া দূরে থাক , অত্যন্ত সন্দেহজনক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দূর থেকে ভৌঔঔঔ গিটকিরি ছাড়তে লাগলো | কী রে বাবা , পাগল হয়ে গেলো নাকি ? এন্টি ৱ্যাবিজের বুস্টার ডোজ তো দেওয়াই আছে , আবার কী হল রে বাবা !
পরে বুঝলাম , আমার সারা গায়ে স্যাভলন স্যানিটাইজারের তীব্র গন্ধ , হাতে লাইফবয় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের গন্ধ , ইত্যাদি প্রভৃতি মিলিয়ে ও আমার নিজস্ব গন্ধটা পায়নি , তাই এতো উত্তেজিত | এর পর থেকে আমাকে গায়ে স্যানিটাইজার স্প্রে করতে দেখলেই ও হিংস্রমূর্তিতে আমাকে আক্রমণ করতে আসে |
বুঝলেন , এটাই হল নিউ – নর্মাল লাইফ | আমার কুকুরটা অবধি সেটা বুঝে গেছে |
ভালো থাকবেন সবাই ……
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।