অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বাড়ি ঘর জলে থৈথৈ। গ্রামের মাটির বাড়ি,জলের ঝাপটায় ভেজা বারান্দা। চারিদিকে ঘন আঁধার, পাশেই পুকুর। তার ধারে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর একটানা সুরে নিস্তব্ধতা যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ভেজা বারান্দায় বসে আছে রমলা। ঘরের ভিতরে চৌকিতে শুয়ে আছে ছেলে বুবাই। বৃষ্টির ছাঁটে রমলার শাড়ির অনেকটাই ভিজে গিয়েছে কিন্তু কোনো দিকেই হুঁস নেই তার। একমনে ভেবে চলেছে। এই নৈঃশব্দ্যের সন্ধ্যায় তার সামনে হঠাৎ দাঁড়াই রমেন। দু’জনে বসে মুখোমুখি। নিজের অজান্তেই সামনের খুঁটি ধরে রমলা বলে, তোমাকে আমি আর কোথাও যেতে দেবো না, এই বলে দিচ্ছি। কতদিন পর বাড়ি এলে বলো তো?
‘কেন’ এইতো কদিন আগেই গেলাম আবার দেখো চলে আসলাম, রমেনের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় রমলা। কতবার তোমাকে পই পই করে বলে দিয়েছিলাম, এই চাকরিটা তোমাকে আর করতে হবে না। যুদ্ধ দাঙ্গা লেগেই আছে বরং বাড়ি চলে এসো। এখানে কোনো একটা ব্যবসা করবে কিন্তু তুমি তো শুনলে না আমার কথা, চলে গেলে। এদিকে আমি একা ওই একরত্তি ছেলেকে নিয়ে কেমন করে থাকি, সেটা বুঝতে পারো? খুঁটিটার দিকে চেয়ে একভাবে বলতে থাকে রমলা।
‘আর যাব না’ এই এসে গেছি।
সত্যি বলছো?
হ্যাঁ গো, তুমি আর বুবাই তো আমার সব। তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও থাকতে পারি, বলো?
‘আমরাও কি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি’ রমলা পাল্টা উত্তর দেয়।
‘সেজন্যই তো চলে এলাম’ রমেনের পরিষ্কার গলা উপলব্ধি করে রমলা।
‘আমার গা ছুঁয়ে বলো, আর যাবে না?
‘হ্যাঁ, বলছি। এবারও রমেনের হাতের স্পর্শ অনুভব করে রমলা। এমন সময় হঠাৎ ছেলের কান্না সমস্ত স্তব্ধতাকে ডিঙিয়ে রমলার কানে এসে পৌঁছায়। রমলার চমক ভাঙে। হতচকিত হয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখে,কই কেউ নেই তো কোথাও।তাহলে কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিল সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে উদাস ভাবে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে দু’গাল বেয়ে। সজল চক্ষেই ঘরে গিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে, তোর ভয় করছিল বাবা?
‘তুমি কোথায় ছিলে?’ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে ছেলে।আদর করে কপালে চুমু দিয়ে জাপটে ধরে বসে থাকে রমলা। মনে পড়ে তার সেই শ্রাবণ সন্ধ্যার কথা। ঠিক এমনিভাবেই সেদিনও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। ছয় বৎসর আগের সেই সন্ধ্যায় রেল লাইনের ধারে ফুলে ভরা সুন্দর পার্কে বসেছিল রমেনের হাত ধরে। আকাশে ঘন মেঘ জমেছিল। বৃষ্টির আশংকায় তখন পার্ক প্রায় জনশূন্য কিন্তু রমেন সেদিন কিছুতেই আসতে চাইছিল না। রমলার হাত ধরে বলেছিলো, এই হাত আমি কোনোদিন ছাড়বো না, দেখো। আমি শুধু চাকরিতে যোগ দিয়ে আসি।
‘কিন্তু ততদিনে বাবা-মা যদি আমার বিয়ে দিয়ে দেয়’ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলা রমলা।
‘ঠিক হয়ে আছে পাত্র?
‘হ্যাঁ’। মোটামুটি হয়ে আছে।
পাত্র কি করে?
‘স্কুল টিচার’
ও–ও,তা-ই বলো। রমেন রসিকতা করে বলেছিল ভালই তো। মাস্টারের বউ হবে। আমার মতো একজন বিএসএফকে বিয়ে করলে তো তোমাকে বেশিরভাগ সময় একাই থাকতে হবে, তাই না? তাছাড়া তো বুঝতেই পারছো যুদ্ধ দাঙ্গা কখন কি হয়! বিএসএফের জীবন আছে নাকি! সেদিন রসিকতা করে রমলাও বলেছিল, ঠিক আছে, তাহলে আমি স্কুল টিচারকেই বিয়ে করবো। কিন্তু তার কথা শুনে কিন্তু রমেন সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেছিল সেদিন। তাই সঙ্গে সঙ্গে হাত চেপে ধরে বলেছিল, অ্যাই, সত্যি বলছো?
‘কেন, ভয় পেয়ে গেলে? রমেনকে দেখে রমলার মজাই লেগেছিল। দুষ্টুমি হাসি হেসে বলেছিল, তোমার তো লাইফই নেই। একাই থাকতে হবে যখন তখন আর বিয়ে করে কি লাভ, বলো?
‘না,না, তুমিই তো আমার লাইফ’ আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো বলেই রমলার চিবুক ধরে আদর করেছিল রমেন।
‘তাহলে ঠিক আছে’, মাত্র একমাস সময় তোমার। নাহলে বাবা সামনের আমন ধান উঠতেই সেই ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে কিন্তু।
‘এ—-ক মাস’। আমার তো লাগবে মাত্র ৭ দিন, কথাগুলো রমেন খুব দ্রুততার সঙ্গে বলেছিল। আর বলতে বলতেই নেমেছিল মুষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে দু’জনেই ভিজে একসা। ভিজে শাড়িতে বাড়ি ঢুকে ভুরিভুরি মিথ্যে কথা সেদিন বলেছিল রমলা তার মাকে। যথারীতি একমাসের দুদিন আগেই ফিরে এলো রমেন কিন্তু রমলার বাড়ির পরিস্থিতি দেখে পালিয়ে দু’জনে বিয়ে করলো। দু’বছর পর তাদের ফুটফুটে একটি পুত্র সন্তানও হলো কিন্তু বর্ডার সিকিউরিটির চাকরির জন্য রমেন বেশি বাড়িতে আসতে পারে না তবুও যে কয়দিন থাকতো সে, খুব মজা করে কাটাতো ওরা। বেশ সুখেই ছিল ওদের দাম্পত্য জীবন।
হঠাৎ আকাশে আবার মেঘ জমেছে। ছেলেকে নিয়ে রমলার সুখের জীবন। মাতৃত্বের পূর্ণতায় তার শরীর জুড়ে যেন পাহাড়ি ঝর্না। এদিকে ভারত সীমান্তে কাশ্মীরের সঙ্গে লেগেছে যুদ্ধ। ভারত পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গা কিছুতেই কাশ্মীরকে ছেড়ে দেবে না অন্যদিকে কাশ্মীরও তার জায়গা ছাড়তে নারাজ দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা সত্ত্বেও মীমাংসা না হওয়ায় যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো অথচ এই যুদ্ধের খবর ঘুর্ণাক্ষরেও জানতে পারল না রমলা। ঘরে তার টিভি ছিল না, ফোনও ছিল না। ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সারাদিন। হঠাৎ একদিন পাশের বাড়ির সুধীরবাবুর ল্যাণ্ড ফোনে ফোন এল রমেনের। সন্ধ্যার সময় রমলার সঙ্গে কথা বলবে বলে জানায়। সুধীরবাবু সেই খবর দিয়ে যায় রমলাকে। সন্ধ্যায় ফোনের জন্য অপেক্ষা করতেই ফোন এলো রমেনের। ফোন তুলেই রমলা বলে, হ্যালো, কেমন আছো?
‘তোমরা ভালো আছো তো?
‘হ্যাঁ, ভালোই আছি
‘কিন্তু তুমি কেমন আছো, বললে না তো? রমলা পাল্টা প্রশ্ন করলেই রমেন আমতা আমতা করে বলে, ভালো আছি কিন্তু—–
‘কিন্তু কি’ বলো,রমলা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়। ‘আসলে আমার এবার একটু ফিরতে দেরী হবে’, বুঝলে? টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি যত তাড়াতাড়ি পারবো আমি ফিরে যাবো।
‘তা দেরী হবে কেন, সেটা তো বললে না। কোনো ভয়ের কারণ নেই তো?
‘না না, ঐ একটা জায়গা নিয়ে গোলমাল চলছে,যুদ্ধও লাগতে পারে।
তাই নাকি! বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে রমলা। বারবার করে বলে খুব সাবধানে ডিউটি করবে।আর যুদ্ধ শেষ হলেই তুমি চলে এসো।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর সময় নেই। আমি রাখলাম। তোমরা ভালো থেকো, বলেই রমেন ফোন কেটে দেয়। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ দুই মাস। ফোন আসে না। রমলা প্রায় প্রতিদিনই অপেক্ষা করে। শুধু সুধীরবাবুকে জিজ্ঞেস করে ফোন আসলো কিনা। হঠাৎ এক বিকেলে সুধীরবাবু আসলেন রমলার কাছে, একটু মলিন মুখে বললেন, রমলা আজ তোর ফোন এসেছিল,বলল, তোর সঙ্গে সন্ধ্যায় কথা বলবে। সন্ধ্যায় আসিস। ও তা-ই! ইস চিন্তা মুক্ত হলাম। কতদিন ফোন করে না।আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু রমলা জানিস, আজকে যে কথা বলল গলাটা চিনলাম না। ‘ও, ফোনে অনেক সময় অন্য গলার স্বর মনে হয়,কাকু। ও ছাড়া আর কে ফোন করবে বলো? সুধীরবাবু বলে, হয়তো তাই।
সন্ধ্যায় যথারীতি ফোন আসে। রিসিভ করে রমলা ‘হ্যালো– হ্যাঁ হ্যালো আমি বলছি রমেনের সহকর্মী। ‘ও নেই? জিজ্ঞেস করে রমলা।
‘না, ও ডিউটিতে আছে, তাই আমাকে পাঠিয়েছে’শান্তস্বরে জানাই সহকর্মী বন্ধু।
ও আচ্ছা,’হ্যাঁ বলুন——
‘আগামীকাল আমরা কয়েকজন ওর সঙ্গে আপনার বাড়িতে যাবো’।
তা, ভালো তো আসুন, আপনাদের কি গোলমাল চলছিল সব মিটে গেছে?
‘হ্যাঁ, আপাতত মিটে গেছে।
খুব খুশি মনে বাড়ী ফিরে রমলা। আনন্দে উদ্বেল হয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে, কাল তোর বাবা আসবে, জানিস? ছেলে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের মুখে। পরদিন রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করে, কখন আসবে ওরা? এদিকে আকাশ ঘিরে জমছে কালো মেঘ। অপেক্ষা আর শেষ হয় না। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায়। মনে মনে ভাবে, এই পৌঁছে গেল স্টেশনে আর মাত্র 10 মিনিট। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিজেকে একটু ঠিক করে রমলা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে। রমলার বুকে উথালপাথাল ঢেউ, কতদিন পর দেখবে রমেনকে। ভাবতে ভাবতেই দেখে চারজনে একটি কফিন ঘাড়ে করে নিয়ে ঢুকছে রমলার বাড়ি। হতচকিত রমলা। পুকুর পাড়ের শেওড়াগাছটার উপর বসে একটা কাক অস্থিরভাবে কা কা করে চলেছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় নামতে খুঁটিতে ধাক্কা খেতেই রমলার সিঁদুরের টিপ লেপ্টে গেল কপালে।পাড়াপ্রতিবেশীর ভিড়ে উঠোন জনারণ্য। রমলার আর বুঝতে বাকি থাকে না, উঠোনে রাখা কফিনের উপর আছড়ে পড়ে। বুকভাঙা কান্নায় মাথা ঠুকতে থাকে কফিনের উপর। ছোট্ট বুবাই হতভম্ব। বুঝে উঠতে পারে না, মা কাঁদছে কেন। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়। রমেনের সহকর্মীরা কফিন থেকে বের করে রমেনের দেহ শুইয়ে দেয় উঠোনে। প্রচণ্ড জোরে বৃষ্টি নামে। তারপর কতক্ষণ বৃষ্টি চলেছিল তা আর মনে নেই রমলার। পাড়ার লোকজনের সাহায্যে সহকর্মী বন্ধুরা রমেনের সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল,পরে পাড়ার সুধীরকাকুর কাছে শুনেছে রমলা।সে পড়েছিল অচেতন হয়ে উঠোনের উপর। আজ এই বৃষ্টি ঝরা সন্ধ্যায় সেই দগদগে জ্বলন্ত স্মৃতি ভেসে উঠেছে আবার। রমলার সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে সে চেয়ে থাকে উদাসভাবে। অবিরাম পড়ছে বৃষ্টি।