ভগবান অর্জুনকে বললেন যে যখন তাঁর বুদ্ধি, মোহ কোনভাবেই তাঁকে বশে করতে পারবে না, সেই ক্ষণে সকল ফলদায়ক কর্মের কথার ওপর তাঁর আর কোন আগ্রহ থাকবে না। সকল লৌকিক এবং বৈদিক কর্মফল এই বুদ্ধিকে বিভ্রান্ত করে। তাই যখন সেই বুদ্ধি স্থির হবে, ঈশ্বরে অচল হয়ে থাকবে, তখনই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
ধনঞ্জয় শ্রী কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন যে ব্রহ্ম জ্ঞানীর লক্ষণ কি? তিনি কি ভাবে থাকেন, কথা বলেন বা চলেন?
কৃষ্ণ বললেন যে যখন এক যোগী তাঁর সকল কামনা, বাসনা ত্যাগ করেন এবং নিজের থেকেই সন্তুষ্ট থাকেন, তখন তাঁকে স্থিতপ্রজ্ঞ বলা হয়।যেই ব্যক্তি সুখ ও দুঃখে একই ভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, যাঁর মনে অনুরাগ, ভয় বা ক্রোধ কিছুই নেই, সেই ব্যক্তিকে স্থিতপ্রজ্ঞ যোগী বলা যায়। যেই ব্যক্তির কোন মমতা নেই , সুখ ও দুঃখে অবিচলিত থাকেন এবং বুদ্ধি স্থির হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
কচ্ছপ যেমন তার সকল অঙ্গ শরীরের মধ্যে গুটিয়ে ফেলে, সেই রূপ একজন জ্ঞানী ব্যক্তি সকল বিষয়ের থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হন। তাঁর বুদ্ধি স্থির। এবং তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ। ভোগের ইচ্ছে ত্যাগ করা সহজ নয়। সাময়িক ভাবে তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেই ব্যক্তির বুদ্ধি ও চিত্ত স্থির, তাঁর ভোগের প্রতি ইচ্ছে সম্পূর্ণ রূপে চলে যায়।
ভগবান আরও বললেন যে ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করা এক অতীব কঠিন ব্যাপার। জ্ঞানী ব্যক্তিরাও মোক্ষ প্রাপ্তির ওপর যত্নশীল হলেও, সম্ভোগের প্রতি তাঁদের ইচ্ছে অবিচল থাকে। তাই সেই সকল দমন করে, ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তি জন্মালে, বুদ্ধি স্থির হয়।
এই বিষয় থেকে আসক্তি জন্মায়। আসক্তি থেকে কামনা এবং কামনা বাধা প্রাপ্ত হলে ক্রোধ অবশ্যম্ভাবী। পরবর্তীতে ক্রোধ থেকে মোহ জন্মায় এবং স্মরণ শক্তি লোপ পায়। এর ফলে বুদ্ধিনাশ হয়ে মানুষ নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করে।
প্রেম বা অপ্রেম যাই থাকুক না কেন, যদি ইন্দ্রিয় মনের বশে থাকে, সেই ব্যক্তি সদা শান্তিলাভ করে থাকেন। চিত্তের প্রফুল্লতা সকল দুঃখ, গ্লানি দূর করে ও বুদ্ধি স্থির হয়।
যার বুদ্ধি অস্থির, আত্মজ্ঞান জন্মায় না , ঈশ্বরের প্রতি তার একনিষ্ঠ ভক্তি জন্মায় না, তার মনে কোনদিনও শান্তি বিরাজ করে না। শান্তি না থাকলে সুখ অনেক দূরের স্বপ্ন।
ইন্দ্রিয় সবসময় ভোগের দিকে আকৃষ্ট করে। মন এই ভোগ, লালসার পেছনে ছুটে বেড়ায়। এর ফলে মানুষের প্রকৃত বুদ্ধি লোপ পায়, যেমন বাতাসের প্রাবল্য নৌকাকে জলে ডুবিয়ে দেয় চিরতরে।
এই সকল ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রিত হলেই, বুদ্ধি স্থির হওয়া সম্ভব। সাধারণ মানুষের জন্য যেটা রাত্রিকাল,মুনিরা তখন জেগে থাকেন এবং মুনি ঋষিরা যখন নিদ্রাকে আপন করেন, সাধারণ মানুষ জেগে থাকে।
ছোট ছোট নদ নদীরা সমুদ্রে মিশলেও , তাঁর কোন পরিবর্তন হয়ে না। তেমনি সকল রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, এক যোগীর হৃদয়কে স্পর্শ করলেও, কোনরকম পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। শান্তি এখানেই বিরাজ করে, এর বিপরীতে নয়।
যে ব্যক্তি তার সকল কামনা, বাসনা, ইচ্ছে, অনিচ্ছে ত্যাগ করতে সক্ষম, স্থির বুদ্ধি তারই জন্মায়।
ভগবান বললেন যে এই রূপ অবস্থানকে প্রকৃত মুক্তি বলে। জীবিত থেকেও মুক্তি লাভ করা সম্ভব। এই জ্ঞান সংসারমোহ থেকে মুক্তি দেয়। মৃত্যুর সময় এই জ্ঞান ব্রহ্মে বিলীন হতে সাহায্য করে।