ছোটগল্পে কল্যাণ কুন্ডু

সেলাইকল

গোসলখানায় আসার পর থেকে শব্দটা কানে আসছিল আমিনার। বশীর মিঞা তো ঘরে নাই। যোহারের নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেছে। তাহলে কে চালাচ্ছে সেলাই মেশিন? ভাল করে আড়িপেতে শোনার চেষ্টা করে আমিনা। মেশিনের ঘরর্ ঘরর্ আওয়াজটা তার খুব চেনা। আজ বিশ বছর হয়ে গেল। এই তল্লাটে দিন রাত চলতে থাকা হাজার সেলাই মেশিনের মাঝে ঠিক আলাদা করে শব্দটা চিনে নেবার ক্ষমতা রাখে সে।

কৌতুহলে ভাল করে গোসল করা হলো না। কোন মতে দু চার মগ পানী ঢেলে, গা মুছে, মাথায় ভিজে গামছাটা পাক দিয়ে ভিজে কাপড়েই গোসলখানা থেকে বেরিয়ে আসে আমিনা। দ্রুত পায়ে তাদের একচালা ঘরে সেঁধিয়ে হতবাক হয়ে যায়। রোকেয়া। ওস্তাগরের দেওয়া ফ্রকের কাপড় নিয়ে সেলাই করছে। চিল চিৎকার করে ওঠে আমিনা।

–” ওরে আবাগী কি করতেছিস ? আব্বু জানতে পারলে জান খেয়ে নেবে তোর “, প্রায় ছুটে গিয়ে মেয়েকে মেশিন থেকে তোলার চেষ্টা করে আমিনা।

–” আম্মি, দেখ, আব্বুর মতো হয়েছে?” রোকেয়ার চোখ দুটো খুশীতে জ্বল জ্বল করছে। আমিনার চোখের সামনে দুহাতে তুলে ধরে তার নিজের তৈরী ফ্রকটা।

আমিনা অবাক হয়ে যায়। সত্যি তো! বশীর মিঞার সেলাই করা ফ্রকের সাথে কোন তফাৎ নেই। এতোদিন সে আর রোকেয়া হুক লাগানো, বোতামঘর সেলাই থেকে প্যাকেজ করার কাজ করেছে। কোন ফাঁকে রোকেয়া মেশিনের কাজ শিখলো? আর এতো নিঁখুত ভাবে? আমিনা খুশী হয়। কিন্তু বশীর মিঞা কে সে জানে। যদি ঘুনাক্ষরে জানতে পারে তার অনুপস্থিতিতে কেউ সেলাই মেশিনে হাত দিয়েছে, তাহলে রক্ষা নেই।

কপট রাগ দেখিয়ে বলে–” তাড়াতাড়ি তোর আব্বুর করে রাখা ফ্রকেগুলোর সাথে মিলমিশ করে রেখে দে। জানতে পারলে ঘরদোর মাথায় তুলবে খন।”

ভিজে কাপড় ছেড়ে রান্নাশালে চলে যায় আমিনা। গোসলে যাবার আগে উনুনে ভাতের চাল বসিয়ে গিয়েছিল। হাঁড়ির কানায় কানায় ফেনা। সেদ্ধ ভাতের গন্ধ নাকে আসছে।

রোকেয়া মায়ের কথা মতো ফ্রকটা মিশিয়ে দেয় আব্বুর তৈরী অন্যান্য ফ্রকের সাথে। তার আগে বারবার মিলিয়ে দেখে আব্বুর তৈরী করা ফ্রকের তুলনায় তার তৈরী ফ্রকের কোন ত্রুটি হয়েছে কি না! মনটা খুশীতে ভরে যায়। ঠিক আব্বুর মতো সেলাই করতে পেরেছে সে। নাসির হাতে ধরে তাকে শিখিয়েছে। মনে মনে নাসিরকে অনেক গুলো …………. লজ্জায় ফর্সা গাল লাল হয়ে যায়।

বেমানান। তখনও লাগতো। এখনও লাগে একচালার পলস্তারা খসা, লাল ইঁটের দাঁত বের করা টালির ঘরে। বশীর মিঞার ফুল রাউন্ড সেলাইকল আর আমিনা। দুটোই আমিনার আব্বুর দেওয়া শাদীর দান। আমিনার রূপের সাথে পাল্লা দেয় এলিজের কালো রঙের উপর সোনালী রঙের নক্সা করা সুন্দর ঝকঝকে মেশিন। বশীর মিঞার দুই সোহাগের পাত্র।

সময় নিজস্ব নিয়মে ছাপ ফেলে জীবন-যৌবনে। সেদিনের অষ্টাদশী আজ নিজে এক অষ্টাদশীর মা। ঘরকন্না, উনুনশাল, সময়ে সময়ে ছুঁচ সুতো নিয়ে সেলাই ফোঁড়াই আমিনাকে পাকা গৃহিণী করে তুলেছে। বয়সের সাথে সাথে তন্বী শরীরে জমেছে পেলব মেদ। রান্নাশালের পাশে দু ছটাক জমিতে দু চারটা ঢেড়শ, পুঁই, উচ্ছে, পেঁপে আর লাউ গাছ। আমিনার যত্নে ফলবতী। স্বামী, মেয়ে আর এই বাগান আমিনার ধ্যানজ্ঞান।

বশীর মিঞা, লোকটা মন্দ না। তবে, সময় কি তার উপর কোন পরিবর্তনের ছাপ রাখে নি? বছর দুই ঘুরতেই আমিনার কোলে রোকেয়া এলো। আমিনার প্রতি সোহাগের বাটোয়ারা হলো স্বাভাবিক নিয়মেই । পিতৃস্নেহ আর মেশিন সোহাগে আর বাটোয়ারা চায়নি বশীর মিঞা।

আমিনার খুবই একটা খোকার সাধ ছিল। বশীর মিঞা চায় নি। সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছিল — কি হবে গন্ডা গন্ডা প্যায়দা করে। আল্লাতালা যদি খোকা দিতেন তাহলে তাদের’রোকে’ ই ( রোকেয়া) খোকা হয়ে জন্মাতো। আল্লা তাদের হিফাজতে রোকেয়াকে দিয়েছেন। তার কলিজার একটা ভাগ রোকেয়া হলে, আর একটা ভাগ অবশ্যই তার শ্বশুরের দেওয়া সেলাইকল। টালির চালার ফুটো দিয়ে বর্ষার পানী বিছানা, জামা কাপড় ভেজালে তার কিছু যায় আসে না। এক ফোটা পানী যদি সেলাইকলে পড়ে বশীর মিঞার প্রাণটা হু হু করে ওঠে। কত যত্নে আজ বিশ টা বছর সেলাই মেশিনটা রেখেছে, সে এক ইতিহাস। প্রতিদিন ঝাড়পোছ থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় তেল দিয়ে তবেই কাজে বসে। কেউ অযথা হাত দিলে তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়।

বশীর মিঞা ধর্মপ্রাণ মানুষ। সেলাই-এর কাজে ভাল নামডাক। ওস্তাগরেরা খুশী খুশী বশীরকে কাজ দেয়। পাক্কা জবানের লোক। মঙ্গলা হাটের সামাদ, মেটিয়া বুরুজের সামসুদ্দিন আর সাঁকরাইলের লাল্টু শেখ, বশীর মিঞাকে প্রতি সপ্তাহে কাজ দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। হাটবারের আগেরদিন বশীর ঠিক মাল তৈরী করে জমা দেবেই।

ইদানীং বশীর মিঞা পড়েছে ধন্ধে। প্রতিদিন হিসেব মতো গড়ে তিরিশ বত্রিশ পিস কাজ তোলে। সকাল সাতটা থেকে যোহারের নামাজ পর্যন্ত । দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম। আসরের নামাজের পর থেকে এশার নামাজ পর্যন্ত । মাঝে মাগরিবের নামাজের জন্য আধঘণ্টা বিশ্রাম। সবশেষে রাত আটটা থেকে দশটা। এভাবেই ভাগ করা থাকে তার কাজের সময়। হপ্তা আনতে যাওয়া বা মাল ডেলিভারি করার দিনগুলোতে একটু ভিন্ন রুটিন। কিন্তু ইদানীং প্রতিদিনই দশ বারোটা মাল বেশী হয়ে যাচ্ছে। ধন্ধ টা এখানেই। অবশ্য সেলাইকল টা আরবী ঘোড়ার মতো ছোটে। সেই টানে হয়তো দু দশ পিস বেশী সেলাই করে ফেলছে। বুঝতে পারে না বশীর।

একদিন আমিনাকে বলেই ফেললো তার ধন্ধের কথা। মা মেয়ের চোখে চোখে ইশারা হয়। বুঝতে পারে না সে। আমিনা রগড় করে। বলে,

— “একটু বেশী বেশীই কাজ করো। দু পয়সা বেশী হলেই ভাল। মেয়ে তো লাউডগা। ফনফনিয়ে বাড়ছে। বিয়ে শাদির ইন্তেজাম তো করতে হবে।”

কথাটা মনে ধরে বশীর মিঞার। রোকেয়ার বয়সে আমিনাকে ঘরে এনেছিল সে। রোকেয়ার শাদি হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত হতে পারে। রোকেয়া এক ছুটে বেরিয়ে যায় আব্বু আম্মির কথাবার্তার মাঝ থেকে।

–” ঘটকের কাছে খোঁজখবর নাও। ভাল পাত্রের সন্ধান যদি মেলে।”

কথাটা বলেই বিমর্ষ হয়ে যায় বশীর মিঞা। রোকেয়াকে বিয়ে দিলে কলিজাটা অর্ধেক কাটা যাবে? সব মেয়ের বাপেরই কাটা যায়। লাল শাড়ী, লাল চোলি, লাল মেহেন্দির সাজে সজ্জিত রোকের মুখটা মানসপটে ভেসে উঠলো বশীরের।

আমিনার সন্দেহ যে হয় নি এমন নয়। কানাঘুষো দু একজনের কাছে শুনেও ছিল। আমল দেয় নি। বশীর মিঞার কানে গেলে কি কান্ড বাঁধবে সেকথা ভেবেই তার পরাণ কাঁপে। আবার মনে মনে খুশীও। চেনাজানা ঘর। দূর সম্পর্কে আত্মীয়।একই মহল্লায় বাড়ি। বিয়ের পর মেয়েটা কাছেই থাকবে। ছেলেটাও রোজগেরে। নিজে সেলাই-এর কাজ করে। আবার তিন চারজন কারিগর কাজ করে নাসিরের সেলাই-কারখানায়।। চেহারাও সুন্দর। রোকেয়ার সাথে মানাবে বেশ। কিন্তু কথাটা বশীর মিঞার কাছে কিভাবে পাড়বে বুঝতে পারে না আমিনা।

একদিন মসজিদ থেকে ভেসে আসা ফজরের নামাজে সুরে ঘুম ভাঙতেই আমিনা দেখে বশীর মিঞা রাত জেগে কাজ করেছে। সাধারনত ঈদ বা পুজোর সময় হাটে নতুন পোষাকের চাহিদা বাড়লে রাত জাগে কাজ করতো। এখন তো সেসব কিছু নেই। তাহলে? আমিনা প্রশ্ন করে,

–” মিঞা কি বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখতাছো না কি?”

–” মেয়ের শাদী দিতে টাকা লাগবে তো?” বশীর উত্তর দেয়।

–” যা জমানো আছে, তাতে গলার হার, চুড়ি, কানের হয়ে যাবে। বিয়ের আসরের দাওয়াত তো হয়ে যাবে। হবে না?” আমিনা আবার প্রশ্ন করে।

–” সে হবে। ভাবছি, রোকে কে একটা সিঙ্গারের সেলাইকল দেবো।”

–” সে কোন কাজের। নাসিরের তো অনেক ক’টা মেশিন আছে।” বলেই জীভ কাটে আমিনা। মনে মনে ভাবে — এই রে মিঞাকে বলে ফেললাম নাসিরের কথা।

–” সে যার আছে, আছে। আমি আমার মেয়েকে দেব। কি সুন্দর সেলাই-এর হাত রোকের। শাদীর পর নিজেও দু পয়সা রোজগার করতে পারবে।” মেশিনে কাজ করতে করতে বলে বশীর মিঞা।

আমিনা চমকে ওঠে। মিঞা সবকিছুই জানে।

এতোক্ষন বিছানায় চাদরমুড়ি দিয়ে আর একজোড়া কান আব্বু আম্মির কথাবার্তা শুনছিল। সব শুনে কখন নাসিরকে খবরটা দেবে তার জন্য মন প্রাণ ছটপট করতে থাকে।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।