শান্তনুর লিজাকে বিয়ে করার খুব ইচ্ছে ছিল। হল না। প্রথম যেদিন মায়ের সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এসেছিল লিজাকে, সেদিন ও হ্যালো আন্টি বলে হাত বাড়িয়ে এমনভাবে হামলে পড়েছিল তাই দেখে মা চটে ফায়ার। তারপর এক মাসের মধ্যে মধুশ্রীকে পছন্দ করে শান্তনুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
সে বিয়েটা আটকাতে পারেনি। মা বলেছে এ বিয়ে না করলে তার অফিসের সামনের ফুটপাতে বাটি নিয়ে ভিক্ষায় বসবে। প্রেস্টিজে গ্যামাকসিন ছড়ানোর চমকানিতে শান্তনু ঘাবড়ে গিয়ে বাবার কাছে গিয়ে নালিশ করেছিল।
বাবা হাত তুলে দিয়ে বলেছে, ‘তোর মা যখন বলেছে তখন তাই করবে। আমি তোদের মা ব্যাটার ঝামেলার মধ্যে নেই।’
লিজা কত সুন্দর টুং টাং করে ইংরেজিতে কথা বলে। কত সুন্দর করে নিজেকে সাজায়। সবচেয়ে বড়ো কথা লিজা শান্তনুর নাম বদলে সুন্দর একটা নাম রেখেছে। সে এখন শান্তনু কাঞ্জিলাল থেকে হয়েছে শাকা। লিজা যখন তাকে শাকা বলে ডাকে তখন বুকটা কেমন আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।
আর মধুশ্রী রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটায়। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালায়। মধুশ্রীর তৈরি নারকোলের নাড়ু মায়ের খুব পছন্দ। কোনো মানে হয়!
অফিস থেকে শান্তনুর বাড়ি ফিরতে দেরি হত। তাই মা বিয়ে দিয়ে ভেবেছিল বউয়ের টানে তাড়াতাড়ি ফিরবে। তা হল না। সে আরও দেরি করে। শান্তনুর উপর খুবই বিরক্ত মা। আক্ষেপ করে সারাক্ষণ বলে, ‘ছেলেটা মানুষ হল না।’
জামশেদপুরে শান্তনুর বদলি হল। লিজা সেখানে আগেই বদলি হয়েছিল। শান্তনু খুব খুশি। আহ্লাদে গদগদ হয়ে সে মাকে বলল, ‘মা চিন্তা কোরো না। আমি সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আসব। কলকাতা থেকে জামশেদপুর তো বেশি দূরে নয়। আমার আসতে অসুবিধা হবে না।’
মা বলল, ‘তোকে সপ্তাহে একদিন আসতে হবে না। সপ্তাহে একদিন ফোন করলেই হবে। পারলে ছ’মাসে একবার আসিস।’
মার কথা শুনে মনের আনন্দ যেন আর ধরে রাখতে পারছে না শান্তনু। খুব খুশি হয়ে বলল, ‘মা তুমি যা বলবে তাই হবে। তোমার কোন কথাটা আমি শুনিনি বল?’
মা ছেলের মতির এমন গতি দেখে খুশি হয়ে বলল,‘ওখানে গিয়ে কিন্তু বাড়ি ফিরতে রাত করিস না বাবা। অপরিচিত জায়গা। বউমা একা একা থাকবে। ওর ভালো লাগবে না।’
‘মানে?’ চমকে উঠল শান্তনু। একটু ধাতস্ত হয়ে বলল, ‘তুমি তোমার বউমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?’
‘পারব। বউমাকে আমার দরকার নেই। ওকে এনেছি তোকে সাইজে আনার জন্য।’
জামশেদপুরে গিয়ে শান্তনু দেখল লিজা রাজু গোমেসকে বিয়ে করে বেশ মজাসেই আছে। তাকে আর শাকা বলে ডাকল না। পাত্তাই দিল না।
শান্তনু ঠিক করল মধুশ্রীকে সে তৈরি করে নেবে। সে লিজাকে দেখিয়ে দেবে তার বউও কিছু কম নয়। একটা পার্টিতে সে নিয়ে গেল মধুশ্রীকে।
পরদিন সকালে শান্তনু মধুশ্রীকে বলল, ‘তোমাকে আমি আজ থেকে ইংরেজি শেখাব। কিভাবে কথা বলতে হয় তুমি শিখবে।’ শান্তনু বলল, ‘গুড মর্ণিং।’
মধুশ্রী বলল, ‘এই কথাটা কোনোদিন সকালে বাবা মাকে প্রণাম করে বলেছ? তখনও তো তুমি এই ইংরেজি জানতে। তখন এভাবে বললে ওরা তোমাকে কত আশীর্বাদ করত।’
একদিন সকালে মধুশ্রী জল খাবার খেতে এসো বলায় শান্তনু বলল, ‘ওটা জলখাবার না বলে বলবে ব্রেকফাস্ট।’
‘তাতে কি খাবারের স্বাদ বদলে যাবে, না দাম কমবে?’
শান্তনু চুপ করে রইল।
দুপুরের খাবারের সময় শেখাল লাঞ্চ। রাতের খাবার ডিনার। মধুশ্রী শোনে আর মনে মনে বিড়বিড় করে।
এরই মধ্যে একদিন অফিসে লিজা রাজুকে নিয়ে এল ওদের বিবাহ বার্ষিকীর পার্টিতে নিমন্ত্রণ করতে।
সেদিন আবার শান্তনুর জন্মদিন। লিজার এখন আর তা মনে নেই। এইদিনটাতে সে লিজাকে বড়ো হোটেলে নিয়ে খাওয়াত। তখন খেয়ে খুব খুশি হত লিজা।
শান্তনু ঠিক করল লিজার পার্টিতে যাবে। সে মধুশ্রীকে জানাল। বলল, ‘তুমি পার্টিতে যাবার জন্য নিজেকে তৈরি করেছ তো?’
‘মানে? এই সকালবেলাই পার্টিতে যাব কি করে? আমার স্নান হয়নি। পুজো করতে হবে। কত কাজ। আজকাল আবার সকালে পার্টি হচ্ছে নাকি?’
‘আমি এখনই যেতে বলছি না। সেবার পার্টিকে গিয়ে তো কারও সঙ্গে কথা বললে না। একা একা চুপ করে রইলে। তাই বলছি।’
‘ওখানে কি কথা বলব?’
‘সবার সঙ্গে আলাপ করবে। বলবে, হ্যালো।’
আমি কাউকে হেলতে বলতে পারব না। সেদিন তো দেখলাম কিছু না বলতেই সবাই কেমন এ ওর গায়ে হেলে পড়ছে। বললে তো আর রক্ষা নেই। আমি এরকম অসভ্যতা করতে পারব না। আমার বাবা মা তোমার বাবা মা কেউ আমাকে এসব শেখায়নি। তাছাড়া ওইদিন তোমার জন্মদিন। কোথাও যাওয়া চলবে না। আমি বাড়িতে তোমার জন্য রান্না করব। তোমার মার কাছ থেকে জেনেছি তুমি কি কি খেতে ভালোবাসো। আমি তাই করব। পায়েসও করব। কাউকে ডাকবে না। সেদিন শুধু তুমি আর আমি।’
সকালে শান্তনু বলল, ‘আমাকে অফিসে যেতেই হবে। জরুরি কাজ আছে।’
‘যাও তবে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরবে। আর বাবা মাকে ফোন করতে ভুলো না।’
সেদিন লিজার পার্টিতে একাই গেল শান্তনু। লিজা আর রাজু খুব আনন্দেই আছে। যত দেখছে একটার পর একটা গ্লাস থেকে গলায় ঢেলেছে। বাড়িতে ফিরল রাত একটায়। বিছানায় গিয়ে পড়ল। আর কিছু মনে নেই।
সকালে উঠে শান্তনু যেন নিজের বাড়িতেই চোরের দায়ে ধরা পড়েছে। মুখে কথা নেই। বলতে সাহস পেল না। দুপুরে মধুশ্রী খেতে ডাকল।
টেবিলে শান্তনুর সামনে খাবার সাজিয়ে দিয়ে বলল, ‘ডিনারটা খেয়ে এবার আমায় উদ্ধার কর।’
আর চুপ করে থাকতে পারল না শান্তনু। বলল, ‘এখন দুপুরবেলা। এটাকে লাঞ্চ বল।’
ঝাঁজরের মতো বেজে ঠল মধুশ্রী। বলল, ‘আমাকে ফটর ফটর করে ইংরেজি শেখাতে এসো না। কাল কোথায় কি গিলে এসে কিছুই তো খেলে না। আমি ওই রাতের ডিনারগুলোই তো গরম করে পিণ্ডি চটকে দিয়েছি। ওটা ডিনারই হবে । লাঞ্চ বলতে পারব না।’