সাপ্তাহিক টুকরো হাসিতে কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায় – একচল্লিশ

টুকরো হাসি – একচল্লিশ

খানিকটা গুলিয়ে দাও

বারান্দায় বসে ছিলেন সুকান্তবাবু। এমন সময় বাইরে গেটের কাছে দু’জন হাজির হল। দেখে মনে হল তারা যুবকও নয় আবার লোক বলেও মনে হচ্ছে না। এইরকম যুলোকের মতো দেখতে দু’জন টিনের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। দূর থেকেই একজন বলল,‘স্যার শুনছেন।আমরা ভেতরে আসতে পারি।’
ঘরের ভিতরেই ছিলেন তিনি।স্বপ্না পুজোর কেনাকাটার এমন ফিরিস্থি দিতে শুরু করল,শুনে মাথাটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল।বললেন,‘এখনও তো দেরি আছে পুজোর।একটা বই পড়ছি দেখছ তো।’
বইয়ের দিকে তাকাল স্বপ্না।বলল, ‘ইস বইয়ের নামের কি ছব্বা দেখ।নিজেকে কেমন করে শান্ত রাখবেন। ন্যাকা।বই পড়ে তবে উনি নিজেকে শান্ত রাখবেন।কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল ।’
বইটা ঠাস্‌ করে বন্ধ করলেন সুকান্তবাবু।সেটা হাতে রেখেই বললেন,‘তোমার পাঁচালী পরে শুনলেও হবে আমি চললাম।’
চললাম বলে স্বপ্নাকে চমকাবার চেষ্টা করলেন বটে, তবে দৌড় তো ওই বারান্দা পর্যন্ত।
স্যার ডাক শুনে মনটা অন্যরকম হয়ে গেল।কতদিন হল স্যার ডাক শোনা হয় না।
আগে অফিসে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই সবাই বলত, ‘ভিতরে আসব স্যার?’
দরজা বন্ধ থাকায় এছাড়া উপায় ছিল না তখন।যিনি এসেছেন যখন ঘরে ঢুকেই পড়েছেন তখন তো আর না বলা যায় না।অন্য কাজ বন্ধ করে তার কথা শুনতে হত।
কতদিন পরে স্যার ডাক শুনতে পেলেন।মনের ভিতরটা গলে জল । যুলোক দু’জন বাইরের গেট খুলে তাঁর অফিসের লোকজনের মতো ভেতরে ঢুকেই অনুমতি চাইল।অফিসের দিনগুলির কথা মনে পড়ল সুকান্তবাবুর।বললেন,বসুন।
একজন বলল,‘আমাদের আপনি করে বলবেন না। আমরা বয়সে আপনার চেয়ে অনেক ছোটো।’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি।তবে কতটা ছোটো আর কতট বয়স তা আন্দাজ করতে পারছি না।’
অন্যজন বলল,‘আমরা চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে,করতে করতে এই রকম হয়ে গেছি।আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় ভিখিরির বাড়িতে ঢুকেছি।আয়নার ভিতরে আমাকে দেখতে পাই না। শুধু ভিখিরিকে দেখতে পাই।’
সুকান্তবাবু বললেন,‘আপনারা চাকরি বাকরি করেন না?’
একজন বলল,‘আমাদের আপনি করে বলবেন না স্যার।তবে তো কথাই হবে না। আমাদের খুব লজ্জা করবে। আমাদের কেউ আপনি করে বলে না।এরপরে তুমিও বলবে না।তুই তোকারি করবে।আরও পরে রাস্তায় দেখলে ঢিল মারবে।’
এই কথা শুনে শিউরে উঠলেন সুকান্তবাবু।বুঝতে পারলেন না কেন এমন হবে।তিনি বললেন, ‘তোমরা লেখাপড়া করেছ?’
একজন বলল, ‘করেছি। আমি বিএসসি পাস।’
‘আর তুমি?’ স্নেহের সঙ্গে বললেন সুকান্তবাবু।
‘আমি এম এ পাশ করেছি।’অন্যজন বলল।
সুকান্তবাবু বললেন,‘তোমরা চেষ্টা করে দেখ,নিশ্চয়ই চাকরি পেয়ে যাবে।’
একজন বলল,‘প্রাইভেট কোম্পানিগুলোতে পরিচিত লোক ছাড়া নিতে চায় না। চাকরিতে ঢুকে যদি কাজ না করে খেলা করি। খেলাকে ওরা খুব বিরক্তিকর মনে করে।আমি ভালো ক্রিকেট খেলি। একটা অফিসে এটা জানাতে গিয়ে যেই খেলা শব্দটা উচ্চারণ করেছি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে বাউন্সার দিয়ে বের করে দিয়েছে।’
অন্যজন বলল,‘আমি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলাম।পরীক্ষা ভালোই হয়েছিল, কিন্তু প্যানেলের নাম লেখাটা শুনলাম ভুল হয়েছে।তাই আইন এমন ঘাড়ধাক্কা দিয়েছে এখন মনে হচ্ছে আমার চাকরি পাওয়ার আগেই অবসর নেওয়ার বয়স হয়ে যাবে।’
একজন বলল, ‘সবার কথায় চাকরির দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে গিয়েছিলাম।’
সুকান্তবাবু বললেন,‘ভালো করেছ।একসময় দেশের স্বাধীনতার জন্য কত মানুষ আন্দোলন করেছিলেন।তা তোমরা যে আন্দোলন করলে তাতে কোনো ফল হল?’
একজন বলল,‘না।চাকরি হয়নি।আমার পিঠে পুলিশের একটা লাঠির ঘা পড়েছিল।এখনও সেদিনের কথা ভাবলে কেমন ব্যাথায় পিঠটা টনটন করে ওঠে।’
অন্যজন বলল,‘আমারও পায়ে লেগেছে। সেই থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সমস্যা হয়ে গেছে।’
‘তোমরা আমার কাছে এলে কেন?’ অসহায়ের মতো বললেন সুকান্তবাবু।ভিতরে ভিতরে রাগও হচ্ছে।
একজন বলল,‘কি করব? আমাদের এখনও তো টিকে থাকার ইচ্ছেটুকু হয়।’
যুলোকটির কথা শুনে মাথা গরম হয়ে গেল সুকান্তবাবুর।বললেন, ‘সে তো বটেই।তবে আমি আর তোমাদের জন্য কি করতে পারি?’
একজন বলল, ‘আমরা একটা কোম্পানির ডিটারজেন্ট পাউডার বিক্রি করছি।আপনারা নিলেই আমাদের কিছু রোজগার হয়।’
অন্যজন ছোটো একটা নমুনার প্যাকেট সামনের টেবিলের ঊপর রাখল।বলল,‘এটা এমন একটা প্রোডাক্ট যাতে হাজার লেবুর শক্তি আছে।’
একজন বলল,‘এতে শুধু বাসনই ঝকঝকে হবে না।ঘরের মেঝে,বাথরুম আয়নার মতো ঝকঝক করবে।’
স্নান করবার সময় বাথরুমের মেঝে আয়নার মতো!সেটা কি খুব সুবিধের হবে? ভাবতেই মাথা গরম অয়ে গেল সুকান্তবাবুর।
একজন বলল,‘একবার ব্যবহার করে দেখতে পারেন।’
অন্যজন বলল,‘আমাদের এই প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন বাংলা সিরিয়ার ও সিনেমার জনপ্রিয় এক নায়িকা।একজন মন্ত্রী এটা ভালো বলেছেন।’
এই পর্যন্ত শুনেই সুকান্তবাবুর মনে পড়ল এইভাবেই একসময় ছেলেপুলেরা,লোকজন লাগাতার আসত টাকা ডবল করার ধামাকা নিয়ে।বলত কোন নায়িকা,নায়ক,নেতা মন্ত্রীরা কোম্পানির মালিকের গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কোম্পানির কত প্রশংসা করেছে এইসব কত কথা।বলেছিল যে, কোম্পানির মালিক যে কত ভালো একজন মন্ত্রী তা বলেছে।ওই কোম্পানিতে টাকা রাখলে তা অল্পদিনেই দ্বিগুণ হয়ে যাবে।মাসে মাসে প্রচুর টাকা পাওয়া যাবে।কোম্পানির বাংলা,হিন্দি কাগজ আছে, টিভি চ্যানেল আছে।সেই চ্যানেলে ফোন করলে এক ফোনে লাখ লাখ টাকা পাওয়া যায়।তখন সবাই এমন সব নিরাপত্তার কথা বলছিল তা শুনে সুকান্তবাবু তাঁর সর্বস্ব ঢেলেছেন। এখন ৮ বছর হয়ে গেল কোম্পানিগুলি হাওয়া।এখন আর নায়ক নায়িকা নেতা মন্ত্রী কেউ নেই।
এখন হাতে আছে দিন চালানোর কষ্ট আর স্বপ্নার ট্যাকস ট্যাকস গঞ্জনা।
‘তুমি কতগুলি অপদার্থ লোকের কথা শুনে নিজের ইচ্ছেমতো টাকাগুলি জলাঞ্জলি দিলে? একবার আমার সঙ্গে পরামর্শ পর্যন্ত করলে না?’
এটা ঘটনা যে সপ্নার কষ্ট দেখে তিনি সহ্য করতে পারেন না।এখন হাত থেকে তির ছুটে গেছে। এখন চোরের রাজত্বে কিল খেয়ে তা হজম করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
তাঁর মনটাও কেমন হয়ে গেছে। কোনো কিছুতেই আর বিশ্বাস নেই।
স্বপ্না এসে দাঁড়াল বলল, ‘একটু এদিকে শোনো।’
‘কি বলবে? এখানেই বল।’
‘সেই থেকে ওদের সঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছ।একটু চা খাওয়াব যে বাড়িতে তো কিছুই নেই।’
যুলোক দু’জন একসঙ্গে বলল,‘আমাদের কিছু লাগবে না। আমরা চা খাব না।’
স্বপ্না বলল,‘তা বললে হয় নাকি?’
একজন বলল,‘আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারলে খুব ভালো হত।’
অন্যজন বলল,‘আপনিই বিষয়টা ভালো বুঝতে পারতেন।’
স্বপ্না সুকান্তবাবুকে বলল,‘দেখ না গলির মুখে কোনো সবজিওয়ালা পাও কিনা।দু’টো লেবু এনে দাও ওনাদের দু’গ্লাস লেবুর শরবত করে দিই।’
যুলোকেদের দেওয়া ডিটারজেন্টের নমুনার প্যাকেট হাতে নিয়ে সুকান্তবাবু স্বপ্নাকে সেটা দিয়ে বললেন,‘শরবত করতে হলে লেবুর দরকার নেই।এতে শুনলাম হাজার লেবুর শক্তি আছে।এখান থেকে নিয়ে জলে খানিকটা গুলিয়ে দাও।’
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।