‘মুহূর্তের সেলফি’র প্রথম পর্বের শেষ লাইনে আমি আর সুভান শিলিগুড়ির অন্যতম ‘স্বর্গ’ গুলমায় পৌঁছেছিলাম। এবং পাপের কথা উঠেছিল।
কথা হচ্ছে, পাপ যেহেতু বহুমাত্রিক শব্দ, অতএব, তা নিয়ে দু’এক কথা খরচ করা জরুরি (না হলে দুই কবির পাপকে জাস্টিফাই করা মুশকিল হবে)। ধরুন, যদি বলি দেশের সংসদ ভবনে যাওয়ার রোডম্যাপ হল পাপ, তাহলে কি খুব ভুল বলা হয়? কিংবা যারা তৃতীয় বিশ্বের দিকে প্রতিদিন ভাসিয়ে দিচ্ছে বিষ-ওষুধের জাহাজ, হেলথ ড্রিংক বলে স্লো-ফুড-পয়জন খাওয়াচ্ছে গরিবকে, উদয়-অস্ত খাটিয়ে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিচ্ছে না মজবুর মজদূরকে, এবং প্রকাশ্যে ধর্ষণ করেও টাকা ও ক্ষমতার জোরে ধরা না পড়ায় বাহুবলি হিরো হয়ে উঠছে দিকে দিকে। প্রশ্ন হল, এই এরা কি পাপি? হয়তো তাত্ত্বিকভাবে পাপি, মানে কপিবুক পাপি। কিন্তু আইটেম সঙের পৃথিবীর বাস্তব এদের পাপি বলে দেগে দিচ্ছে না মোটেই। কিন্তু কেন? কারণ সমাজ সভ্যতা আসলে একটা মিথ বা মিথ্যের শিল্প। ঘটনা নতুন কিছু না, তীব্র পুরনো। হয়তো বুঝে উঠতে সময় লাগে। যেমন ধরুন, হাতেগরম কোটি টাকা নিয়ে বুক ঝুলিয়ে, পেট দেখিয়ে, পেছনের প্রচুর কারুকাজ ক্যামেরার সামনে দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরে স্টুডিও থেকে বেরোলেন ক্যাটরিনা। বেরিয়েই সাংবাদিক সম্মেলন। বললেন, যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। বললেন, পুরুষতন্ত্র মুর্দাবাদ। আর আমরাও মুহূর্তের জন্য সানি লিওন পজ করে পাড়ার দোকান থেকে দরদাম করে দুটো মোমবাতি কিনলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম নন্দন চত্ত্বরের প্রতিবাদের লাইনে। টিভিতে ছবি উঠল। ফেসবুকে প্রতিবাদী সেলফি ফুটল। তারপর বাড়ি ফিরে পেট পুরে খাসির ঝোল আর ভাত খেয়ে জব্বর ঘুম।
কিন্তু সুভানের ঘুম ভেঙে গেছে, কিশোরেরও! যেমন, ঘুম ভেঙেছিল ভাস্করের (চক্রবর্তী)! যে কারণে আকুল সুপর্ণা সুপর্ণা সুপর্ণা ডাক। সুপর্ণা আসলে ভাস্করের সমস্ত কবিতার ডাক নাম। যে উষ্ণতার কাছে অনন্ত শীতকালের খোঁজ চিরকবিকুলের।
যেহেতু দিনের পর দিন নির্ঘুম বিছানায় ছটফট করে বাঁচা যায় না। তখনই কি কেউ মদ-গাঁজা খায়, কেউ নারী-গুহার প্রাকৃতিক মর্গে অমর মৃত্যুর গন্ধ পায়! একটা সাময়িক মৃত্যুই যেন একজন কবিকে ফের বাঁচার প্লাটফর্মে তুলে আনে!
গুলমাতেও একটা প্লাটফর্ম আছে। আমি আর সুভান যখন শিলিগুড়ি শহরটাকে পেছনে ফেলে সেখানে পৌঁছলাম, তখন গুলমা প্লাটফর্মে একটা মালগাড়ি নির্জন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে পাহাড়, দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গলের মাথায় পাখিদের পরিবার উড়ছে। আর পাহাড়ি মহা নদী। পুরুষ পাথরে ধাক্কা খেয়ে তার চাপা হাসির শব্দ কলকল। বয়ে যাওয়া সাদাটে জলের ধারা রোদে চিকচিক করছে খুব।
নদীর উপরে ছোট একটা রেলব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে জঙ্গল। জঙ্গলে যেতে মানা, জানিয়ে দিল ফরেস্ট গার্ড। ওই জঙ্গলের যৌনতার ভেতরেই ঢুকে পড়েছে রেল লাইন। সেই দুই লাইন ধরে সবজে-অন্ধকারে হারিয়ে যাবে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন।
সুভানের স্কুটি থেকে নেমে কিছুক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম আমি। যেহেতু একটা ছবি থেকে আরেকটা ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছি দুম করে। দুটো ছবির মধ্যে বিন্দুমাত্র মিল নেই যে! এই একটু আগে অবধি বিষন্ন শহুরে ক্যানভাসের চরিত্র ছিলাম, এখন ঢুকে পড়েছি বসে আঁকো প্রতিযোগিতার নিষ্পাপ ক্ষুদে আর্টিস্টের রঙিন আর্টপেপারে।
ধীরেসুস্থে ভুলতে শুরু করলাম—আমি ‘মানুষ’।
একদিকে স্কাইস্ক্র্যাপার, রাজারহাট নিউটাউন, বাইপাস, শপিং মলের বন্যা, হুক্কা বার, আরও কত কত কী! আরেকদিকে ফুল ফোটা, চাঁদ ওঠা, কান্না পাওয়া, কাতুকাতু হাসি পাওয়া, লেবু লজেন্স, ঠাকুমা দিদিমার বড়ি দেওয়া, ওয়ান ডে ফুটবলের বেস্ট প্লেয়ার ট্রফি, একটা কম দামি সাদা সার্টের পিস, অসুস্থ ছেলের পাশে সারা রাত জেগে থাকা মা আর তার হাতপাখা। যা অনন্তের মতোই বিরামহীন বিস্ময়, এবং আমাজন জঙ্গল। যা পুড়িয়ে টাকা করার চেষ্টা চলছে এই এখন। মানুষ নির্ঘাত এরপর নাক দিয়ে টাকা নেবে, অস্কিজেন রিজেক্ট করবে! এমন কোনও প্রযুক্তি আসবেই আসবে। কিন্তু যা বলছিলাম, ক্রমশ বুঝতে পারছি, আমি তো ‘মানুষ’ নই। আমি, সুভান, আমরা…।
আমরা অনন্দ-নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসলাম। ফের পায়ে ছ্যাঁকা লাগল অনন্তের! পুড়তে ভালো লাগল। সূর্য মাথার উপরে, তীব্র রোদ। আমরা নদীর পারের পাথরগুলোকেই সিংহাসন বানিয়ে বসলাম। যেন একটা যৌথ ধ্যানে ঢুকবে দুই ‘সন্ত’! তারপর সেই ধ্যানের পেটের মধ্যে ঢুকে আমি জানতে চাইব—আচ্ছা সুভান, আমি তো তোমাকে চিনতাম না। ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে ছিলে কেবল। কোনোদিন ম্যাসেঞ্জারেও কথা হয়নি। তারপর যেই জানলে কলকাতাকে দুরছাই করে শিলিগুড়ি আসছি, ওমনি তুমি আমাকে স্বাগত জানালে!
কেন গ্রহণ করলে শহরের ফেলে দেওয়া একটা প্রাণকে? নিশ্চয়ই জানতে না, আমি যে এক ধর্ষণের আসামী?