মালা হতাশ হয়ে এসে বসল সুধন্যর পাশে।
সুধন্য বলল, ‘কি হল? বাজারে যাব, টাকাটা বের করে দাও।’
মালা বলল, ‘টাকা নেই।’
‘তুমি যে বললে টাকা দেবে! তাই তো বসে আছি। দেবে না আগে বললে পারতে। আমি আর বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হতাম না।’
‘দিতাম তো। এখন টাকাটা নিতে গিয়ে দেখি সেখানে নেই।’
‘বাড়িতে কি হচ্ছে বলত? বহুদিন থেকেই তো এরকম হচ্ছে। টাকা রেখেছ অথচ নিতে গিয়ে দেখছ সেখানে নেই। এসবের মানে কি? আমরা তিনটে তো মাত্র লোক বাড়িতে। নিচ্ছে কে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তোমাকে কি করে যে বলব।’
‘তুমি আবার এটা ভাবছ না তো যে, আমি নিচ্ছি। কেননা তোমার ভাবনার তো কোনো তল নেই। উলটো পালটা যা খুশি ভাবতেই পার।’
‘একবার বলেছি বলে তুমি কথা শোনাচ্ছ? আমি কি একবারও বলেছি যে, তুমি নিয়েছ।’
‘না। এখন অবশ্য তা বলনি। তবে এমন একটা ভাব করছ। যা বলতে চাও স্পষ্ট করে বলত।’
মালা সুধন্যর দিকে এগিয়ে বসে বলল, ‘জানো আমি অনেকদিন আগে একবার সুজয়কে বলেছিলাম টাকা খুঁজে না পাওয়ার কথা। শুনে তোমার ছেলে রেগে গিয়ে এমন চিৎকার শুরু করল।’
সুধন্য বলল, ‘আমার ছেলে?’
‘তোমার ছেলে না তো কি?’
‘রেগে যখন চিৎকার করেছে তখন সে এখন আমারই ছেলে হবে। তারপর?’
মালা বলল, ‘সেই থেকে ওকে আমি আর কিছু বলতে সাহস পাই না।’
‘আমি ওর হাত খরচের জন্য যে টাকা দিই তুমি ওকে দাও তো? কলেজে যাতায়াত করার খরচ তো কম না।’
‘তুমি ওর জন্য যা দাও তার সবটাই দিই। তাছাড়া আমি আমার থেকে মাঝে মাঝে দিই। সংসারের টাকা বাঁচিয়ে।’
সুধন্য বলল, ‘তুমিও দাও। তার মানে তুমি মনে কর আমি যা দিচ্ছি তা যথেষ্ট নয়। সত্যি মায়ের প্রাণ।’
‘তোমার চিমটি কাটা কথা পরে শুনব। এখন বল টাকা কোথায় রাখব যেখান থেকে কেউ খুঁজে পাবে না।
‘এখন থেকে একটা নির্দিষ্ট জায়গা বেছে নাও। সেখানে রেখে দেখ। যাতে কেউ খুঁজে না পায়।’
‘রেখেছিলাম তো।’
‘বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাখ।’
‘ আমি সব চেষ্টা করেছি। নানা জায়গায় রেখেছি। এমনকি আমি তোমার পুরনো জুতোর মধ্যেও রেখে দেখেছি। টাকা সেখান থেকেও উধাও হয়ে গেছে।’
‘রান্নাঘরে মশলার ডিব্বাতে রাখলে পারতে।’
‘সেটা কি আমি রাখিনি ভেবেছ। আমি বুঝতে পারছি না ওখান থেকেও কি করে টাকা চলে গেল।’
সুধন্য বলল, ‘তোমার আলমারি আছে কি করতে? ওটার মধ্যে রাখতে পারো না? চাবি দিয়ে।’
‘তাও রেখেছিলাম। ওটাতে সবার জামা প্যান্ট আছে। সুজয় জামা বের করবার জন্য চাবিটা নেয়। তুমিও তো নাও।’
সুধন্য বলল, ‘ আমি যখন আলমারি খুলি তখন তো এসে পিছনে দাঁড়িয়ে থাক।’
‘জামা খুঁজতে গিয়ে যাতে সব অগোছালো না কর তাই দাঁড়াই। আমি কি টাকার বিষয়ে তোমাকে কিছ বলেছি? ’
‘এখনও বলনি। তবে বলতে কতক্ষণ। তুমি কি সবসময় সবার পিছনে আলমারি খোলার সময় গাঁড়াও?’
‘আমি তো শুয়ে বসে দিন কাটাই না, যে যখনি কেউ আলমারি খুলবে আমি পাহারা দেবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।’
‘তাহলে এখন কি করতে চাও?’
‘আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কি করব আমি যদি বুঝতাম তাহলে আর তোমাকে বলছি কেন?’
সুধন্য বলল, ‘তাহলে ঘরের এমন কোথাও টাকা রাখবার কথা ভাব, যেখানকার কথা কেউ ভাবতেও পারবে না। ’
‘বাড়িতে আর কোনো জায়গা আমার জানা নেই। বললাম তো আমি যেখানে রেখেছি সেখানে থেকে টাকা গায়েব হয়ে গেছে। সংসার খরচ বাঁচিয়ে নিজের জন্য কিছু টাকা যে রাখব তারও উপায় নেই। এমনই আমার পোড়া কপাল।’
সুধন্য বলল, ‘সুজয় ঠিকমতো লেখাপড়া করছে?’
‘ধুত্তোরি নিকুচি করেছে পড়াশুনোর। আমি কোথায় আমার টাকা রাখব এই নিয়ে ভাবনায় মরছি আর তুমি অন্য কথা বলে সব গুলিয়ে দিতে চাইছ।’
সুধন্য বলল, ‘যা বলছি তার উত্তরটা দিতে এত কষ্ট তোমার?’
‘বলার কি আছে? সারাদিন তোমার ছেলে কি করছে, না করছে আমি তা বলতে পারব না। কোন কথাই তো শোনে না। পড়তে বললে বলে লেখাপড়া করে আর কিছু হবে না।’
‘কি করবে তাহলে? ঝান্ডা নিয়ে ঘুরবে আর লোকের গাড়িতে ঢেলা মরবে?’
‘আমি কি জানি। বলেছে পরীক্ষার আগে বইগুলো একটু দেখে নিলেই হবে। বাকিটা পরীক্ষার হলে ম্যানেজ হয়ে যাবে। কতদিন হয়ে গেল ও তো পড়ার বইগুলি ছুঁয়েই দেখে না।’
‘ওর পরীক্ষার তো এখনও ছ’মাস বাকি আছে।’
‘চুপ করে থেকে মনে মনে হিসেব করে মালা বলল, ঠিক বলেছ। তুমি এত খোঁজ রাখ? কই একবারও তো ছেলেকে পড়তে বল না।’
সুধন্য বলল, ‘ওকে যখন বলতাম তখন তুমি মাঝখানে এসে আমার কথা থামিয়ে দিতে। ছেলে বুঝেছিল যে তুমি সব বোঝো। আমি কিছুই বুঝি না। যথেষ্ট অপমানিত হয়েছি। তাই বলা বন্ধ করে দিয়েছি।’
‘তাই বলে তুমি ওকে কিছু বলবে না? তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?’
‘ না। নেই। তোমার কথার উপরে আমি যাব? আমার এত সাহস আছে?’
‘তুমি এখন এসব বলা একটু থামাও। আমার ভালো লাগছে না। আমি মরছি আমার নিজের জ্বালায়। আমায় কথা না শুনিয়ে একটু পরামর্শ দাও। বল টাকা কোথায় রাখব?’
সুধন্য বলল, ‘তোমার টাকা আপাতত এক জায়গায় রাখতে বলতে পারি, তবে তা মাত্র ছ’মাসের জন্য। এই সময়ের জন্য তুমি নিশ্চিন্ত। এরপরে আবার ভাবতে হবে।’
‘ছ মাস পরে আমি কি করব? তখন টাকা কোথায় রাখব?’
‘পরের কথা পরে ভাবা যাবে।’ সুধন্য বলল।
‘তবে বল টাকা কোথায় রাখব?
সুধন্য বলল, ‘সুজয়ের পড়ার বইতে রাখ।’