– একে এই ভোরের অন্ধকার, কিছুই ঠাহর হয় না, দেখো দেখি আবিদ, ওই ওখানে কি যেনো দেখা যায়।
– ইয়া আল্লাহ্! এ যে এক মেয়ে মানুষের লাশ গো রহমত চাচা!
– ইস! কাদায় একেবারে মাখামাখি হয়ে আছে। একটু যেন নড়ে উঠলো মনে হয়!
– আজ আমাদের মাছ ধরতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে রে আবিদ ।
– হাত লাগা দেখি বেটা, মেয়েটাকে সোজা করি। কাদায় মুখ গুঁজে আছে। হয়তো প্রাণটা এখনও আটকে আছে।
– ও চাচা, এ যে পেটে বাচ্চা! আহা বেচারী এই অবস্থায়…….
– তোমরা সব দলবল মিলে কোথায় চললে গো এই সাতসকালে?
– চাচা, কাল নাকি নৌকাডুবি হয়েছে মাঝ দরিয়ায়। একটু খোঁজ খবর করে দেখি যদি আশেপাশে কাউকে জীবিত পাওয়া যায়। পুলিশের ডুবুরিদের একটু সাহায্য করি গে। এই মেয়েটা তো মনে হয় সাঁতার কেটে বাঁচার চেষ্টা করেছে।
– হ্যাঁ, শেষে পাড়ে পৌঁছে গা ছেড়ে দিয়েছে।এই অবস্থায় আর পারে!
– ভালো জল এনে ওর গা থেকে কাদা গুলো আগে ধো আবিদ। জ্ঞান ফিরলে জানা যাবে কোথা থেকে এসেছে।
– ওই তো মেয়েটা চোখ মেলেছে।
– ওকে আমার ভ্যান রিক্সায় করে আম্মার কাছে নিয়ে যাই চলো চাচা।
ধরাধরি করে মেয়েটাকে দুজন মিলে ভ্যান রিক্সায় তুলে আম্মার বাড়ি নিয়ে গেলো। আম্মা পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘ কে মা তুমি? তোমার নাম কি? কোথায় তোমার বাড়ি?’
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল মেয়েটা সবার মুখের দিকে। হাত নেড়ে কি যেনো বলতে চাইলো। জিভ জড়িয়ে গেলো। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। বোবার মতো গোঙানি শোনা গেলো শুধু।
গরম দুধ খাইয়ে একটু সুস্থ করা হলো ওকে। আম্মা নিজের কাপড় পরিয়ে দিল।
বেলা বয়ে সন্ধ্যা হলো। জেলেরা সবাই ঘরে ফিরলো। হাজার জিজ্ঞেসা করেও ওই মেয়ের মুখ থেকে একটা কথাও বেরোলো না। দুচোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরে শুধু তার।
আম্মা এখন ওকে রাই বলে ডাকে। হাতে শাঁখা পলা দেখে হিন্দু ঘরের বৌ বলে বুঝেছে সবাই।
দেখতে দেখতে একদিন রাই এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।
রাই আর তার শিশু কন্যাকে নিয়ে বেশ আহ্লাদেই কেটে যায় আম্মার একাকী জীবন।
নৌকাডুবির ভয়াবহ স্মৃতি মেয়েটাকে বোবা করে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই উদাস হয়ে কি সব ভাবতে থেকে। নদীর পাড় বেয়ে হেঁটে চলে যায় বহুদূর।
আবিদের হয়েছে মহা জ্বালা। আম্মা ওকেই দায়িত্ব দিয়েছে রাইকে চোখে চোখে রাখার।
ও তো পুরোনো কথা সব ভূলে গেছে। লিখেও বলতে পারেনি কিছু। বছর ঘুরে গেছে।
সন্ধ্যে তখন নদীর ওইপারে পা ডুবিয়ে বসেছে, গায়ের শেষ আলোর রেশটুকু ধুয়ে রাতের বুকে মিলাবে বলে। নদীর জলে সোনালি লাল আভা ভেসে যাচ্ছে দূর আঁধারে।
-‘ রাই, আর যেওনা। আমার কথা শোন।’ আবিদ বলতে থাকে ওকে অনুসরণ করতে করতে।
আবিদের পরম আকুতিময় চোখের দিকে ঘুরে দেখে রাই। এই মুখ, এই দীঘির মত টলটলে চোখ, তার যেন কতো চেনা। খুব ইচ্ছা হয় আবিদের ওই খালি বুকে একবার মাথা রাখতে। সন্ধ্যের এই ঝিমধরা বাতাসে রাই যেনো ঘুমিয়ে পড়তে চায় আবিদের খোলা বুকে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে ওর মুখে।
আবিদ ওর হাত ধরে বলে ‘ কি ভাবছো রাই? তোমার যদি কোনদিন মনে পড়ে যায় সব কথা, চলে যাবে সেদিন আমাদের ছেড়ে?’